কবি ও কবিতা নিয়ে ভাবনা

রিয়েল আবদুল্লাহ আল মামুন
Published : 8 August 2017, 04:47 PM
Updated : 8 August 2017, 04:47 PM

আমি কবিতা লিখতে খুব ভালোবাসি। খুব ছোট বেলায় আমার ছোট মামার আনা একটি বইয়ে পড়ে ছিলাম-সম্ভবত প্লেটো বলেছিলেন,"ভালোবাসার ছোঁয়ায় প্রত্যেকে কবি হয়ে যায়।" আমি কি কারণে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম ? যখন খুব ছোট ছিলাম সম্ভবত ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি,একদিন বাবা আমায় লাঙ্গলবন্দ লিয়ে গিয়েছিলেন মেলায়। মেলা থেকে বাঁশী আর ঢোল কিনে এনেছিলাম। পথে আসতে আর যাবার সময় দুপাশের যে অপার সৌন্দর্য দেখেছিলাম তা থেকে বাড়িতে এসে লিখে ফেলি খুব সুন্দর একটি দেশের কবিতা। তখন নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার লক্ষীপুর থাকতাম।সেখানে স্থানীয় একটি পত্রিকায় ছাপা হয়। অবশ্য এখন আর সে পত্রিকার কপিও নেই বা সে পত্রিকার নামও মনে নেই।
সেই যে স্বপ্রণোদিত স্বরচিত লেখার শুরু। কতো যে কবিতা লিখেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। মনে যাই ই আসতো লিখতাম খাতার পর খাতা ভরে ফেলতাম। এখনো অনেকপুরাতন লেখা মায়ের এক বাক্সে আছে। মা সযত্নে রেখে দিয়েছেন। আসলে এখন বুঝি তখন যা কিছু লেখতাম তা কবিতা হতো না। হতো মনের কথার লিপিবদ্ধকরন। প্রাথমিক স্টেজ বলে কথা। সে সব পড়লে খুব হাসি পায় কি লিখতাম এসব ! তবে কবিতা না হলেও রঙের দিক থেকে কবিতাগুলো ছিলো আলাদা বৈচিত্রের। খুব সাহজিয়া ভাবময় প্রেমরসে ভরপুর।

সবার ভেতরেই কবিতার বসবাস। কবিতাকে ভালোবাসে সবাই কিন্ত মুখে প্রকাশ করেনা। এড়িয়ে যায় । যদি বলা হয়, "ভাই আপনি কি কবিতা লেখেন ?"-তাঁর জন্য যাতে অপমান হতে না হয় সেদিকে সজাগ থাকে। অথচ আমি মনে করি কবিতা নিজের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার নয়। ছড়িয়ে দেবার। কবিতার মাধ্যম হওয়া সত্যাসত্য যাচাইয়ের উৎকৃষ্ট কিছু। যুগে যুগে কালে কালে কবিরাই বর্তমান সময়কে ভবিষ্যতে নিয়ে গেছেন। এই যেমন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন আবিষ্কারের পর দেখা গেছে সেখানে যে সমস্ত কবি লিখেছেন,তাঁরা প্রত্যেকেই সে সময়কার সমকালীন প্রেম-প্রীতি, বোধ-ভালোবাসা, সমাজচিত্র কঠোরভাবে ধারন করেছেন। ফলে বর্তমানে এতবছর পরে এসে সে সময় সম্বন্ধে জানতে পারছি।

এড্রিয়ান মছেল, "একটা সত্য উচ্চারণ এই যে,"অধিকাংশ মানুষ অধিকাংশ কবিতাকে এড়িয়ে যায়,কারণ অধিকাংশ কবিতা অধিকাংশ মানুষকে এড়িয়ে যায়।"
একজন সুপ্রতিষ্ঠিত কবি বা সাহিত্যিক যতো বছর তাঁর সৃষ্টিতে মগ্ন থাকেন, ততটা সময়সহ মৃত্যুর পর থেকে দেড়শো বছর পর্যন্ত তাঁর একটা ইমেজ বহমান থাকে। এরপর আস্তে আস্তে তাঁর ইমেজ কমে আসে। তাঁর আগেই পেছন থেকে সময়ের তাগিদে বেরিয়ে আসেন নতুন কোন লেখক। সে আসে বীরের বেশে। একইভাবে আধিপত্য বিস্তার করে সাহিত্য জগতে-বিষয়টা এমন যে  একজন লেখক যায় একজন আসে। এ যেন যুগের সাথে যুগের সিলসিলা।

