এ জার্নি টু তামিলনাড়ু

রবি হোসাইন
Published : 7 April 2017, 03:37 AM
Updated : 7 April 2017, 03:37 AM

কলকাতার বাইরে বলতে ওই নদীয়া হয়ে মুর্শিদাবাদ অবধি গেছি। তাও কলকাতা ভাল করে দেখা হয়নি। কাজের উপর থাকাতে নেমে দেখা হয়নি ব্রিটিশ কলকাতার কত স্থাপত্য। এ যেন সৌন্দর্য ফুরিয়ে যাবার ভয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা ধুলোর দেয়াল ছুয়েঁ না দেখার মত ব্যাপার। ব্যস্ততার অজুহাতে তুলে রাখা। অবশ্য মানুষ হলে অভিযোগ করে বসতো। ব্যস্ততার বাহানায় অবহেলার অভিযোগ।

লিপি আপুর সাথে যাব ভেলোর। আপুর ক্যান্সারের রেগুলার চেকআপের জন্যে যাওয়া । দুই দিন আগে টিকেট করেছিরেন ‍সন্দ্বীপ দাদা। সন্দ্বীপ দাদা থাকেন নদীয়ার কল্যাণীতে। পরিচয় হয়েছিল ফেসবুকে। টিকেট নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। যদি আবার গিয়ে একদিন থাকতে হয় টিকেটের জন্যে। কাঞ্চনদা বলছিল তৎকাল টিকেট নিতে হবে। ভেবেছি, যখন যাবে তখন টিকেট নিবে ব্যাপারটাকে ততকাল বলছে কেন। পরে জানলাম, ততকাল নামে একটি ব্যবস্থা আছে। ট্রেন ছাড়ার আগের দিন টিকেট ছাড়ে। এই ততকালে টিকেট দেয়া হয় ট্রেন ছাড়ার ২৪ ঘন্টা আগে সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত।

তবে বিদেশিদের জন্যে আলাদা একটা সুবিধাও রেখেছে ভারতীয় রেলওয়ে। আলাদা কিছু সিট রাখা আছে বিদেশীদের জন্য। এটার জন্যে যেতে হবে ফেয়ারলি প্লেসে। নিউ মার্কেট থেকে কোন অটোকে বললেই নিয়ে যাব। ক্যান্সার রোগীদের জন্য এবং তার এটেন্ডেট (সাথে থাকবেন যে যিনি) এর জন্য টিকেটে ছাড় আছে ।

যদি এভাবেও না হয় নিউ মার্কেটের আশে পাশের এলাকা বা ঢাকার বাসগুলো যেখানে থামে সেখানে অর্থাৎ মার্কুইস স্ট্রিটে এজেন্ট এর দোকান পেয়ে যাবেন যাদের কাছে টিকেট পাওয়া যাবে। এরা টিকেট প্রতি ২০০ থেকে ৭০০ রুপি পর্যন্ত সার্ভিচ চার্জ নেবে । হাওড়া স্টেশনের বাইরেও এজেন্ট আছে। শুধু রেগুলার দাম থেকে কিছু টাকা বেশি নিবে এই যা। তাই টিকেটের দুশ্চিন্তা অতো না।

কলকাতার বাইরে চিকিৎসার জন্যে গেলেই সেটা মুম্বাই না হলে অবশ্যই চেন্নাই এরকম একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল। সিএমসি নামের সাথে চেন্নাই অনেকবার শুনেছি। শ্রী নারায়ণী হাসাপাতাল ও শুনেছি। যখন সন্ধীপ দাদা বললেন, আমাদের চেন্নাই যেতেই হবে না বোকা হয়ে গেলাম। এত দিন তাহলে জানি? পরে গুগলে দেখলাম অর্জিত জ্ঞান পুরো্টাই তো মাটি। চেন্নাই হলো তামিলনাড়ুর রাজধানী আর সিএমসি হলো ভেলোরে যেটা তামিলনাড়ুর আরেকটা শহর। আর এতদিন আমি ভাবতাম চেন্নাই একটা প্রদেশ আর তামিলনাড়ু আলাদা প্রদেশ। জ্ঞানের দৌরাত্ম্য অতি ক্ষুদ্র না হেসে ফেলার বুঝতে পারছি না্।

