টিআইবি জরিপ- পরিবর্তন আসতে হবে আমাদের ভেতর থেকেই

রাসেল পারভেজ
Published : 5 Jan 2011, 11:23 PM
Updated : 5 Jan 2011, 11:23 PM

আমাদের বিদ্যমান সামাজিক ন্যায় ব্যবস্থা অধিকাংশ সময়ই বেশ নৃশংস এবং অমানবিক। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠাত ধারণা এবং এর নৃশংসতা দেখে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা নিদ্রাবিহীন রাত্রিযাপন নাগরিক জীবনে খুবই স্বাভাবিক। চলতি পথে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় উদগ্রীব মানুষগুলোর অমানবিকতা অনেক সময়ই দর্শকের মানসিক বিকাশকে পঙ্গু করে দিতে পারে। কিন্তু সবাই সেইসব নৃশংসতার প্রদর্শনী দেখছে উৎসুক চোখে, বাদাম চিবাতে চিবাতে পাশের মানুষের সাথে হাসিমুখে গল্প করতে করতে একজন উপভোগ করছে অন্য একজনের চোখ উপড়ে নেওয়ার দৃশ্য। দৃশ্যটা কল্পনা করলেই গা শিউড়ে উঠতে পারে কিন্তু অনেক সময় এটা হয়তো আমাদের প্রচলিত আইনী কাঠামোর দুর্বলতাকেই প্রকট করে তোলে।

প্রতিটি সরকারই ক্ষমতা গ্রহনের সময়ে অঙ্গীকার করে তারা সামাজিক ন্যায় ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করবে, অপরাধী তার অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করবে। যারা নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় মানুষ বিদ্যমান পুলিশ প্রশাসন তাদের নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করবে। সুতরাং আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষীবাহিনীর উপরে আস্থাবান হতে উদ্বুদ্ধ করতে চান আমাদের প্রশাসকেরা। কিন্তু এবারের দুর্নীতি জরিপে সাধারণ জনগণ নিজেদের আস্থাহীনতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, টিআইবি জরিপে আমাদের বিদ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত বিভাগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বিচার বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষীবাহিনী হয়েছে দ্বিতীয় এবং সরকার উপযুক্ত কারণেই এই প্রতিবেদনের বিরোধিতা করেছে।

আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি দমন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিলো, নির্বাচিত হওয়ার ২ বছর অবসানে যখন আইন শৃঙ্খলা রক্ষীবাহিনী ও অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তিবিধানকারী বিচার বিভাগ দুর্নীতির তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করে তখন অন্তত এই সত্যটুকু প্রতিষ্ঠিত হয় যে গত ২ বছরে এই নির্বাচিত সরকার তার প্রতিশ্রুতি পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য ব্যর্থতা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলের নয়, বরং ব্যর্থতার দায় আমাদের সবার। প্রশ্রয় দিয়ে আমরাই বিচার বিভাগকে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছি, আমরাই পুলিশ বিভাগকে ঘুষে অভ্যস্ত করেছি। আমাদের সম্মিলিত অপরাধের ফলাফল এখন জনগন ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম দুটো হাতিয়ারের কাছে যেকোনো সেবাগ্রহনের সময় উৎকোচ প্রদান করতে বাধ্য হচ্ছে।

আমরা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করি বিভিন্ন প্রকারে, একেবারে দিনের শুরুতে বাসার সামনের মুদির দোকানে ভোজ্য তেল আর চিনি কিনবার সময় দোকানি যখন সরকার নির্ধারিত দামের অন্তত ৫টাকা বেশী রাখছে সেটার প্রতিরোধ না করে দ্রুতই সওদা নিয়ে বাসায় ফিরছি। সরকার সয়াবীন তেলের দাম নির্ধারণ করেছে ৯০ টাকা প্রতি লিটার, প্রতিটি ৫ লিটার তেলের ক্যান বিক্রি হচ্ছে ৫২০ টাকায়। আপনি সৎ নাগরিক হিসেবে প্রশ্ন করলেন সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে এই দাম তার চেয়ে আরও ৬০ টাকা বেশী, দোকানি বলবেন, স্যার এটা আগের কেনা। আপনি পালটা বলতে পারবেন না এই বাড়তি দামটুকু সরকারের কাছ থেকে আদায় করে নেন। সকালের নাস্তা শেষ করে রাস্তায় নামলেন, সিএনজির প্রতি কিলোমিটার ভাড়া নির্ধারিত আছে, আপনি মিটারের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কত নিবেন? আপনি যদি নিজে পরিবর্তনের উদ্যোগ না গ্রহন করেন, পরিবর্তন আসবে না। আপনি ঠিক সে মূহুর্তে ভাববেন আমি ন্যায়পন্থী হলেও আমার পরের যাত্রীতো তা করবেন না, তিনি ঠিকই সিনজি চালকের ঘোষিত ভাড়ায় চলে যাবেন, ন্যায়নিষ্ঠ থাকতে চেয়ে আমি সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাতে পারবো না।

দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে এটাই স্বাভাবিক এবং এই অবিশ্বাসটুকু আমাদের নিজেদের পারস্পরিক আস্থাহীনতার প্রকাশ। আপনি যদি আপনার পাশের মানুষকে ভাবতে বাধ্য করেন, তিনিও হয়তো আপনার মতো ভাবছেন, এবং আপনি তার প্রতিযোগী বিধায় আপনাকে টপকে যাওয়ার জন্যই প্রয়োজনে ৫০টাকা বেশী ভাড়া দিয়ে হলেও তিনি সিএনজিতে চড়ে বসবেন। অথচ সম্পূর্ণ রাস্তায় তিনি নিজেই ভাবছেন তার উপরে অন্যায় করা হচ্ছে। আপনি এই অন্যায়কে সমর্থন করছেন শুধু এমন না আপনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে একজনকে অপরাধপ্রবণ করে তুলছেন। অফিসে পৌঁছানোর পর অন্য সহকর্মীর গীবত গাইছেন, হয়তো মহিলা সহকর্মীকে নিয়ে অশ্লীল এবং অশালীন কৌতুক করছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একজন নারীর উপস্থিতি স্রেফ একটি প্রলম্বিত যৌনাঙ্গস্বরূপ, তিনি যখন পদোন্নতি পাবেন, সেটা পুরুষ সহকর্মীর কাছে শরীর বেচা পদোন্নতি হয়ে উঠবে। হয়তো সামনা সামনি তাকে অভিনন্দিত করে ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে অন্য সহকর্মীকে বলবেন তিনি- তার পদোন্নতি হবে না, তিনি তো অফিসের পরেও স্যারের সাথে উপরি ডিউটি দেন, হয়তো আরও রগরগে বর্ণনা আসবে চিত্রকল্প হিসেবে- একজন কর্মচারী হিসেবে আপনি নিজে নিজেকে যোগ্য না করে তুলে অন্যের যোগ্যতার প্রতি বাঁকা আঙুল তুলবেন এবং ভাববেন কিছু না করেও আপনার পদোন্নতি দেওয়া উচিত, নিদেনপক্ষে বেতন বাড়ানো উচিত, বাজারে আগুণ লেগেছে।

আপনি অন্যায়কে প্রতিরোধ করবেন না, কারণ সেটা আপনার ব্যক্তিগত ঝামেলা নয়, নিজেকে সকল রকম ঝুট ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে রাখতে যেকোনো সংক্ষিপ্ত পথ গ্রহণে আপনি আপত্তি করেন না। ডাক্তারের কাছে গেলে সিরিয়াল সামনে এগিয়ে আনবার জন্য প্রয়োজনে কেরানীকে উৎকোচ দিতে আগ্রহী আপনি। বাসের লাইনেও অন্যকে বঞ্চিত করে আপনি সবার আগে চড়ে সামনের সিট দখল করতে চান এবং যেহেতু আপনার কোনো জায়গায় লাইন ধরার আগ্রহ নেই সুতরাং আপনি সবাইকে পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করতে চান। এই সম্মিলিত আচরণগুলো যখন একজন মানুষের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ বিভাগ কিংবা বিচার বিভাগকে আক্রান্ত করে তখন আপনি আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবছি এটা কিভাবে সম্ভব? তারা এমন অন্যায় করতে পারেন না। অথচ আমরা সবাই একই সমাজের ভেতর থেকে উঠে আসছি, একই রকম সামাজিক ভাবধারায় বিশ্বাসী, তিনি যদি কোন সেবা গ্রহনের জন্য কখনও কোথাও পয়সা কিংবা ঘুষ দিয়েছেন তাহলে তিনি সেবা প্রদানের জন্য ঘুষ চাইতে বিব্রত বোধ করবেন না। আমরা সবাই একই ধাঁচের পাঠশালায় একই রকম সদা সত্য কথা বলিব, অন্যায়ের প্রতিরোধ করিবো এমন সাধু ভাষায় নৈতিকতার পাঠ শিখেছি- আপনি আমি ব্যক্তিগত জীবনে সাধু ভাষার মতো সাধু ভাষায় লেখা নৈতিকতার পাঠকেও বর্জন করেছি, সুতরাং আপনি আমি যখন কোনো সেবা প্রতিষ্ঠানের অংশ হবো তখন আমাদের নৈতিকতার মানোন্নয়নের স্বপ্ন দেখাটা ভুল।

এটা দুঃখজনক বাস্তবতা যে স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকেই দাতা দেশগুলোর ঋণ প্রদানের অন্যতম শর্ত ছিলো দূর্নীতি দমন, আজ ৪০ বছর পরেও ঠিক একই শর্ত আরোপ করে আমাদের ঋণভিত্তিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে তারা। আমরা দুই প্রজন্ম এবং অন্তত ৩৮ বছর শিশুদের নৈতিকতার পাঠ শিখিয়েও তাদের ভেতর থেকে সৎ মানুষটিকে বের করে আনতে পারি নি, কিন্তু এ বছর ১লা জানুয়ারী আমরাই বিশ্ব নৈতিকতা দিবস পালন করেছি। আমাদের স্ববিরোধিতার শেষ নেই এবং আমরা অধিকাংশ সময়ই নিজেদের দায় এড়িয়ে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করে আত্মতৃপ্তিতে ভুগি। দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নয় বরং পরিবর্তন আসতে হবে আমাদের ভেতরে ।