মহান সংসদের কলংকিত আইন-প্রণেতা

রাসেল পারভেজ
Published : 27 August 2009, 08:07 PM
Updated : 3 Jan 2011, 12:42 PM

মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ আওয়ামী লীগের মুখপত্র উত্তরণের প্রথম সংখ্যার প্রকাশনা উৎসবে বলেছেন "আওয়ামী লীগ প্রচারে দুর্বল নয়। আওয়ামী লীগ অপপ্রচারে দুর্বল। আমরা মিথ্যা বলতে পারি না। আমরা নিজেদের কথা নিজেরা বলতে লজ্জা পাই"। আওয়ামী লীগের কর্মীমাত্রই সম্ভবত শেখ হাসিনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেন এবং গণমাধ্যমের সামনে সদা সত্য কথাই বলেন, যেমন ভোলা-৩ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য নুরুন্নবি চৌধুরী শাওন – তিনি ২৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হাফিজউদ্দিন আহমেদকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন।

নবম সংসদ নির্বাচনে সে আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. জসিমউদ্দিন যিনি নির্বাচনী হলফনামায় অসত্য তথ্য দেওয়ায় আদালত তাঁর সদস্যপদ খারিজ করে দেন। তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পর শাওন যেদিন সাংসদ হিসেবে শপথ গ্রহন করেন, উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানান:

লালমোহনে বিএনপির নেত্রীকে ধর্ষণ করা হয়নি, তার শ্লীলতাহানি করা হয়েছে। এর ঘটনায় আওয়ামী লীগ বা তার সহযোগী সংগঠনের কোন নেতাকর্মী জড়িত নয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। [ শীর্ষ নিউজ- ২৯শে এপ্রিল ২০১০]

২৫শে এপ্রিল ২০১০ উপনির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীগণ বিএনপি সমর্থকদের উপরে হামলা করেন, তারই ধারাবাহিকতায় যুবলীগ ক্যাডার সিরাজ মিয়ার নেতৃত্বে অন্যান্য ক্যাডাররা ভোলা-৩ নির্বাচনী এলাকার লালমোহনের কচুয়াখালী গ্রামে বিএনপি কর্মী সফি মাঝির স্ত্রী ও মেয়েকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরি শাওন ধর্ষক সিরাজকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেও পুলিশ ২৭শে এপ্রিল ২০১০ পর্যন্ত ধর্ষক সিরাজ ও তার সহযোগীদের গ্রেফতার করতে পারেনি বরং সিরাজ ও তার সহযোগীরা ধর্ষিত ও তাদের পরিবারের সস্যদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছিলো।

যথাসময়ে পুলিশ অভিযুক্ত সিরাজ মিয়াকে গ্রেফতার না করায় সিরাজ মিয়া পরদিন একই গ্রামের বিএনপি সমর্থক নান্নু মেম্বারের ভাতিজা রুবেলের স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। শ্লীলতাহানী এবং ধর্ষণ বিষয়ে নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের অভিজ্ঞতার কোনো বয়ান পাওয়া যায় না অবশ্য তার বক্তব্য থেকে বরং একজন আইনপ্রনেতা হিসেবে তিনি শ্লীলতাহানী ও ধর্ষণকে আলাদা বিবেচনা করতে পারেন এটাই উপনির্বাচনে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিলো।

আইনপ্রণেতা নির্বাচিত হওয়ার পর সেই নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের গাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন আওয়ামী লীগ কর্মী ইব্রাহিম। ইব্রাহিম খুন হওয়ার পর তার ভাই মাসুম আহমদ বাদী হয়ে শাওনসহ ৮ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন। ওই মামলার আরজি থেকে জানা যায়, ইব্রাহিম ঢাকা মহানগর ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডে যুবলীগের দলীয় কাজ করার পাশাপাশি ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। ভোলা-৩ উপনির্বাচনের সময় নুরুন্নবী শাওনের সঙ্গে ইব্রাহিমের ঘনিষ্ঠতা হয়।