ভেলোরে কোন বিমানবন্দর নেই বলে যেতে হয় ঢাকা থেকে চেন্নাই হয়ে বিমানে। চেন্নাই থেকে আবার যেতে হবে বাস কিংবা ট্রেনে। ঢাকা থেকে চেন্নাই সপ্তাহে চার টি প্লেন যাওয়া আসা করে এবং সময় লাগে ২ঘন্টা ৩৫ মিনিটের মত । চেন্নাই থেকে ভেলোরের দূরত প্রায় ১৩৩ কি.মি।

দাদা বললেন কাঠপাঠি নামতে হবে। ট্রেনে তুলে দিলেন আমাদের। অবশ্য তুলে না দিলে উঠার উপায় ছিল না। হাওড়া স্টেশনে ২৩টি প্লাটফর্ম আছে আমি কোনটা করে যাব সেটা বুঝতেই ট্রেন ভেলোর চলে যেত।

ভারতে এক্সপ্রেস ট্রেনে কেমন জানতাম না। আমাদের ছিল নন এসি সিট। প্রতি সিটের উপর আরো দুজন। একজন সবার উপরে। মাঝখানে একজন আর নীচে একজন। এই মাঝখানের জন আর নীচের জনের মধ্যে বোঝাপরা করেই যেতে হয়য়। যার যখন ঘুমোতে ইচ্ছে করবে অন্য জনকে বলবে অথবা একসাথে বসে যাবে।

আমার সামনেই ছিলেন মানস দাদা উনার বাড়ি কলকাতায়। পেশায় স্কুল শিক্ষক। দাদা গেছেন শ্বাশুড়ির চিকিৎসার জন্যে। দরজার পাশে উপর নিচ যে দুই সিট থাকে সেখানে একটা সিট লিপি আপার আর নিচে ছিলেন সাবির দাদা যাচ্ছিলেন কেরেলা। সাবির দাদা বাড়ি মুর্শিদাবাদ। কলকাতা থেকে ট্রেন যাচ্ছে সেখানে বাঙালি থাকবেনা আর তাদের সাথে আলাপ জুড়ে দিব না তা তো হয় না। সাবিরদাকেই বেশি বিরক্ত করে ছাড়লাম কেরেলার জীবনালাপ নিয়ে। কথা বলতে বলতে রাত হয়ে গেছে। রাতের খাবার খেতে হবে।

মাঝখানে একবার টিকেট চেক হলো। টিকেট চেক মানে চেকই। কোন কালোবাজারির সুযোগ নেই। আমার পাসপোর্ট, ভিসার কপির সাথে টিকেটে থাকা ঠিকানা মিলিয়ে নিল। সাধু অন্যের টিকেট চওড়া দামে কিনে তো পার পাবেই না নিজে টিকেট কিনেও যদি ডকুমেন্ট দেখাতে না পারো পার পাওয়া যাবে না।

ট্রেনে খাবার অর্ডার নিতে আসল। কলকাতার হোটেল হলে মাছ ভাত অর্ডার করে দেয়ার অভ্যাস থেকেই মাছ ভাত চেয়েও পেলাম না। ডিম ভাত দিল। এর আগে কেউ ট্রেনের খাবারের ব্যাপারে সতর্ক করেনি। খাবার স্বাদ ছিল কি না ছিল খেয়াল ছিল না। ক্ষিধেয় গিলে নিলাম বলা যায়। দক্ষিণ ভারতের খাবারে বিশাল এক মহিমা হলো টক।

হাওড়া থেকে উঠার আগে যাত্রীদের নামের তালিকা টাঙিয়ে দেয়। সাথে কে কোথা থেকে উঠবে সেটাও। সবার উপরের সিটে চলে গেলাম যেহেতু জানতাম রাত ১১ টার আগে এই সিটের যে আছে সে ‍উঠবে না। বাংলার শেষ প্রান্ত খড়্গপুর থেকে চার জন উঠার কথা আছে। বাইরে ততক্ষণে অন্ধকার। কিছু দেখার সুযোগ নেই। ওদিকে নন এসি ট্রেন বলে কোন বালিশ কাথাঁর ও ব্যবস্থা নেই। নিউ মার্কেট থেকে কেনা কম্বল আর ব্যাগ মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে পরেছি সেদিন।

