নদী আর সবুজ খুনের ছাড়পত্র কাউকেই দেওয়া ঠিক না

রাসেল পারভেজ
Published : 17 Jan 2011, 01:25 PM
Updated : 17 Jan 2011, 01:25 PM

আজ সোমবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও শেখ মো. জাকির হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট অননুমোদিত বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের বিজ্ঞাপন ও সব ধরনের প্রচারণা বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে অননুমোদিত আবাসন প্রকল্পগুলোর বিলবোর্ড অবিলম্বে সরিয়ে নিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গত বছর ২৬শে জুন যায় যায় দিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা-২০০৮-এর ১৬ (৩) ধারায় বলা হয়েছে, 'কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রকল্প অনুমোদনের পূর্বে প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার কোনো প্লট বা ভূমি বা ইমারত বিক্রয় বা বরাদ্দ প্রদানের জন্য কোনো বিজ্ঞাপন প্রকাশ বা প্রচার কার্য পরিচালনা করা যাবে না এবং প্রকল্প সংক্রান্ত যে কোনো সাইনবোর্ড, বিজ্ঞাপন, প্রচার বা যোগাযোগপত্রে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদন নাম্বার উল্লেখ করতে হবে' সেই একই প্রতিবেদনে রাজউক কতৃপক্ষ জানিয়েছিলো

"বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান নেই৷ শুধুমাত্র বিধি লঙ্ঘন করার দায়ে সতর্কীকরণ নোটিশ দেয়ার বিধান রয়েছে৷ নোটিশ দেয়ার পরও অপরাধীরা সংশোধন না হলে সে ক্ষেত্রে রাজউক পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে- এমনটা বলা হয়েছে৷ অথচ তাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট করে শাস্তি নিশ্চিত করার কথা বলা নেই৷ যে কারণে বছরের পর বছর একের পর এক অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে তারা৷

গত ৫ বছরে একটি বেসরকারি হাউজিং কোম্পানিকেও কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমোদন দেয়া হয়নি রাজউক থেকে৷ অথচ টেলিভিশন, পত্রিকা এবং বিশালাকায় বিলবোর্ডসহ নানাভাবে চলছে অনেক বড় বড় কোম্পানির বিজ্ঞাপন অভিযান৷
"

ঢাকার আশেপাশের খাল ও জলাভুমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে এইসব আবাসন প্রকল্প, ডিটেইলড এরিয়া প্লান বাস্তবায়নের সময় রাজউক অননুমোদিত আবাসন প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে বড় অংকের জরিমানার সুপারিশ করা হয়েছিলো, আওয়ামী লীগের সাংসদ এবং রিহ্যাবের সভাপতি বিপু সে সময়ে এই ড্যাবের বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিষেদাগার করেছিলেন।
রিহ্যাব সভাপতি নসরুল হামিদের হাউজিং প্রকল্প 'প্রিয়প্রাঙ্গণ' (হামিদ রিয়েল এস্টেট) রয়েছে কেরানীগঞ্জে। ১৯৮৭ সালের গেজেট অনুযায়ী কেরানীগঞ্জ এলাকাটি রাজউকের অধীন। কিন্তু তার এই আবাসন প্রকল্পের জন্য তিনি রাজউকের অনুমোদনের আবেদন করলেও রাজউক তা অনুমোদন করে নী।

ড্যাপ পর্যালোচনা কমিটির সদস্য স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ড্যাপের বর্তমান সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে রিহ্যাব সভাপতির প্রিয়প্রাঙ্গণ বাতিল হয়ে যাবে। কারণ এটা জলাভূমিতে অবস্থিত। সম্ভবত সে কারণে "নসরুল হামিদ বিপু" ড্যাপের বর্তমান রূপরেখার বিরোধিতা করছেন।

বসুন্ধরা গ্রুপের অর্থায়নে পরিচালিত কালের কণ্ঠে জনৈক কলামিস্ট তার মন্তব্য প্রতিবেদনে বলেছিলেন বসুন্ধরা কিংবা রিহ্যাবকে দিয়েই তিলোত্তমা ঢাকা নির্মাণের যাবতীয় বিষয়াদি সম্পন্ন করলে সেটা ভবিষ্যতের জন্যই ভালো। বসুন্ধরা ঢাকার অদুরে বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পের নামে জলাভুমি ভরাট করে বিক্রী করেছিলো, একজন প্রতিমন্ত্রীকে হুমকি দিয়ে বসুন্ধরার মালিক সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার পর সরোকার এবং বসুন্ধরা দ্বৈরথে কোনো পক্ষই লাভবান হয় নি। বাবরকে ২০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে ধামাচাপা দেওয়া হত্যা মামলার আসামী হিসেবে বসুন্ধরা মালিকের ছেলেকে আটকের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

প্রথম আলোতে ২৯শে জুন ২০১০ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকায় বিভিন্ন কোম্পানি এ পর্যন্ত ২০০টির মতো প্রকল্পের উন্নয়নকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অনুমোদিত মাত্র ২৬টি। অর্থাৎ ১৭৪টি প্রকল্পের রাজউকের অনুমোদন নেই।