কবিই পারে বর্তমানকে তাঁর কথা ও কাব্যের ছন্দে বেঁধে ভবিষ্যতে নিয়ে যেতে। যুগে যুগে কবি আসেন সমাজের সমস্ত অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে কণ্ঠ সোচ্চার করে। তাঁর সৃজনশীল সৃষ্টি কেবল সত্যের জন্য। তিনি  কারও ভয়ে ভীত হয়ে লেখেন না। যতই তাঁর বই হোক বাজেয়াপ্ত-কবিতা তিনি লিখবেনই। বিশেষ করে কবি যতো বাধাই আসুক মত প্রকাশে তিনি স্বাধীন। একজন কবিই পারেন শাসকের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে। দুঃশাসনে মগ্ন শাসকের ভিত নাড়িয়ে দিতে একজন কবির একটি শ্রেষ্ঠ কবিতাই যথেষ্ট। কারণ কবি সত্য-কবিতা সত্য-সৃষ্টি সত্য।

কবি সৃষ্টি করেন আর তাঁর সেই সৃষ্টি দিগ্বিদিক আলো ছড়ায়।

যুগে যুগে শাসকের মনঃপুত না হলেই লেখকের লেখার বইয়ের উপর নেমে এসেছে খড়গ। নিষিদ্ধ হয়েছে নানা বই কোন কোন সময় লেখক নিজেও। যেমনঃ কাজী নজরুল ইসলাম, শ্রী ব্রজবিহারী বর্ন্মন, বিজয় লাল চট্রোপাধ্যায়, মুকুন্দ দাস এদের সৃষ্টি কোন না কোন সময় ক্ষমতাসীন শাসক দ্বারা নিষিদ্ধ হয়েছিলো।

শাসক কবিতা বুঝে না। কবিতার কথা সব শাসকের কাছে মধুর হবে তাতো অকল্পনীয়-তাঁর কাছে কবিতা সকল সময়ই অম্ল-মধুর । কবিতা যে শাসক শুনবে তাঁর ভেতরে মনুষ্যত্ত্ব তৈরি হবেই। সে তখন অন্যায় কাজ ইচ্ছা করেও করতে পারবে না । এই বোধ প্রতিশাসকের আছে, তাই তাঁদের কবিতাকে এত ভয়-কবিকে এত ভয়। তাই তাঁরা যুগে যুগে কবিতার পেছনে লাগে। কবিতা ও কবির বিরুদ্ধাচারণ করে। অথচ কবি ও কবিতা অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত।

আমি কবিতা লেখি মনের সুখে। কবিতার ক্ষেত্রকে বা সাহিত্যক্ষেত্রকে পুজি করে যারা পেট চালাতে আসে তাঁদের সদা বিপক্ষে আমি। কবিতা দিয়ে ভালোবাসা আদায় করা যায়। কবিতা সমস্ত আত্মমুক্তির হাতিয়ার । আবার কবি হতে হলে তাঁকে হতে হয় অগাধ জ্ঞানসম্পন্ন। অফুরন্ত গুনের সম্ভারে কবি হয়ে উঠেন সর্বজনীন।

জনৈক এক পন্ডিতের ভাষায়,"কবিতা হলো কবির অন্তরের আগুন যাকে চেপে রাখা যায় না। তাকে বেরুতে না দিলে সে বড় দহে। কবির এই দহন জ্বালার সীমা-পরিসীমা নেই। অন্তরকে ছারখার করে ফেলে।''
টি.এস. এলিয়টের লেখা একটি প্রবন্ধ হলো "ট্র্যাডিশন এন্ড দ্যা ইন্ডিভিজ্যুয়াল ট্যালেন্ট" (Tradition and the Individual Talent by….  Thomas Stearns Eliot) বইটিতে বলা হয়েছে একজন লেখকের কি কি গুনাবলী থাকা উচিত। সে আলোকে একটু  তোলে ধরছি।