রাত ১টার দিকে একবার ঘুম ভাঙার পর দেখি অন্য সিটগুলো তখনো খালি। ওরা বুঝি উঠেনি। ২ টার দিকে আওয়াজ শুনে আবার ঘুম ভেঙে গেল। মেয়ে চারজন এসে হাজির। আমাকে একজন বলছে, ইয়ে মেরা সিট হে। আমি পরম আনন্দিত। আমার হিন্দি জ্ঞানের চর্চা করার একটা ক্ষেত্র পেয়েছি বটে। তাদের বুঝিয়ে উপরের সিটটা আমার করে নিলাম।

পরদিন ঘুম ভাঙল বেলা করেই। বের হয়েই দেখি বিশাখপাটনাম স্টেশন। আহা এই সেই বিশাখাপাটনাম যাকে আমি নিয়মিত দেখি! জানতাম আর অল্প গেলেই ভাইজাগ সিটি যেখানে সাগর আর পাহাাড় নিজেদের ছুয়েঁ গেছে। পাহাড় যতবার কাছে আসছির ইচ্ছে করছিল নেমে পরি। কুয়াশা ভেঙে পাহাড় চুড়ো থেকে দেখি বঙ্গোপসাগর। হয়ত আরব সাগর ও দেখা যেতে পারে। মন্দ কি। যাওয়া না গেলেও ট্রেন নিশ্চয় ভাইজাগ হয়ে যাবে ভেলোর এটা ভেবে তো মহাখুশি। মন খারাপ করে দিলেন সাবির দা। ট্রেন যাবে এবার উল্টোদিকে। মানে ওদিকে আর ভেলোরের রুট না।

কি আর করা! মন খারাপের শুরু। ট্রেন তখন অন্ধ্রপ্রদেশে। পাহাড়ের পর পাহাড় যেন শেষ হতেই চায় না। আলোছায়ার পুকুর পাড়, কৃষাণির ব্যস্ততা, চারা বোনা থেকে শুরু করে পুকুর ঘাটে বাড়ির মেয়েদের একসাথে গোসলে নামা আর চারপাশের সবুজ সব মিলিয়ে যেন এক খণ্ড বাংলা। এককালে বাংলায় গোলাভরা ধান আর গোয়ালভরা গরু আর পুকুর ভর্তি মাছের যে বর্ণনা পেয়েছি ঠিক সেরকমই অন্ধ্রপ্রদেশের ওই দিকটা। একে তো মন খারাপ এর ‍উপর রাগ হচ্ছিল কবি সকলের উপর। কেন যেন আমার মনে একটা ধারণা ঢুকে গিয়েছিল বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গ যেরকম সেরকম আার কোন এলাকায় হতে পারে না।ওরকম ধানক্ষেত বা সবুজ শ্যামলিমা শুধু বাংলারই হতে পারে। কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশ তো খাঁটিঁ বাংলা। তাদের ভাষা তেলেগু এই যা।


অন্ধ্রপ্রদেশের প্রকৃতি

বাংলা অঞ্চলের সংজ্ঞাটা কি জানি না। মুর্শিদাবাদ থেকে নদীয়া হয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ বা বাংলাদেশের প্রকৃতি আমার কাছে সবটাই একি লেগেছে। এ আমার সেই জ্ঞানের অভাবে হতে পারে অথবা সেই মন খারাপের জন্যেও হতে পারে। এসব ভাবতে ভাবতে গরমের ‍উত্তাপ টের পেলাম। বাতাসে গরমের ছোঁয়া শিরোনামে একটা কবিতা লিখে ফেলা যেত অত বিরক্তিকর অনুভূতি ছিল গরমে। পথ যেন তখন আর ফুরোতেই চায় না। মাঝে মাঝে বিশাল বিশাল নদী পরছিল। নাম তো জানি না কোনটারই। শুধু দেখেই মুগ্ধ। এ পাড় ও পাড় দেখা যায় না। নদীর সবুজ পানিতে রোদ পরার পর যে রূপ তৈরি হয় সেটা অবশ্য আমার বাংলার মত না।

