গাইবান্ধার লুৎফুর রহমান: শিক্ষক নয় যেন দেবদূত!

রিফাত কান্তি সেন
Published : 7 Nov 2016, 12:08 PM
Updated : 7 Nov 2016, 12:08 PM

গাইবান্ধার লুৎফুর রহমান মাত্র এক টাকা গুরু দক্ষিনায় সুবিধা বঞ্চিতদের শেখাচ্ছেন বর্ণমালা। একটি দৈনিক পত্রিকা পড়ে আর বেসরকারী একটি টিভি চ্যানেলে খবরটি দেখে গর্বে বুকটা ভরে গেলো। শিক্ষক জাতির মেধা গড়ার কারিগর। সেই সুনিপূণ কাজটি গত চার যুগ ধরে করে আসছেন গাইবান্ধার লুৎফুর রহমান।

চারদিকে যখন শিক্ষকদের নানা অনিয়ম আর দূর্নিতির চিত্র ফুটে উঠছে।সমাজ থেকে যখন আবেগ, ভালবাসা আর একটু সহানুভূতি ধুলিষাৎ হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন প্রদীপের আলোয় আলোকিত সমাজ গড়ে তুলছেন লুৎফুর রহমান।

গত ৪০ বছর ধরে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন গাইবান্ধার শিক্ষক লুৎফুর রহমান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অতো ভাল না হলেও তার এই মহতী উদ্যেগ সারা দেশে প্রশংসার দাবিদার। কোন স্কুলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক নন তিনি। কোন বেতনভূক্ত শিক্ষকও নন তিনি। নামে মাত্র একটি টাকা গুরু দক্ষিণা নিয়ে সন্তুষ্ট লুৎফুর রহমান।

সেই ফজরের নামাজ পড়ে হেটে, হেটে গাইবান্ধার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে চলেছেন গত ৪০ টি বছর ধরে।

১৯৫০ সালের ৭ আগস্ট গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়ায় জন্ম লুত্ফর রহমানের। বাবা ফইমুদ্দিন ব্যাপারী মারা গেছেন অনেক আগে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। ১৯৭২ সালে ফুলছড়ি উপজেলার গুণভরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৭৪ সালে নদীভাঙনে সব হারিয়ে সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের বাগুড়িয়া গ্রামের ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়ে কোনোমতে মাথাগুঁজে আছেন।

পুরো গ্রামের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষায় হাতেখড়ি হতে শুরু করে পরিবারকে শিক্ষার প্রতি অনুরাগী করতে বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছেন লুৎফুর রহমান। নিজের মাথা গুঁজার ঠাঁই না হলে ও তার অনেক শিক্ষার্থীই নাকি এখন অনেক বড় বড় চাকরি করছেন। গত ৪০ বছরে শিক্ষানুরাগী মহৎ হৃদয়ের লুৎফুর গাইবান্ধার প্রত্যান্তঞ্চলের শিশুদের জ্ঞান বিলিয়েছেন।


লুৎফুর স্যারের ছাত্র জাহেদ আলী (৪৫) জানান, ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখছেন লুত্ফর রহমান এভাবেই ছেলেমেয়েদের পড়ান। অনেকেই তাঁকে এক সময় পাগল বলে আখ্যায়িত করেছে। পরিবারে সীমাহীন অভাব। তার পরও দমে যাননি এই মানুষটি। বাগুড়িয়া, মদনেরপাড়া, পুলবন্দি, চন্দিয়া, ঢুলিপাড়া, কঞ্চিপাড়া ও পূর্বপাড়ায় এ পর্যন্ত শত শত ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছেন। তাঁর অনেক ছাত্র এখন শিক্ষক, পুলিশ, ডাক্তারসহ বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত। তথ্যটি "কালের কন্ঠ নামক পত্রিকা থেকে সংগৃহিত"।

লুৎফুর রহমান বি,এ/এম,এ / এল,এল,বি কিংবা বিবিএ/এম,বিএ ডিগ্রীর্জন না করতে পারলে ও সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তার চিন্তা,চেতনায় মানব সেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রচিত হলো। "মানুষ-মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য" এই মূলমন্ত্র জীবনে গেঁথে অবিরাম ছুটে চলেছেন লুৎফুর রহমান। ঘরে অভাব,তবু ভালবাসার কমতি নেই লুৎফুর রহমানের জীবনে।

নিজে দুবেলা, দুমুঠো খাবারের সন্ধান পেতে হুমড়ি খেলে ও অনেক সুবিধা বঞ্চিত শিশুকে শিক্ষিত করে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন তিনি। অথচ পত্রিকার পাতায় এখনো প্রাইভেট, কোচিং,ফরমফিলাপ সহ শিক্ষা বাণিজ্যের নানা চিত্র ফুটে উঠে।

আসলেই কি আমাদের মানুষিকতার পরিবর্তন ঘটেছে? আমরা কি লুৎফুর স্যারের এই মহতী উদ্যেগ থেকে কিছু শিখতে পারছি? মানব সেবায় অবদান রেখেছিলেন মাদার তেরেসা, বেগম রোকেয়া সহ নানা গুনী ব্যক্তিত্ব। কিছুদিন আগে ভারতের কৈলাস শেটি ও পাকিস্থানের মালালা শিশু শিক্ষায় অবদানের জন্য নোবেল পেয়েছিলেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে "গত চল্লিশ বছর ধরে যে মানুষটি নিজের স্বপ্ন, ভবিষৎ চিন্তা না করে অন্যের ভবিষৎ চিন্তায় মগ্ন ছিলেন তার জন্য কি সাদা মনের মানুষের একখান খেতাব এবং পুরস্কার প্রদান অতিব জরুরি নয় কি"? নোবেলজয়ীর কাতারে কি পৌছাতে পারেন নি এই মহত হৃদয়ের ব্যক্তি?

যা ই হোক লুৎফুর স্যারের কাছে অনেক শেখার আছে।লুৎফুর স্যার যুগে যুগে প্রশংসিত হবেন,জ্ঞান বিলাবেন অবহেলিত,বঞ্চিত শিশুদের মাঝে এই কামনা করছি। "হয়তোবা ইতিহাসে তোমার নাম লেখা রবে না, বড় বড় লোকেদের ভিড়ে, জ্ঞানী আর গুনীদের আসরে তোমার কথা কেউ কবে না, হে বিজয়ী বীর লুৎফুর রহমান তোমার এই ঋন কোনদিন শোধ হবে না"।