ক) এলিয়ট বলেন যে-লেখালেখিতে ঐতিহ্য শব্দটাকে ইংরেজি সাহিত্যে সাধারনত নেতিবাচক ভাবে ব্যবহার করা হলেও একজন কবিকে তাঁর  সাহিত্যের ঐতিহ্য সম্পর্কে ভাল ধারনা রাখতে হবে।
খ) নতুন কোন কবিকে পূর্ববর্তী যত কবি আছেন তাঁদের কবিতা পড়তে হবে। —–তাঁদেরসবার কবিতা পড়ার পর নব্য কবি তাঁর নিজস্ব মেধা দিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করবেন, যা আগে কোন কবি করেন নি। যেমনঃ ভালবাসা এমন একটি বিষয় যা নিয়ে যুগেযুগে কবি সাহিত্যিকরা লিখে গেছেন। কিন্তু তাতে কি? এলিয়ট ভালবাসাকে প্রকাশ করেছেন সম্পূর্ণ নতুন ভাবে তাঁর "দ্যা ওয়েস্ট ল্যান্ড" কবিতায়। প্রকাশ ভঙ্গিতেও রয়েছে নতুনত্ব, খন্ড খন্ড আকারে তিনি আধুনিক বহুগামী প্রেমকে এঁকেছেন।

গ) নব্য কবি পুরনো বিষয়কেই তুলে ধরবেন কিন্তু সেটা হবে তাঁর সমসাময়িক চিন্তা ভাবনা সমৃদ্ধ। প্রেম আগেও ছিল। এখনো আছে। কিন্তু এলিয়ট দেখিয়েছেন তাঁর সময়কার প্রেমকে যা শুধু শরীরের ক্ষুধা মেটাতো, এতে মনের কোন সংযুক্তি ছিল না।

ঘ) এলিয়টের মতে-কবিতা পড়ার পূর্বেই কবির সম্পর্কে কোন ভাল মন্দ ধারনা করা যাবে না। কার কবিতা সেটা না ভেবে আগে কবিতাটাই পড়া উচিত। তারপর সেটার ভালমন্দ বিচার করে কবির বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে।

ঙ) কোন কবির দু একটা কবিতা ভাল মানেই তাঁর সব কবিতা ভাল হবে, এমন ভাবাটাইভুল। কবিকে দিয়ে নয় বরং কবিতা কেমন তার ওপরেই কবিতার ভাল মন্দ বিচার করতে হবে। তাতে করে একেক কবির একেক কবিতা ভাল লাগবে।

চ) কবিতা লিখতে চাইলে আপনাকে আগে নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। শুধু নিজের কথা নয় বরং পুরো মানব জাতির মনের কথা আপনাকে কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে হবে। কিন্তু নিজেকে অতিক্রম করাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। সেটা করতে হলে অন্যান্য অনেক কবির কবিতা পড়তে হবে। তাহলেই আপনার ভেতরে নতুন ধারনার সঞ্চার হবে। অতঃপর এই নতুন ধারনাকে আপনার ভেতরের নিজস্বতা দিয়ে ফুটিয়ে তুলবেন।

ছ) আগের কবিদের লেখাকেই কাটছাট করে নিজের মত করে চালিয়ে দিলে কবি হওয়া যায়না। সেই কবিই সব থেকে সফল যিনি নিজের এবং নিজের সৃষ্টির মধ্যে দূরত্ব স্থাপন করতে পারেন। অর্থাৎ নিজের লেখাতে নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ না করে বরং অন্যের অনুভূতিকে বুঝতে পেরে তা প্রকাশ করেন।