মেয়েগুলো নেমে গেছে নেলোর স্টেশনে সেটা সেই সন্ধ্যের আগে। সেই উড়িষ্যা থেকে এত দূর এসেছে নাকি চাকরির পরীক্ষা দিতে। কত বিচিত্র দেশটা। দুপুরের দিকে ওরা গান শুনছিল। হিন্দির মাঝখানে 'এক জীবনে' গানটা বেজে ‍উঠল। বললাম, বাংলাদেশর গান শোনো? পরে না বুঝলাম ওরা বাংলা গান তো শুনেই বাংলা ভাষাও বোঝে।

ওর মধ্যে দুপুরের খাবার খেয়েছি। ওটাকে খাওয়া বলে না। নতুন কোন নাম দিতে হবে। টকের জন্যে ওই খাবার নাকের কাছে আনাই কঠিন। নিজেকেই বকেছি। রবি, সব জাতের সব পাতের খাবার যদি খেতেই না পারো কেমন মানুষ আর হলে? কি করে ঘুরে বেড়াবে পুরোটা ভারত। এই ধমকে যতটা সম্ভব গিলে নিয়েছি আবার।

সেই রাত আটটায় নামার কথা কাঠপাডিতে।কিন্তু ট্রেন লেট থাকার কারণে ৮টা হয়ে গেছে সাড়ে ১১টা। ভারতের এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো কত দূর এলো বা কত লেট করছে সেটা চেক করার সিস্টেম আ্ছে। গুগলে train status লিখে সার্চ করে ট্রেন নাম্বারটি দিলেই আপনার ট্রেন কতটা এসেছে বা কত সময় লেট আছে দেখা যাবে।

কাঠপাডিতে নামার পর সাবির দা চলে যাবেন। আমরা তিন জনের যেতে হবে সিএমসিতে। স্টেশন থেকে বের হতেই ইয়া হোমড়াচোমড়া গোফওয়ালা অটোওয়ালার দল হাজির। যেন সাক্ষাৎ তামিল ছবির ভিলেন নেমে এসেছে। মানসদাই কথা বলে নিলাম। চললাম সিএমসির দিকে। কাটপাটি স্টেশন থেকে সিএমসি হাসপাতালের দূরত্ব মাত্র ছয় কিলোমিটার। আহা কলকাতা থেকে ১৭৫০ কিলোমিটার দূরে মানে যেতে আবার সেই ৩২ ঘণ্টার কাছাকাছি।

কিছু ট্রেন আবার কাটপাটি অবধি যায়না। চেন্নাই চলে যায় সেক্ষেত্রে চেন্নাই সেন্ট্রাল হবে। আবার কিছু ট্রেন চেন্নাই এগমোর স্টেশনে নামিয়ে দেবে । সেখান থেকে বাসে কিংবা ট্রেনেও ভেলোর আসা যায় । অবশ্য খরচ কমাতে হলে ধরতে হবে ট্রেন।চেন্নাই এগমোর স্টেশন থেকে চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশনে বাসে এসে এবার চেন্নাই সেন্ট্রাল থেকে কাটপাটি পর্যন্ত ট্রেনের টিকেট করে আসতে হবে ভেলোর। তবে প্রায় বেশিরভাগ ট্রেনই কাটপাটি হয়ে যায়।

লিপি আপুর পরিচিত হোটেল ছিল। ওখানেই উঠেছি রাতে। কাটপাটিতে হোটেল/লজের ভাড়া কম ই মনে হলো। ১৫০ থেকে শুরু করে হাজার ও হতে পারে। আবার নিজেরা চাইলে রান্নাও করা যায়। পরদিন ভোরে আপু নিয়ে গেলন হাসপাতালে দেখাাতে। হাসপাতাল না যেন মানবসমুদ্র। দুপুরে পেয়ে গেছি বাঙালি হোটেল। আহা খাবার। ট্রেনের সেই টক খাবারকে ততক্ষণে বিদায় সে বিকেল আর রাতটা গেছে ঘুমিয়েই।


