যাত্রী সংকটে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন চাঁদপুরে ডাকাতিয়ার নৌকার মাঝিরা

রিফাত কান্তি সেন
Published : 21 Jan 2017, 01:52 AM
Updated : 21 Jan 2017, 01:52 AM

'আমি নদীর এপাড়-ওপাড় দুই পাড়েই বাঁধিয়াছি ঘর, কোন পাড়েতে কে আমার আপন কে-ই বা পর।' কিংবা, 'মাঝি বাইয়া যাও রে…, অকুল দরিয়ার মাঝে আমার ভাঙ্গা নাও রে মাঝি…।'

নাও ভাঙ্গা হোক আর নতুন চাকচিক্যময় যেমনই হোক না কেন, আপন আর পর যা-ই হোক, এখন আর যাত্রী ভেরাতে পারছেন না চাঁদপুরের পাঁচ নং ঘাটের নৌকার মাঝিরা। ডাকাতিয়ার বুকেই তাদের প্রতিনিয়ত চলাচল।


এক সময় যে রুটে হাজার মানুষের যাতায়াত ছিলো, এখন সে রুটে যাত্রী খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে করে নিদারুণ কষ্টে দিন চলছে কয়েক ডজন নৌকার মাঝির।

একে তো বয়সের ভারে অনেকেরই নুইয়ে পড়েছে মাথা, তবু শিড়দাঁড়া টান করে, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাপ-দাদার আমলের পেশা আগলে রেখে বেয়ে চলেছেন নৌকার বৈঠা।


তাদের নিদারুন এ কষ্টের কথা শুনতে প্রতিবেদক নিজে হাজির হয়েছিলেন মাঝিদের নিজ গন্তব্যস্থলে। কেমন আছেন, কথাটা জিজ্ঞেস করতেই নীরব হাসির মাঝে শত বেদনা লুকানোর এক অভিপ্রয়াস লক্ষ্য করা গিয়েছে। প্রতিবেদকের কাছে, খেঁটে-খাওয়া সেসব মাঝি বললেন তাদের জীবনের গল্প-


মুসলিম পাটওয়ারী- পেশায় একজন নৌকা চালক। ৪৫ বছরের উপর নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সে কথা বলতে গিয়ে আবেগের সুরে বললেন, "আগে এক সময় নৌকার প্রচুর দাম আছিলো, অহন ব্রিজ অহনের পর আর অটো বাইক বাইর হইয়া এখন আর আমাগো নৌকায় মাইনসে ওডে না। মাইনসে ব্রিজের উপর দিয়া অটো বাইকে চইড়া পার হয় নদীর এপার থিকা ওপার!"


কথাগুলো বলতে গিয়ে বার বারই আবেগে আপ্লুত হচ্ছিলেন মুসলিম মাঝি। এক সময় প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাতশ টাকা কামানো যেতো নৌকা পারাপারে। কিন্তু এখন সে অর্থের অংকটা কমে দাঁড়িয়েছে দুইশ-আরাইশ টাকায়!

"বাপ-দাদার কর্ম, অন্য কাম পারি না তাইতো জীবিকা নির্বাহের তাগিদে আজও শত প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করে টেনে চলেছি নৌকার দাঁড়।"


৬৫ বছর বয়সী মুসলিম মাঝি মধ্যম শ্রী রামদীতে বসবাস করেন। চার ছেলে-মেয়ে, আর বউ নিয়ে তার অভাবের সংসার। রীতিমত যাত্রীর টানাপোড়নে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে নৌকা চালকরা। মুসলিম পাটওয়ারী বলেন, এক সময় আমরা ১১৩ জন মাঝি এই রুটে নৌকা চালাইতাম। ৬০-৭০ টি ছিলো ডিঙি নৌকা। আর অহন ২০ টাও নৌকা নাই! অনেকেই এই কাম ছাইড়া দিছে। বাজান অন্যকামতো পারি না! তাই এই কামও ছাড়তে পারি নাই। বউ-পোলা-মাইয়া লইয়া সংসারে আমাগো খুবই কষ্ট!


কথা হয়, শাহ-আলম ছৈয়ালের সাথে। তিনিও একজন নৌকার চালক। ডিঙ্গি নৌকা চালিয়ে তারও চলছে টানা-টানির সংসার। পাঁচ সন্তানের জনক শাহ-আলম বলেন দুই মাইয়া আমার। বিয়াও দিয়া দিছি। পোলাগো লইয়া অহন কোন রকমে খাইয়া না খাইয়া চলে আমাগো গরীবের সংসার। বিল্লাল ভূঁইয়া, নুরুল ইসলাম, মোঃআলী, সেকান্তর গাজী সহ সকল মাঝিরই একই অবস্থা।


প্রত্যেকেরই একটাই উত্তর, মনে হয় আর বেশিদিন ডিঙ্গি চালাইতে পারুম না! লোকই নাই চালামু কি। সারাদিন বইয়া থাইক্কা ঘড়ে চাল-নূন নিতে কষ্ট হয়! এইটা কিনলে ঐটা কেনা হয়না। যাত্রীরা সব অহন আধুনিকতার মারপ্যাচে অবরুদ্ধ! আমাগো খবর লয় কেডা? কথাগুলো প্রতিটি মাঝিই খুব গুরুত্ব সহকারে প্রতিবেদককে বলেছিলেন।

বুকে শত কষ্ট লুকায়িত, হাসি এখন আর সচরাচর আসতেও চায় না। প্রতিবেদকের হাতে ক্যামেরা দেখে খুব উল্লাস প্রকাশ করে বললেন, 'ছবিডা একটু ভালা কইরা উডাইয়েন, বিত্তবানরা জানুক কতডা কষ্ট আমাগো।'

আমাকে আধুনিকতা দেও, আমি তোমাদের বিশ্বায়ণ দিবো। কিংবা বায়রন এর সেই বিখ্যাত উক্তি, "সেই যথার্থ মানুষ যে জীবনের পরিবর্তন দেখেছে এবং পরিবর্তনের সাথে নিজেও পরিবর্তিত হয়েছে।" জীবনের পরিবর্তনটা এই মাঝিগুলো দেখলেও নিজেদের পরিবর্তিত করতে পারেন নি। কেন না এদের বেশিরভাগেরই এখন বয়স বৃদ্ধের কোটায়! জীবন যুদ্ধে এদের কর্ম শুধু ডিঙ্গি নৌকা চালানো। অন্যকোন কর্ম জানেন না বলে এই দুর্দিনেও কর্মটাকে ছেড়ে দিতে চান না মুসলিম, সেকান্তর, নূরুল, শাহ-আলম সহ বেশ কজন নৌকার মাঝি।

আমাদের বিশ্বাস একদিন এসব ভূক্তভোগী মানুষের জীবনের চাকা আবার সচল হবে, হয়তো প্রশাসনের উদ্যেগে নতুন কোন কর্মের সন্ধান খুঁজে পাবেন তারা এটাই বিশ্বাস। চাঁদপুরের পাঁচ নং গুদারা ঘাট থেকে ফিরে রিফাত কান্তি সেন।