জ) কবিকে আগের যুগ সম্বন্ধে জানতে হবে এবং আগের যুগের সাথে বর্তমানে কতটুকু পার্থক্য সেই সমসাময়িকতাটা ফুটিয়ে তুলতে হবে। সেইসাথে আপনার কবিতায় নতুনত্ব থাকতে হবে। যেমনঃ পূর্বে অনেক কবিই সন্ধ্যার বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু এলিয়ট দেখিয়েছেন হলুদ রঙের তুষার সন্ধ্যে। মানুষের মনের অশুদ্ধতায় প্রকৃতিও নোংরা, হলদেটে হয়ে গেছে।

ঝ) কবিদের কল্পনাশক্তি থাকতে হবে প্রখর। যেমনঃ কীটস তাঁর কবিতায় নাইটিঙ্গেল পাখির এমন  গুন বর্ণনা করেছেন, যা সত্যিকার অর্থে পাখিটির নেই। মিলটন "প্যারাডাইস লস্ট" এ দোযখের বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু তিনি কখনো দোযখ দেখেন নি। পুরোনো গ্রন্থ থেকে তিনি বিষয়টা নিলেও প্রকাশ করেছেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে, কারও অণুকরণে নয়।

ঞ) একজন খারাপ কবির লক্ষণ হল, তিনি সেই বিষয়টাতে বেশি জোর দেন, যেখানে দেবার কথা নয়। আর সেটাতে জোর দেন না, যেটাতে দেবার কথা। (সংগৃহীত)

সবশেষে কবিকে নিজের আমিত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে সার্বজনীন হতে হবে। তাঁর লেখায় থাকতে হবে পূর্বের কবিদের থেকে ভিন্নতা এবং নতুনত্ব। নিজস্ব আবেগের উর্ধ্বে উঠে তাঁকে ভাবতে হবে এবং লেখার বিষয় বস্তু হবে আকষর্ণীয়।

যেমন মূর্খ লোকের সাথে তর্ক করা যায় না, এঁরা আপনাকে তাদের লেভেলে নামিয়ে নিয়ে যাবে ।  তেমনি অল্প জানা কবিদের সাথে কবিতা কিংবা তাদের সমালোচনা বা প্রশ্রয় দেওয়াটাও এক ধরনের বোকামি। আপনি তাঁর ভুল ধরিয়ে দিলেন তো বিপদে পড়লেন। সে আপনার চৌদ্দগোষ্ঠীসহ উদ্দার করবেন। সে একবারও ভাববে না আপনি কি বলেছেন তা একবার দেখি। সে আপনার কবিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলবেন। তারপর শুরু হবে আপনার দূর্ণাম কীর্তন। তাই বলে দমে গেলে হবে না। আমার বেলা অহরহই তা ঘটে-আমি দমে যাই না। সত্যকে সত্যই বলি।

কবি কবিতা লিখবেন-কিছুতেই আশাহত হবেন না। তাঁকে মনে রাখতে হবে,"মানুষ তাঁর আশার সমান সুন্দর, বিশ্বাসের সমান বড়।" আবার কবিকে মনে রাখতে হবে,কবিতায় টাকা নেই টাকাতেও কবিতা নেই।'(রবার্ট গ্রেভস)''। রবার্ট ফ্রস্টের ভাষায়, "কবি হওয়া একটি অবস্থা,পেশা নয়।"

কবিকে মুক্তচিন্তার কথা,মানুষের কথা,ভালোবাসার কথা সব বলতে হবে। কবির মসি যোদ্ধার অসির চাইতে শক্তিশালী। সে শাসকের ভিত নাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ কবি হলো সেই সত্যবাদী যে সর্বদা সত্যি বলে।"-জ্যাঁ ককতোঁ

অনেক কবি আছেন কবিতার মৌলিকত্ব নিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টি করেন। আসলে তা মৌলিক নয় তা হলো স্বাতন্ত্রিকতা সম্পন্ন। স্বতন্ত্র কবিতা নিয়ে এলিয়ট বলেছেনঃ If we approach a poet without this prejudice , we shall often find that not only the best, the most individual parts of his work may be those in which the dead poets, his ancestors, assert their immortality most vigorously.
সবচেয়ে বড় কথা হলো কবিতায় সাতন্ত্র্যবোধ থাকতে হবে তা হলেই কবি হবেন স্বার্থক। প্রচুর পড়াশুনা করতে হবে কেবল তথ্য সংগ্রহের জন্য। তা কবিতায় এমনভাবে আসবে যা অন্যের সাথে মিলবে না। আসলে কবিতার স্বাতন্ত্রিকতা হলো একেবারে নতুন তরতাজা ভিন্ন স্বাদের ব্যাতিক্রমধর্মী একটি কবিতার প্রাপ্যতা।