ভেলোরে লিপি আপার সাথে

ওদিন আপুকে ডাক্তার দেখানোর ডেট ছিল। আপুর সাথে হাসপাতালে। এই সিএমসি আর সেই খরগোশ আর কচ্ছপের গল্প যেন একি। ডাক্তার রোগীর সাথে কথা বলবেন সেই দুইটার দিকে। তার জন্যে রিপোর্টিং করতে যেতে হবে ভোর ৬ টায়। টেস্ট এর টাকা জমা দিতে গেলে সামনে পরবে ২০০ জন আবার টেস্ট করতে গেলে সেখানেও আবার লাইন। তবে এত ধীরে চলার পর ও কচ্ছপ যেমন রেস জিতে নিয়েছিল তেমনি লিপি আপু ও ক্যান্সার জিতে নিলেন। সিএমসির এই নির্ভরতার কারণে ভারতের প্রায় সব প্রদেশ থেকে শুরু করে পাশ্ববর্তী সবকটা দেশ থেকেই রোগী আসছে সিএমসিতে। কি অপার নির্ভরতা।

লিপি আপাকে প্রথমবার প্রাইভেটে দেখানোর খরচ পরেছে ৬৫০ টাকা সেটা দ্বিতীয়বার লাগে ৫৫০ টাকা। তবে জেনারেলে দেখাতে গেলে ১৫০ টাকাতে দেখানো যায় তবে এত সময় বেশি লেগে যায় যেখানে প্রাইভেটে দু-তিন দিনের মধ্যে দেখানো যায়।

প্রাইভেটে ডাক্তারের পরের এপয়েন্টমেন্ট পরবর্তী ৩ মাস পর্যন্ত ২২০ টাকা লাগে আর সেটা জেনারেল ডাক্তার হলে পরবর্তী ৩ মাস পর্যন্ত ৭৫ টাকা। সিএমসির ডাক্তাররা অনেকেই বাংলা শিখে নিয়েছেন। দোকানদার থেকে তামিল হোটেল ম্যানেজার সহ বেশিরভাগই ব্যবসার সুবিধার জন্যে শিখে নিয়েছে বাংলা ও হিন্দি। আমি ও সেই হিন্দি জ্ঞানের বিশাল চর্চা করে নিলাম।

ভেলোরে ইটলি জনপ্রিয় খাবার। টক থাকবে কিনা ওই ভয়ে আবার খেয়ে দেখা হয়নি। শুধু পিয়াজু খেয়ে চা সন্ধ্যে গেছে। অবশ্য এসব খাবারেও লিপি আপা পাতা আবিষ্কার করতেন। আমরা খাবারে ধনে পাতা ব্যবহার করি ওরকম ওদের কারি পাতা।

তামিলনাড়ুতে এসে চিকিৎসা করানোটা কেমন যেন লজ্জার ঠেকছিল। আমরা বাঙালি নিজেরা নিজেদের ডাক্তারকে বিশ্বাস করতে পারছি না, এসেছি তামিল অধ্যুষিত এলাকায় তাও আবার ওদের দ্বারা পরিচালিত একটা হাসপাতালে। নিজেদের অক্ষমতার লজ্জা কি ঢাকা যায়? শুধু কি বাঙালি? বিহার, উড়িষ্যা থেকে ছত্রিশগড়ের খোদ কলকাতার কয়েকজনের সাথে কথা বলে জেনেছি তাদের নিজেদের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর ক্ষোভ কতটা। শেষ পর্যন্ত তামিলরাই এই জাতিগুলোর ভরসা। কি লজ্জা! বড় ব্যাপার মোট রোগীর নাকি আশি শতাংশই বাঙালি।

ওরাও হয়রানিতে কম যায় না। আপনি দুশো জন পেরিয়ে টাকা জমা দিতে যাবেন তো বলবে, নতুন এসেছেন আগে এফআরও তে যান। মানে চিকিৎসার শুরুতেই সকল বিদেশি রোগী ও তার এটেনডেন্টকে আইআর অফিস (রুম নং ৯০০) এ রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। পুরোনো হলেও নতুন করে ভিসা করলে সেই এফআরও তে যেতে হবে। আছে পুলিশের কাছে ‍যাওয়ার ব্যাপার। যে হোটেলে গেছেন সেখানের সি ফর্ম নিয়ে জমা দিতে হবে থানায় । থানা থেকে হোটেলের কার্ডে একটা সিল মেরে দিবে সেটাও রাখতে হবে সাথে। এসবে আছে টাকার ব্যপাারও।

