ঘুরে আসুন কুমিল্লার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোতে

রিফাত কান্তি সেন
Published : 4 Sept 2017, 06:45 AM
Updated : 4 Sept 2017, 06:45 AM


ইট-পাথরের দেয়ালে ঘেরা আমাদের শহুরে জীবন। অতিরিক্ত কর্ম চাপে মনে বাসা বাঁধে বিষন্নতা। সেই বিষন্নতাকে দূর করতে ভ্রমণের বিকল্প নেই। আর সেই ভ্রমণটা যদি হয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কেন্দ্রগুলোতে, তাহলে তো কথাই নেই। দিনদিনই আমরা যান্ত্রিক মানব হিসেবে সমাজে বেড়ে উঠছি। দুশ্চিন্তার কারণে মনে বাসা বাঁধছে বিভিন্ন মানসিক রোগ। আর এসব রোগের একটি ঔষধ; যা হলো ভ্রমণ।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে ভরপুর আমাদের দেশ। দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে অসংখ্য প্রত্নতাত্তিক স্থাপত্যশৈলি। আমরা আজ কুমিল্লার কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এর সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিবো। কুমিল্লা– কোটবাড়ি রোডে বার্ড এবং বিজিবি গেটের মাঝখানে রয়েছে তিনটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন– লতিকোট মুড়া, ইটাখোলা মুড়া ও রূপবান মুড়া। এছাড়া রয়েছে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহ, দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলি ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার। দৃষ্টিনন্দন এসব স্থাপত্যশৈলি দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ভীড় জমান স্থানগুলোতে।


ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার :

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের এক মহিমা-মন্ডিত নাম কুমিল্লার ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার বা শালবন বিহার। বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন গুলোর মধ্যে অন্যতম কুমিল্লার বৌদ্ধ বিহার। পূর্বে এ প্রত্নতত্ত্বটি শালবন "রাজার বাড়ি" নামে পরিচিত ছিলো। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ উম্মোচিত হওয়ায় একে "শালবন বিহার" নামে আখ্যয়িত করা হয়। এর আসল নাম ছিলো "ভবদেব মহাবিহার"। খ্রিস্ট্রিয় সাত শতকের মধ্যভাগ হতে আট শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত দেব বংশের শাসকগণ এই অঞ্চল শাসন করেন। উক্ত বংশের চতুর্থ রাজা ভবদেব কর্তৃক এই মহাবিহার নির্মিত হয়। বর্গাকার বিহারটির প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ৫৫০ ফুট। চার বাহুতে সর্বমোট ১১৫ টি সন্ন্যাস কক্ষ, মধ্যভাগে একটি উন্নত বৌদ্ধ মন্দির এবং মূল মন্দিরের চারপাশে ছোট ছোট ১২ টি মন্দির ও ৮ টি স্তুপ উন্মোচিত হয়েছে। বিহারের মূল ফটকের পূর্বপাশে খননের ফলে একটি প্রাচীন কূপের কাঠামো উন্মোচিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, তৎকালীন বৌদ্ধ শাসকগোষ্ঠী এ কূপের পানি আহরণের মাধ্যমে যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করতেন।

মন্দির ও মন্দিরের আশেপাশে কয়েক দফা প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পোড়ামাটির ফলক, ব্রোঞ্জের মূর্তি, নকশাকৃত ইট ও মুদ্রাসহ বিভিন্ন মূল্যবান প্রত্নতত্ত্ব পাওয়া গিয়েছে। খননের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ প্রত্নতত্ত্ব পাওয়া গিয়েছে তা পার্শবর্তী জাদুঘরে সঞ্চিত রয়েছে। পুরো বিহারটিতে রয়েছে অসংখ্য ফুল গাছ। দেশী-বিদেশী ফুলের সৌন্দর্য যা ভ্রমণ পিয়সী মানুষদের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়।

বিহারে প্রবেশ মূল্য: দেশী পর্যটকদের জন্য ২০ টাকা, শিক্ষার্থীদের জন্য ৫ টাকা এবং বিদেশী পর্যটকদের জন্য ২০০ টাকা।

রূপবান মুড়া ময়নামতীর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল।

রূপবান মুড়া:

কুমিল্লার যতগুলো প্রত্নতত্ত্ব রয়েছে তার মাঝে অন্যতম এটি। তবে লোকমুখে খুব একটা প্রচলন না থাকায় এ প্রত্নতত্ত্বটির সন্ধান অনেক ভ্রমণ পিয়সী পর্যটকের কানে পৌঁছায়নি।