ফরাসি কবি আর্তুর র‍্যাঁবো বলেন-কবিতা হচ্ছে মানবাত্মার অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞান।" পশ্চিমবাংলার কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর কথায় কবি ও কবিতা মূল্যায়ন- "কবির কন্ঠ ঈশ্বরের উচ্চারণ মাত্র।"

রবার্ট ফ্রস্ট বলেন, "একটি কবিতার শুরু আনন্দে, সমাপ্তি প্রাজ্ঞতায়।" অন্য একজায়গায়  রবার্ট ফ্রস্ট বলেন, "কবিতা হলো তা যা অনুবাদে হারিয়ে যায়।"

আবার কবি শেলী বলেন, "কবিতা হলো সুখিতম ও সর্বোত্তম মনগুলোর সর্বোত্তম ও সুখিতম মুহূর্তগুলোর রেকর্ড।" শেলী অন্য জায়গায় বলেন,"কবিরা হলো পৃথিবীর অস্বীকৃত আইন-প্রণেতা।"

জন মেইসফিল্ডের ভাষায়, "সাধারণ জ্ঞান, যা সকলের থাকে না এবং অসাধারণ জ্ঞান, যা খুব অল্প লোকেরই থাকে –এই দু'য়ের সাথে  মিশ্রণ হলো কবিতা।" ভলতেয়ারের ভাষায়, "কবিতা হলো আত্মার সংগীত।"  উইলিয়াম ব্লিসেট বলেন, "কবিতা হলো চাঁদের মতো, যা কোনো কিছু বিজ্ঞাপিত করে না।" স্যামুয়েল জনসনের ভাষায়, "কবিতা আনন্দকে সত্যের সাথে একীভূত করার শিল্প।" গুস্তাভ ফ্লবার্ত বলেন, "জীবনের একটি কণাও নেই যা নিজের মধ্যে কবিতা বহন করে না।"

কবিতা হচ্ছে বিশুদ্ধ শব্দের নির্মাণ। কোন কবির কবিতা কেমন হবে তা নির্ভরকরে তিনি কতটা স্বার্থকভাবে শব্দ প্রয়োগ করেন। আর সে শব্দ কতোটা আধুনিক এবং তা প্রায়োগিক দিক থেকে কতোটা ব্যাঞ্জনা তৈরি করে। কবির জন্য এ খুব জরুরি।

শব্দ বিন্যাসের কৌশলে প্রতীক রূপক উপমা চিত্রকল্প প্রভৃতির মাধ্যমে রচিত হয় কবিতা। মালার্মে কবিতাকে বিশুদ্ধ শব্দ নির্মাণ বলেন। আর কবিতার বিন্যাস যখনই পরিকল্পিত হবে তখনই প্রয়োজন হবে  ছন্দের। ছন্দ যে কবি যত বেশি জানেন তাঁর কবিতা হয় ততো মাধূর্য্যময়। ম্যাথুআর্নল্ড কবিতা সম্বন্ধে বলেনঃ Poetry is at bottom a criticism of  life under the conditions fixed for such a criticism by the laws of poetic truth and poetic beauty.

