ভয়াল পঁচিশের অল্প স্বল্প!

রীতা রায় মিঠু
Published : 25 March 2012, 04:01 AM
Updated : 25 March 2012, 04:01 AM

আমার শৈশব কেটেছে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে। আমরা '৭০ সাল পর্যন্ত ছিলাম নগর খানপুর এলাকাতে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আমার বাবা 'ফিনলে কোম্পানীতে' চাকুরী করেছেন। বাবা যতদিন ঐ কোম্পানিতে চাকুরী করেছেন, ততদিন আমরা কোম্পানির কোয়ার্টারে থেকেছি। কিনতু ১৯৭০ সালের দিকে তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমনই উত্তাল ছিল যে কোম্পাণীর সাহেব সুবোরা পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে যায়। ফলে আমরা কোম্পানির কোয়ার্টার ছেড়ে চলে এসেছিলাম নারায়ণগঞ্জের আমলাপাড়াতে। আমলাপাড়াতে আসার আগে পর্যন্ত '৬৯-'৭০ এর দিকে যত হরতাল, কার্ফু, নৌকা নিয়ে মিছিল, মশাল মিছিল হতো, তার প্রতিটি ঘটনা আমার মনে আছে।

আমি '৬৯-'৭০ এর দিকে খুবই ছোট ছিলাম। আমরা ছিলাম চার ভাই-বোন। আমার ছোট ভাইটা ছোট্ট ছিল বলে তখনকার ঘটনা ওর মনে নেই। তবে আমার কথা আলাদা, আমার পরিবারের সকলেই জানে, আমার স্মৃতিশক্তি খুবই ভালো। আমার দুই আড়াই বছর বয়সের দুই একটা ঘটনাও মনে আছে। নগর খানপুরে আমাদের কোয়ার্টারগুলো ছিলো একেবারে রাস্তার উপর। তাই সমস্ত মিছিল আমাদের বাড়ীর সামনে দিয়েই যেতো। ঐ সমস্ত দিনের বর্ণণা অন্য কোথাও লিখব। এই মুহূর্তে শুধু ২৫শে মার্চ রাতের ঘটনা যতটুকু মনে আছে, তাই বলি। (আমি খুব ভুল করেছি, আমার মায়ের বয়স যখন আরও কম ছিল, আমার মায়ের কাছ থেকে সমস্ত ঘটনা লিখে রাখা উচিত ছিল। এখন সেটা অনেক কঠিন হয়ে গেছে, আমার দারুন স্মৃতিশক্তির অধিকারী মায়ের স্মৃতিগুলো খুবই দূর্বল হয়ে গেছে, কিছু মনে পড়েনা সহজে)।

আমলাপাড়ার বাড়ীটাতে কমপক্ষে ১৪/১৫ ঘর ভাড়াটিয়া ছিল। সকলের ছিল টিনের ঘর। শুধু আমরাই থাকতাম নতুন তৈরী পাকা দালানে। আমার বয়স তখনও ছয় পূর্ণ হতে দেরী ছিল। সময়টা খুব খারাপ থাকাতে আমরা সবসময় খাওয়া দাওয়া, উঠা বসা মোটামুটি একসাথেই করতাম। বলে রাখা ভালো, 'সময় খারাপ ছিল' বোধটা আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে ছিলনা। আমাদের কাছে সব কিছু আগাগোড়া খুবই উত্তেজনাকর খেলা খেলা ব্যাপার ছিল। আমাদের দাদু-দিদিমাও থাকতেন আমাদের কাছাকাছি। ফলে পাড়াপ্রতিবেশীর ছেলেমেয়েরা, আমাদের মামা মাসীসহ সকলেই পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একধরনের নাটকীয়তা খুঁজে বেড়াতো। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণও ছিল এক ধরনের আনন্দ উত্তেজনার বিষয়। সকাল থেকেই বাবা এবং বড়দের মুখে শুনছিলাম যে সেদিনই একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাওয়ার কথা। আমার মা চাল, ডাল, কেরোসিন স্টক করতে শুরু করেছিলেন। আমার মা যে স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন, সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন নেত্রী মিসেস হেনা দাস। ফলে আমার মা স্কুল থেকেও অনেক কথা শুনে আসতেন। মিসেস হেনা দাসের কাছে অনেক আগাম তথ্য চলে আসতো।