কুমিল্লা-কালীর বাজার সড়কের দক্ষিণে বর্তমান বার্ড এবং বিজিবি স্থাপনার মাঝখানে একটি টিলার উপর এ মুড়া অবস্থিত। পাহাড়ে উঠার মতই উঁচু পথ পাড়ি দিয়ে উঠতে হয় রূপবান মুড়াতে। দর্শনার্থীদের জন্য সুখবর হলো এখানে প্রবেশ করতে কোন ফি লাগে না। খনন কাজের পর এখানে মাঝারি আকারের (পূর্ব-পশ্চিমে ২৮.২ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ২৮ মিটার) প্রায় ক্রুশাকৃতি একটি আকর্ষণীয় সমাধিমন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে। এর সাথে আরও পাওয়া গেছে অষ্টাকোণাকৃতি স্তুপ এবং বর্গাকৃতির ভিতের উপর আর একটি স্তুপসহ বেশ সংখ্যক সাহায্য কাঠামোসমূহ।

আয়তাকার স্তুপ অঙ্গনের মধ্যে প্রাচীর দেওয়াল এগুলিকে বেষ্টন করে রেখেছে। প্রথানুযায়ী পূর্বদিকে প্রবেশপথ আছে এবং এর সম্মুখে আছে মঠের প্রবেশদ্বার। গভীর খননকার্যের ফলে দেখা যায় যে এর নির্মাণ, সংস্কার ও পুনঃনির্মাণের তিনটি স্তর আছে। প্রাচীনতম স্তরটি ছিল ছয়-সাত শতকে।


লতিকোট মুড়া:

স্থানীয়ভাবে এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাটি লতিকোট মুড়া নামে পরিচিত, কিন্তু খনেনর ফলে এখানে ৩৩টি ভিক্ষুকক্ষ বিশিষ্ট ৪৭.২৪মি ঢ ৪৪.৮০ মি পরিমাপের একটি বৌদ্ধ বিহারের বীত নকশা উম্মোচিত হয়। ফলে উহাকে বর্তমানে লতিকোট বিহার নামে অবিহিত করা হয়। বিহারটিতে দুইটি নির্মাণ যুগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় নির্মাণ যুগে পূর্ব বাহুর মাঝামাঝি স্থানে একটি মন্ডপ নির্মাণ করা হয়। বিহার প্রবেশের প্রধান তোরণ উত্তর দিকে ছিল। এটিতে প্রবেশে কোন মূল্যেও প্রয়োজন হয় না। দর্শনীয় স্থানটি দেখতে এখানে অনেকেই ছুটে আসেন। তবে ভ্রমণ পিয়সী মানুষদের অনেকের কাছেই স্থানটি অচেনা।

ইটাখোলা মুড়া:

কুমিল্লা জেলার আরেকটি দর্শণীয় স্থান ইটাখোলা মুড়া। এটি কুমিল্লা সদর হতে পশ্চিম দিকে ৮ কি মি দূরে কোটবাড়ি সড়কের ওপারে, রূপবান মুড়ার উল্টোদিকে অবস্থিত। অনেকেই মনে করেন একসময় উক্ত স্থানটি ইট পোড়ানোর খনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর এজন্যই উক্ত স্থানটির নাম ইটা খোলা মুড়া করা হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

স্থাপত্যশৈলিটিতে প্রবেশ করতে কোন প্রবেশ মূল্য নেই। যে কোন বয়সের নাগরিক প্রবেশ করতে পারে ইটাখোলা মুড়াটিতে।

.


কিভাবে যাবেন কুমিল্লার এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোতে:

ঢাকা থেকে বাসে আসলে নামতে হবে কোটবাড়ি চৌরাস্তায়। সেখান থেকে সিএনজি বা অটোযোগে সোজা পৌঁছে যেতে পারেন রুপবান মুড়া, লতিকোট মুড়া, ইটাখোলা মুড়া এবং ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার। সিএনজি/ অটো ভাড়া জনপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে।

চাঁদপুর থেকে আসা দর্শনার্থীদের জন্য প্রথমেই যেতে হবে কুমিল্লা কান্দির পাড়। সেখান থেকে সিএনজি যোগে কোর্টবাড়ি চৌড়াস্তা। তা-ও জনপ্রতি ভাড়া ২০ থেকে ৩০ টাকা। সেখান থেকে নেমে ফুট ওভার ব্রিজ পার হয়ে সোজা বৌদ্ধ বিহারের অটো- সিএনজি যোগে বৌদ্ধ বিহারে। ভাড়া ২০ থেকে ৩০ টাকা।

যানবাহন অটো- সিএনজি। দর্শনার্থীদের জন্য বিহারটির প্রবেশ মূল্য সাইনবোর্ড আকারে টানানো রয়েছে।