তবে পুলিশের ধারণা নুরুন্নবী চৌধুরি নিরপরাধ এবং এ বিষয়ে গায়েবী নিশ্চয়তা পেয়েছিলেন মহানগর পুলিশ কমিশনার এ কে এম শহীদুল হক, তিনি পুলিশের মাসিক অপরাধ বিষয়ক সভা শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন "আল্লাহকে হাজির নাজির রেখে বলছি শাওন নির্দোষ" তবে নিহত ইব্রাহিমের স্ত্রী রিনা বেগম অভিযোগ করে বলেছেন, পুলিশ টাকা খেয়ে এমপি শাওনকে ইব্রাহিম হত্যাকান্ডের দায় থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।

প্রাথমিক অনুমান ছিলো ইব্রাহিম সাংসদের পিস্তল নিয়ে খেলা করবার সময় ভুলক্রমে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন, তবে পরবর্তী ২ সপ্তাহে পুলিশের ভাষ্য বদলে যায় এবং পুলিশ অবশেষে এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের গাড়িচালক কামাল হোসেন কালা এবং সহযোগী মিঠু ও মিজান নামের ৩ জনকে আটক করে। তারা গ্রেফতার হন ইব্রাহিমকে খুন করবার অভিযোগের তদন্ত চলাকালে।

শাওনের বিরুদ্ধে অপরাধ সংশ্লিষ্ঠতার অভিযোগ নতুন কিছু নয়, ঢাকার মালিবাগে এইচবিএম ইকবালের মিছিল থেকে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের মিছিলে গুলি করে ৪ জনকে হত্যা করার মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি ছিলেন যুবলীগের ঢাকা মহানগর নেতা শাওন। শুধু ২০০৬ সালে ঢাকার পল্টন থানায় কমপক্ষে সাতটি ফৌজদারি মামলা হয়েছে। মামলাগুলো হলো ৪৩(৩)০৬, ৩৪(৪)০৬, ১(১১)০৬, ২৭(৪)০৬, ৩১(১)০৬, ২৫(৫)০৬, ২২(৬)০৬। এর মধ্যে ৪৩(৩)০৬ মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে। অপর মামলাগুলো এখনও বিচারাধীন। শাওন নিজেও এ ৭ মামলার কথা স্বীকার করে নির্বাচন কমিশনে দেয়া হলফনামায় বলেছেন, জোট আমলে রাজনৈতিকভাবে এসব মামলা দেয়া হয়েছে।

গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এখানে কোনো ঘটনার ধারাবাহিক বিস্তার পাওয়া যায় না, সে কারণেই অভিযুক্ত কালা, মিজান কিংবা মিঠু আদৌ এই হত্যাকান্ড বিষয়ে কি বক্তব্য রেখেছেন তা আমরা জানতে পারি নি গণমাধ্যমে, সুতরাং আমরা জানতেও পারি না প্রকৃত অপরাধী আদৌ আইনী প্রক্রিয়ায় আটক হয়ে অপরাধের শাস্তি পেয়েছেন কি না। আমর জানতেও পারি না যারা অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে কি না। আমরা জানতে পারি না ঘটনার ধারাবাহিকতায় আদৌ প্রকৃত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে কি না ।

কিন্তু নুরুন্নবীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন বিএনপি সমর্থিত লালমোহনের মেয়র পদপ্রার্থী এনায়েত করিম পাটওয়ারী। গতকাল দুপুর ১২টায় ভোলা প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি অভিযোগ করেছেন ভোলার লালমোহন পৌরসভায় নির্বাচনী কোনো পরিবেশ নেই। এনায়েত করীম আরও বলেন, ভোলা-৩ (লালমোহন-তজুমদ্দিন) আসনের সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন লালমোহন পৌরসভায় উপস্থিত থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এমদাদুল হক তুহিনের পক্ষে ভোট চাইছেন। তাঁরা দেয়ালে পোস্টার সাঁটা, পথসভার নামে জনসভা, গণসংযোগের নামে মিছিল-মিটিংসহ একাধিক আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন।
তবে যেকোনো মূল্যে মেয়র নির্বাচনে জয়ী হয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তার প্রমাণ রাখতে বদ্ধপরিকর বর্তমান সরকার এইসব অভিযোগের নিষ্পত্তি করবেন এমনটা সম্ভবত সত্য নয়

আলোকচিত্রঃ হাসান বিপুল