২৫শে মার্চের রাতে আমরা সবাই একসাথে খেতে বসেছিলাম। আমার মনে পড়ছে, কিছু একটা নিয়ে আমি বোধ হয় একটু ঘ্যান ঘ্যান করেছিলাম, আমাকে কিছু একটা বলে বুঝাচ্ছিল মা। হঠাৎ করে বাইরে হৈ চৈ শোনা যেতে লাগলো। আমাদের প্রতিবেশী এক তরুণ, 'পরেশ দাদা' বাইরে থেকে চীৎকার করছিলো আমার বাবাকে ডেকে, ' মেসোমশাই শিগগীর লাইট অফ করেন, লাইট অফ করেন, ঢাকাতে তুমুল গন্ডগোল শুরু হইছে। ইয়াহিয়া আর্মি নামাইছে। মিলিটারী গুল্লী করতেছে। সব অন্ধকার কইরা দেন। পাইক্কাগো হাত থিকা আজকে আর বাঁচন লাগবোনা"। আমার বাবা খাওয়া ফেলে দৌড়ে বারান্দায় চলে গিয়ে আরও বেশী জোরে চেঁচাতে শুরু করেছিলো, ' কি কও, হায় হায়! যুদ্ধ শুরু হইয়া গেল তাইলে, গুলীগোলা শুরু হইয়া গেছে?"। চেঁচামেচীর এক ফাঁকে আমরা খুব উৎসাহের চোটে লাইট নিভাতে শুরু করেছিলাম। কেরোসিন তেলের কুপী জালিয়ে আমার ঠাকুমা আমাদেরকে একটা জায়গাতে বসিয়ে রেখে দেখি ঠাকুরের নাম জপ করতে শুরু করেছে। আমি সবই লক্ষ্য করছিলাম, আবার আমার পিঠোপিঠি যে ভাই, তার সাথে আগড়ম বাগড়ম গল্পও করছিলাম। বেশীর ভাগই মিলিটারী সংক্রান্ত গল্প। আর আমার মা একটু পর পর আমাদের দিকে চোখ গোল গোল করে ধমক দিচ্ছিল যেনো একেবারে চুপ করে বসে থাকি। আর আমার বাবা সব সময়ই একটু বেশী সাহস দেখাতেন বলেই কিনা জানিনা, এমন ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যেও প্রতিবেশী ছেলেদের সাথে কথা বলছিলেন তো বলছিলেনই।

এর মধ্যেই আমরা ভাইবোনেরা খেয়াল করলাম, আমাদের নিত্যসঙ্গী দুই মাসী টিনের ঘরে আছে দাদু দিদিমার সাথে। ব্যস, বাচ্চাদের কান্ড, শুরু হয়ে গেলো কান্নাকাটি, "ওদেরকে নিয়ে আসো আমাদের দালানের ঘরে। গুল্লী ওদের ঘরে ঢুকে যাবে, আমাদের দালানে নিয়ে আসো'। এসেছিলো, মাসী দুটো আর দাদু-দিদিমা টিনের ঘর ছেড়ে আমাদের পাকা ঘরে এসে উঠেছে। আমার দাদু পেশাতে উকিল ছিলেন, কিনতু খুব ভীতু প্রকৃতির ছিলেন। উনি একটা কান্ড করেছিলেন, আমাদের চার ভাই-বোন ও নিজের দুই মেয়েকে নিয়ে খাটের নীচে ঢুকে গেছিলেন। আমরাতো খুবই উৎসাহে খাটের নীচে শুয়ে মিলিটারী মিলিটারি খেলা করছিলাম। ঐ রাতে কেউ ঘুমায়নি। বড়রা গুনেছে প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি মুহূর্ত, কখন সকাল হবে। যেনো সকাল হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিনতু সকাল হতেও কিছুই ঠিক হয়নি। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব ৯/১০ মাইলের বেশী হবেনা। ২৫শে মার্চের কালরাত্রির যে সাইক্লোন ঢাকাবাসীর উপর বয়ে গেছিল, তার ঝাপটা নারায়নগঞ্জেও লেগেছিল বইকি! পরের দিন সকালে আমাদের কারো মুখে কোন আওয়াজ বের হয়নি। আমরা অশনিসংকেত টের পেয়েছিলাম। খুব সকালে আমার বাবা পরিস্থিতি আঁচ করার জন্য 'চারার গোপ' গিয়েছিল, বাবার আয়ুর জোর খুব বেশী, বাবার ভাষ্যমতে ফুটফাট যে গোলাগুলী তখনও হচ্ছিল, তারই একটা আমার বাবার মাথার বাম পাশ ঘেঁষে চলে গেছে। আমার বাবা প্রথম ভয় পেলো সেই সকালে। সাথে সাথে বাড়ী ফিরে এসেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, কার্ফু উঠে গেলেই আমাদের ভাইবোনদেরকে দাদুর সাথে গ্রামে পাঠিয়ে দিবে। সত্যি কথা যদি বলি, আমার এখনও যতটুকু মনে পড়ছে, বড়রা যখন প্ল্যান করছিল সবাইকে গ্রামের দিকে কোথাও পাঠানোর কথা, আমরা বাচ্চারা খুব খুশী হয়েছিলাম যদিও চেহারাতে ফুটানোর চেষ্টা করছিলাম যে আমরা খুব ভয় পেয়েছি।

[আমি লেখাটিতে শুধুমাত্র একটি ৫/৬ বছর বয়সী শিশুর তখনকার মানসিক অবস্থা টুকুই বলে গেছি। শিশুরাতো এমনই হয়। যে সময়টাতে শিশুদের খেলাধূলা করার কথা, সে সময়ে বড়রা যদি যুদ্ধ বাঁধিয়ে বসে থাকে, শিশুদের চোখেতো সেই আসল ভয়াবহ যুদ্ধটাও একটা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা মনে হওয়া স্বাভাবিক। শিশু্দের কোন ভয়ঙ্করের সাথে পরিচয় থাকেনা বলেই আমিও প্রথমদিকে যুদ্ধের ভয়ঙ্করতা বুঝিনি।]।