চিকিৎসার জন্যে ভারত যাওয়া কি ধর্মে মানা?

রবি হোসাইন
Published : 17 April 2017, 02:26 AM
Updated : 17 April 2017, 02:26 AM

প্রথমত ভারত যাওয়াটা অপরাধ, যদি চিকিৎসার জন্যে যান তো আরো বড় অপরাধ! আর মুসলিম কেউ যদি ভারত যায় তার তো এবার জাতও গেল। আবার সবাইকে যে যাচ্ছে ভারত কিছু না কিছু টাকা তো দিচ্ছেই। যারা ভারত যাবার প্রচারণা করে তারাও এখানে লাভবান কেন এসব বলছি সে কথা পরে হোক।

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১০ লাখ থেকে ১২ লাখ লোক ভারতে যায়- বলেছেন ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এবং ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকিন আহমেদ। তার দাবি, এর মধ্যে ২০ শতাংশ চিকিৎসা ভিসা নিয়ে যায়, তবে প্রকৃত অর্থে চিকিৎসার্থে যাওয়া লোকের সংখ্যা কমপক্ষে ৬০ শতাংশ। এই যে এত লোক ভারতে ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছে তারা কেন যাচ্ছে?

তার খুব ভাল একটা জবাব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান। তার মতে, বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা এখন যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। এই সেবা এখন মফস্বল পর্যন্ত বিস্তৃত। যারা ভারতে যায় তারা মেডিক্যাল ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠানগুলোর প্ররোচনায় পড়ে যায়। কারণ চিকিৎসাসেবা এখন ব্যবসা নির্ভর হয়ে পড়েছে। ওই সব দেশের প্রতিষ্ঠিত হাসাপাতালগুলোর বাংলাদেশে নিজস্ব অফিস আছে। তারা কমিশনের জন্য রোগীকে প্ররোচিত করে বিদেশে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের চিকিৎসা সম্পর্কে তিনি বলেন, ৪০ শতাংশ রোগীই যায় প্রয়োজন ছাড়া। এটি বেশি দিন থাকবে না, সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন উপচেপড়া ভিড়। অভিযোগ আছে, চিকিৎসকরা রোগ চিহ্নিত করতে না পারায় রোগীরা বাধ্য হয়ে ভারতে যায়। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের সঠিক তথ্যের ঘাটতি রয়েছে এবং সঠিক জায়গায় না যাওয়ার কারণে তাদের এমনটি হতে পারে।

যার সোজা বাংলা করলে দাঁড়ায়, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছল পাঁচ হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে শুধু ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে। এত টাকা আমরা দিয়ে আসছি শুধুই প্ররোচনায় পড়ে? নাকি ভুল ডাক্তারের কাছে গিয়ে? মিরপুরে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ডাক্তারকে ৬/৭ বার দেখিয়েছি। বড় ডাক্তার তিনি। শেষ বার তিনি রিপোর্ট ভাল করে না দেখেই বললেন, অপারেশন করতে হবে দ্রুত নয়ত আপনার ইউরিনারি ব্লাডার ব্লক হয়ে যাবে। ইউরিনারি ব্লাডার সরু হয়ে গেছে। অপারেশন না করলে পরে আর ইউরিন পাস হবে না। ভয়ংকর একটা ব্যপার। ঢাকা শহরে আমি তখন একা। অপারেশন লাগবে! পরে বাবার সাথে ঢাকা গেছি সেই ডাক্তার ছিলেন না। অনেক ঝামেলা আর ভোগান্তির পর পাসপোর্ট করে চলে যাই কলকাতা। চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের ডাক্তার মেডিসিন দেবার আগে ১৫ দিন পর্যবেক্ষণ করে সেই একি টেস্টগুলো করিয়ে জানালেন আমার রিপোর্ট ভুল ছিল আর সমস্য যতটা আছে তাতে অপারেশন লাগার কথাও না। ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই।

দ্বিতীয় ঘটনা আমার আপু লিপির সাথে। চট্টগ্রামের একটি বেসরকারী ক্লিনিকে তাকে হঠাৎ করে বলা হলো এক সপ্তাহের মধ্যে জরুরী অপারেশন করতে হবে নয়ত আপু মারা যাবে। পরে ভারত নিতে মাঝখানে বিশাল সময় যায় আর অপারেশনও হয় অনেক দেরী। আপু এখন দিবি সুস্থ। এই দুটো ব্যাপার খুব কাছ থেকে দেখা আর পরিচিতজনদের কাছে আমাদের চিকিৎসার ব্যাপারে অনেক কিছু শুনি যা হতাশ করে। কিন্তু যখন প্রশ্ন আমার জীবন-মরণের আমি কেন ভাল চিকিৎসা যেখানে পাব সেখানে যাব না? দেশপ্রেমের জন্যে কি আমি ভুল চিকিৎসার শিকার হবো?