চিকিৎসা করতে এসে সবচেয়ে বড় বিপদটা হয় কারেন্সি বদলানোর সময়। বাংলাদেশের একশ টাকায় কলকাতায় ৮৩ টাকা পেলাম সেটা ভেলোরে হয়ে গেছে ৭৬ টাকা। আবার সেখানে গিয়ে কলকাতার সিমে কথা বলতে গেলে বিশাল টাকা যাবে রোমিং এর জন্যে। কিনতে হবে লোকাল সিম।

টাকা জমা দিতে গিয়ে চলে গেছি টিপু সুলতানের ‍দুর্গে। হোটেল থেকে বিশালকার পাহাড় দেখা যেত। যে কদিন ছিলাম ভোরের পাহাড়, মধ্য দুপুরের পাহাড় দেখে ভাবতাম চূড়োয় যাব শেষ পর্যন্ত সময়ের জন্যে আর যাওয়া হয়নি। ওখানেই দেখা হয়েছিল শিপন ভা্ইয়ার সাথে। ভাইয়ার বাড়ি আমাদের চট্টগ্রামে। ফেসবুকে পরিচিত । ফেরার সময় সেই কাঠপাডিতে আবার। রাত ১০ টায় গেছি কাঠপাডিতে। সেই ব্যাঙ্গালোরের যশবন্তপুর থেকে ওই ট্রেন যাবে হাওড়া। নাম ও যশবন্তপুর হাওড়া এক্সপ্রেস। এবার এসি ট্রেনের টিকেট পেয়ে গেছি। এসি ট্রেনে একটি বালিশ, বালিশ কাভার, একটি বাংকেট / কম্বল, দুটি চাদর ও একটি ছোট তোয়ালে থাকে।


টিপু সুলতানের দুর্গে প্রবেশপথ

এবার সিট পরেছে মাঝখানে। নিচের সিটে দুর্ঘটনায় স্মৃতিশক্তি হারানো একজন। রাতভর তাকে নিয়ে অন্য ‍তিন জনের ব্যস্ততা। দিনেও তাই। লিপি আপার উপরের সিটে যে মেয়েটা আছে সে আসছে ব্যাঙ্গালোর থেকে। নেমে গেল বিশাখাপাটনাম। ভাব জমেছিল উপরে যে ছিল ওর সাথে। থাকে উড়িষ্যা। বাড়ি অন্ধ্রপ্রদেশে। বাংলা তো বোঝেই সাথে হিন্দী, ইংরেজী, তেলেগু আর উড়িয়াও ওর আসে। আহা আমার জগত কত ক্ষুদ্র। এত এত ভাষার উপর প্রাথমিক জ্ঞান ও যদি থাকত।

ও নেমে গেছে ব্রাহরামপুর্। আর থাকল সেই নীচের সিটের সেই দাদা আর সাথে থাকা তিনজন। ট্রেন ছুটছে তো ছুটছেই। শেষ দিকে ওদের দুজনের সাথে কথা হলো।
ওদের কাছে শুধুই খড়্গপুরের বর্ণনা। আইআইটির প্রথম ক্যাম্পাস এখানেই করা হয়েছিল। বিশ্বের দীর্ঘতম রেলপথ প্ল্যাটফর্ম (১০৭২,৫ মিটার) এবং ভারতবর্ষের বৃহত্তম রেল কর্মশালাও এখানে। স্টেশনের আগে কলাইকুন্ডায় ভারতের প্রথম বিমানবাহিনীর ঘাঁটি আছে এবং আরেকটি বিমানবাহিনীর ঘাঁটি আছে সউলায়। তখন ভোর হয়ে গেছে। ট্রেন এসে পরেছে হাওড়া স্টেশনে। সেই ক্লান্ত না হওয়া জীবন্ত হাওড়া।