ছন্দ লয় তাল অলংকার ইত্যাদি না জেনে তা সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন না করে অধীত বিদ্যার দ্বারা কাব্যচর্চা করতে যাওয়া আত্মহত্যার শামীল। একজন প্রকৃত কবির পুঁথিগত বিদ্যা বা ব্যাকরণ সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান না থাকলে তিনি সত্যিকারের কবি হয়ে উঠতে পারবেন না। জ্ঞানার্জনের বিকল্প নেই।কবিকে নিজগুনেই বৃত্ত অতিক্রম করতে হয়। কবি মুহম্মদ নুরুল হুদার ভাষায়,"সাহিত্যকে বলা হয় সাধনা। এই সাধনা দাবী করে বসে চুড়ান্ত মনোযোগ ও নিবেদন। এখানে লেগে থাকার ব্যাপার চলে আসে।"

আর জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়েই অভিজ্ঞতার ঝুলি বাড়াতে হবে। যতো অভিজ্ঞতা ততো কবি প্রতিভার বৃদ্ধি-কবিতার গঠনমূলক বা কবিতার ভেতরকার শক্তি বৃদ্ধি পায়। অভিজ্ঞতালব্ধ কবিতাগুলো আমাদের অন্তরীক্ষে আজীবন থেকে যায়। যা মানুষের জীবনের ভাঁজে ভাঁজে কাজে আসে। অভিজ্ঞতা নিয়ে Patrick karanagh বলেন,

All we learn from experience is the way from simplicity back to simplicity.

সেসব দহনে দহিত হতে চাইলে বুঝতে হবে কবিতার ভেতরকার আর্ট। মহামনীষী এরিষ্টোটলের সমালোচনা গ্রন্থ "Poetics" এ দেখা যায় তিনি বলেছেন,

Art is an imitation of nature এবং Poetry is an imitation of art.

কবিতা লিখলেই হয় না। তাতে ভাষার নতুনত্ব থাকতে হয়। কারুকাজ থাকতে হয়। রিদম থাকতে হয়। Poetry is one kind of beauty- তাকে প্রস্ফুটিত করে তুলতে হয়। প্রকৃতির ভেতরেও লুকিয়ে থাকে কবিতার আর্ট যা আমাদের দেশের অনেক কবির কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের বুঝতে হবে যে, Everything is given by nature. আর তাই প্রকৃতি থেকে নিত্য উপাদান নিয়ে আমরা সাহিত্য লেখছি। প্রকৃতি কাউকে বিমুখ করে না। তাই William Wordsworth তার কবিতায় বলেন,

Nature never did betray.

কবিতা লিখতে গিয়ে প্রকৃতির কাছে কিছু চাইলে অবশ্যই পাওয়া যায়। তবে প্রকৃতি থেকে যা পাওয়া গেলো তাঁর একটা অংক থাকা চাই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেনঃ "Subject matter" হলো পানির মতো সেটাকে কে কী Shape দিচ্ছে । যে কেমন আকার আকৃতির পুকুর কাটছে সেটাই আমরা খেয়াল করি।আসলে সৃজনশীলতা বলতে কিছুই নেই। আছে Translation, Metamorphosis,নতুন বিন্যাস ।"

অর্থাৎ লেখাকে এমন ভাবে সাজাতে হবে যেমন জলের মতো যে পাত্রেই রাখা হোক সে অবয়ব ফিরে পায়। তাতে আর না হোক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। জলের মতো কবিতাকে ও সাহিত্যকে যে কোন স্ট্রাকচারে ফেলে নিতে হয়। প্রতারণার আশ্রয় কোনমতে নেয়া যাবে না ।

যে যাই বলুন আমি বলি কবিতা আমার মনের খোরাক । সে আমায় ভাত না দিলেও তার প্রতি গভীর ভালোবাসা। আমি তাকে একদিন চুম্বন না করে থাকতে পারি না, একটা কবিতা না লিখলে সেদিন আর ঘুম হয় না । কবিতা আমার অর্ধাঙ্গিনীর মতো হৃদয়ের কষ্ট ভুলিয়ে আলোকের সুখের সন্ধ্যান দেয়। কবিতা লিখতে হলে প্রচুর পড়তে হয়। না পড়ে আজোও কেউ ভালো কবি হতে পারেননি। কবি হতে হলে কবিতাকে ভালবাসতে হবে । বুকে ধারণ করতে হবে।আমিও কবিতার প্রেমে বড্ড বেশি অন্ধ। কবিতা লিখে লিখেই মরে যেতে চাই।