বাস্তবতা এমন, অনেকেই এসব ইচ্ছেকৃত বিড়ম্বনায় পড়েননি বলে বাংলাদেশের বাইরের কেউ চিকিৎসা করাতে গেল তাদের যা ইচ্ছে তাই বলছেন। ভেলোরে চিকিৎসার জন্যে যাবেন? শিরোনামে লেখাটি বিডিনিউজের ফেসবুক পেইজে শেয়ার করার পর সেখানে বেশ কিছু কমেন্ট আসে। কেউ লেখককে ভারতের দালাল বলেছেন। কেউ বলছেন ভারত থেকে বিডিনিউজ কত টাকা নিয়েছে। কেউবা বলছেন দেশের ডাক্তারদের মিডিয়া সমালোচনা করার কারণ ভারতের বাজার তৈরি করা। কেউবা বললেন মুসমানদের যদি লজ্জা থাকে ভারত যাবে না।  কারো কাছে তো লেখাটার সাথে বাস্তবতারও কোন সম্পর্ক নেই। কেউবা পেইড মিডিয়া বলছেন আবার কেউ বলছেন এসব ছাপিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে মিডিয়া।

আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভাল হলে মানুষ এত হয়রানির শিকার হয়ে পাসপোর্ট করতে যেত না। শুধু পাসপোর্ট না, ভারত যাওয়ার জন্যে ভিসা করা থেকে ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নেয়া, বর্ডারে হয়রানি, চড়া দামে টিকেট কেনা বা টিকেট না পাওয়া, থাকা খাওয়ার সমস্য সহ কত যে সমস্যয় পড়ে তার কোন শেষ নেই। দেশ থেকে যারা যান তাদের কাছে সেটা সম্পূর্ণ অচেনা এক জগত। সঠিক গাইডলাইন না থাকার কারণে ভোগান্তি আরো বাড়ে। ফলে যারা যাবেন তাদের আগে থেকে কিছু ব্যাপার জানলে সুবিধে হয় সেই উদ্দেশ্যে লিখা। কিন্তু আমার দেশের সাধারণ মানুষ এখনও যুক্তিবোধ দিয়ে বিচার করতে শেখেনি। সব জায়গাতে তারা ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, পুজিঁবাদ খুঁজে পায়। ফলে যতদূর আমাদের এগোনোর ততটা এগোনো হয়নি।

স্বভাবতই বাকীদের মত নিজের লিখা পড়ে কে কি বলছে তা জানার চেষ্টা করি। মানুষকে জানানোর ‍উদ্দেশ্য ছিল তারা যাতে যাওয়ার আগে একটা ধারণা পায়। সীমান্তে কোন হয়রানির শিকার না হয়। কিন্তু যখন নিজে ওই বিপদে পড়ছি  না ততক্ষণ  হয়ত আমরা শিখতে রাজী না। মিডিয়াকে ভালবাসি বলে কোন কারণে মিডিয়াকে দোষারোপ করা হলে কষ্ট হয়।

ভারতের পিএসআরআই হাসপাতালের পরিচালক ডা. দিপাক শুকলা ওই সংবাদে জানিয়েছেন, মেডিক্যাল ট্যুরিজমের বর্তমান বিশ্ববাজার প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকার। আর এতে ভারতের হিস্যা বাংলাদেশের টাকায় প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। এ বাজারে বাংলাদেশের অবদান ২২ শতাংশ। তার মানে বাংলাদেশিরা প্রতিবছর ভারতে মেডিক্যাল ট্যুরিজমে খরচ করে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তিনি জানান, প্রতিবছর বিশ্বে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে মেডিক্যাল টুরিজমের বাজার বাড়ছে। ওদের এই বাজার একদিনে তৈরি হয়নি। আমাদের ভাল মানের ক্যান্সার হাসপাতালের খুব অভাব। সেই সাথে ডাক্তারদের ওপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণও নেই। ফলে অনাকাঙ্খিত অনেক কিছুই ঘটছে। সবকিছু রাতারাতি বদলে ফেলাও সম্ভব না। কিন্তু আমাদের তো শুরু করতে হবে। নইলে হয়ত ভারতের এই বাজার দ্বিগুণ হবে।

এমনিতেই আমাদের সরকার প্রধানরা কখনো দেশের হাসপাতালের উপর ভরসা করতে পারেন না। গত ২০ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার হোটেল রেডিসন ব্লু ঢাকার ওয়াটার গার্ডেনে বাংলাদেশ সোসাইটি অব কার্ডিওভাসকুলার ইন্টারভেনশন (বিএসসিআই)-এর থার্ড ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্টিফিক কনফারেন্স-২০১৬ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ  বলেছেন, 'আমাদের মনে রাখতে হবে, উন্নত চিকিৎসার জন্য অর্থ প্রদান করার ক্ষমতা দেশের অনেক মানুষেরই নেই। অতএব, তাদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রশ্ন তার প্রতি, এই উন্নত চিকিৎসায় তিনি কতটুকু আস্থা রাখেন?