রাজউকের অনুমোদিত ২৬টি প্রকল্প হলো
বারিধারায় অবস্থিত ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্টের বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্পের প্রথম পর্ব (সম্প্রসারিত ও সংশোধিত বাদে এ থেকে এফ ব্লক পর্যন্ত),
ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের বনশ্রী আবাসিক প্রকল্প ও মহানগর প্রকল্প (সংশোধিত অংশ বাদে),
পল্লবী প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব (সংশোধিত ও সম্প্রসারিত বাদে),
নিকেতন প্রকল্প,
রায়েরবাজার প্রকল্প,
মিরপুরের মল্লিকা আবাসিক প্রকল্প,
বাগবাড়িতে শীশমহল ল্যান্ড প্রকল্প,
কল্যাণপুর ল্যান্ড প্রজেক্ট,
পোস্তগোলা আবাসিক প্রকল্প,
পোস্তগোলা রিভারভিউ ল্যান্ড প্রকল্প,
কে এম দাস লেন প্রকল্প,
মিরপুর আরামবাগ কো-অপারেটিভ সোসাইটি প্রকল্প,
শিকদার রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের প্রকল্প,
প্রবাল হাউজিং
সুনিবিড় গৃহ নির্মাণ সমবায় সমিতি লিমিটেডের প্রকল্প,
মিরপুরে মুক্তি হাউজিং,
আবদুর রফিক হাউজিং,
সবুজবাগে বাসাবো আবাসিক প্রকল্প,
পিসিকালচার হাউজিং প্রকল্প,
আদর্শ ছায়ানীড় গৃহ নির্মাণ প্রকল্প,
মোহাম্মদপুর জনতা কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেডের প্রকল্প,
বায়তুল আমান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি. প্রকল্প,
তেজগাঁওয়ে মেট্রোপলিটন কো-অপারেটিভ হাউজিং এবং
মিরপুর পাইকপাড়ায় ক্যাপ হাসান হাউজিং প্রকল্প।

কিন্তু অবৈধ ১৭৪টি প্রকল্পের অধিকাংশের উন্নয়ন কাজ অব্যাহত আছে এবং বিভিন্ন রিহ্যাব মেলায় সেসব প্রল বিক্রয় ও বুকিং চলছে।
রাজউকের অধীনে রয়েছে মাত্র ৫৯০ বর্গমাইল এলাকা, এর বাইরে সম্পূর্ণ দেশেই আবাসন প্রকল্পের নামে জলাভুমি দখল চলছে, সংরক্ষিত বনভুমি, নদী ও খাল দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে বহুতল ভবন এবং সেসব বিক্রীও হচ্ছে চড়া দামে।
সেসব প্রকল্প অনুমোদনে কোনো নীতিমালাই অনুসরন করা হচ্ছে না ২৩শে আগস্ট প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমনটা বলা হয়েছিলো।

আজ হাইকোর্ট অনুমোদনহীন আবাসন প্রকল্পের বিজ্ঞাপন প্রচার ও বিলবোর্ড স্থাপন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। ঢাকা ও তার আশেপাশের ক্ষীণস্রোত নদী ও সংকীর্ণ খালগুলো অনেক আগেই ভুমিদশ্যুর বালিতে ডুবে মৃত্যু বরণ করেছে। অসংখ্য মানুষ এসব প্লট কিনেছেন, সেখানে তাদের স্বপ্নের আবাস গড়েছেন। মানুষের কোথাও না কোথাও শান্তির নীড় গড়তে হবে, আবাসন প্রতিষ্ঠানের প্রচারিত বিজ্ঞাপনে এমনটাই বারংবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয় সবুজে বাঁচুন, আর সবুজে বাঁচতে গিয়ে খোদ লোভী ডেভলপার আর সুখী গেরস্ত খুন করছে দেশের সবুজ বেষ্ঠনী।

বিজ্ঞাপনে প্রতারিত এইসব মানুষের নির্মিত বসতভিটা কি উচ্ছেদ করবে সরকার? যা ভুল হোয়ে গিয়েছে অতীতে সেসব মার্জনা করে নতুন কোনো ভবন নির্মানের নির্দেশ দেওয়া থেকে বিরত রাখবেন শহর, নগর পরিকল্পকগণ? তাহলে যারা জমি কিনে প্রতারিত হয়েছেন তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ জরিমানাসমেত ফেরত প্রদানের নির্দেশনা কি দেবে হাইকোর্ট? না কি আবাসন প্রকল্পগুলো যে প্রক্রিয়ায় রাজউক ও সরকারকে বাধ্য করে তাদের আবাসন প্রকল্প মেনে নিতে সে চাপের কাছেই নতি স্বীকার করবে আদালত? রূপগঞ্জে সেনাবাহিনীর হাউজিং প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহনকৃত ভুমি কি তাদের মালিককে ফেরত দেওয়া হবে? সামরিক বাহিনীর নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত আবাসন প্রকল্পটি গড়ে উঠেছে পানি নিষ্কাশন এলাকার উপরে, সেটার নীতিগত অনুমোদন যদি রাজউক প্রদান করে তাহলে বসুন্ধরার আবাসন প্রকল্প বাতিলের কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকবে না রাজউকের?

নিজের ভুমি সামরিক বাহিনীর করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে গিয়ে রূপগঞ্জে নিহত মানুষগুলোর হত্যার সাথে জড়িত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা গ্রহন করতে নির্দেশ দিবে আদালত, ভবিষ্যতের কাছে এসব প্রশ্নই তুলে রাখা ভালো।