আমার বাড়ি থেকে সীতাকুন্ডের সদর যেতে বড়জোর ২০/২৫ মিনিট লাগে। আর শহর থেকে সদরের দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। সদর থেকে কলেজ রোড ধরে যেতে হবে সামনে। এর আগেও এই রাস্তা ধরে গেছি। এই প্রথম বার মনে হলো এই বিশাল এলাকা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট। তারা দেশভাগের সময় চলে যায়নি। হয়ত মনে হয়েছিল, কেন যাব, দেশ তো আমার। আর মুসলিমরাও তেমন একটা বাধা দেয়নি। দিয়েছে কি এই প্রশ্নটা অন্তত আমার সীতাকুন্ডের ব্যাপারে আসে না। আমরা কখনো হিন্দু বিদ্বেষ বা তাদের ছুঁলে জাত যাবে এই ধারণার মধ্যে বড় হইনি। গত পনের বছর ধরে কারো ধর্মীয় বিরোধ ও চোখে পরল না। বরং হিন্দুদের দুর্গা পুজায় নাচতে থাকাদের সারিতে আমার পাড়ার মুসলমানরাই বেশি। জেনে হোক না জেনে হোক তারা যায়। পহেলা বৈশাখে তাদের দেয়া ভাত খাওয়ার জন্যে যেতাম। নিজেদের মধ্যে বিয়েতে আসা যাওয়া সহ বিপদে আপদে পাশে আসা সব কিছু আমাদের আছে। কখনো মনে হয়নি ওরা আলাদা জাতের আলাদা কেউ। এত সব ভাবতে ভাবতে চলে গেছি আরো ভেতরে। এই সম্প্রীতির তির্থস্থানে কয়েক মাস আাগেই জঙ্গি আস্তানা গুড়িঁয়ে দিয়েছিল সোয়াট। সীতাকুন্ডের জন্যে এর চেয়ে বড় দুঃখ আর হতে পারে না। আমার এলাকায় জঙ্গি! লজ্জা।
তার সামনেই আছে প্রধান ফটক। এটা ইটের্ রাস্তা। কিছুদূর হাটলে হাতের ডান পাশে দুটো পুরোনো মন্দির রয়েছে। যেতে হবে বাম পাশের রাস্তা ধরে।
কোথাও চোখে পরতে পারে বাদুঁরের। পাহাড়ে বাদুঁরের মুখোমুখি হওয়া খুব আতঙ্কের যদি একা বা দুজন থাকেন। কারণ বানর দলসহ থাকলে তাড়া দেবেই তাই কিছুটা ভয়ও থাকে।
যেতে যেতে দু একটা দোকান পরবে। শেষ দিকে একটা বট গাছের নীচে পৌছালে তার উপরেই দেখা মিলবে চন্দ্রনাথ মন্দিরের। এই মন্দির ঘিরেই যত আয়োজন হিন্দু ধর্ম্বালম্বীদের।
মন্দিরের পশ্চিমে সুবিশাল বঙ্গোপসাগর আর চারপাশে পাহাড়ের সারি। ১৫০০ ফুট উঁচু থেকে পৃথিবী!
কথিত আছে দেবী দুর্গার মৃতদেহ দেবতা বিষ্ণুর নির্দেশে ৫২ খণ্ড করে ৫২টি জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের ৬টি জায়গায় রয়েছে দেবীর মৃতদেহের ৬ খণ্ড। তার মধ্যে একটি জায়গা হচ্ছে এ চন্দ্রণাথ মন্দির। পাহাড়ের উপর অবস্থিত এ মন্দিরটিতে যেতে পাড়ি দিতে হয় হাজারখানেক সিড়ির ধাপ। আর সীতাকুণ্ড নামটিও একটি মিথ। সীতার বনবাসের সময় রাম ও সীতা কিছু সময় কাটিয়েছিলেন এ জায়গায়। সীতার গোসলের জন্য একটি পুকুর খনন করা হয়েছিলো যার নাম কুণ্ড।
আবার অন্য একটি ইতিহাস ও প্রচলিত আছে। নেপালের একজন রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে বিশ্বের পাঁচ কোনে পাঁচটি শিবমন্দির নির্মান করেন। এগুলো হলো নেপালের পশুপতিনাথ, কাশিতে বিশ্বনাথ, পাকিস্তানে ভুতনাথ, মহেশখালীর আদিনাথ আর সীতাকুন্ডে চন্দ্রনাথ।
প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ও ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় প্রাচীন কালে এখানে মহামুনি ভার্গব বসবাস করতেন।অযোদ্ধার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র তার বনবাসের সময় এখানে এসেছিলেন।মহামুণি ভার্গব তাঁরা আসবেন জানতে পেরে তাঁদের স্নানের জন্য তিনটি কুণ্ড সৃষ্টি করেন এবং রামচন্দ্রের এখানে ভ্রমণ কালে তাঁর স্ত্রী সীতা এই কুণ্ডে স্নান করেন।এই কারনেই এখানকার নাম সীতাকুণ্ড বলে অনেকে ধারনা করেন।
এরপর যতটা জানা যায়, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতাব্দীতে এই চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুরোটাই আরাকান রাজ্যের অধীনে ছিল পরের শতাব্দীতে সম্রাট ধর্মপাল (৭৭০-৮১০ খ্রীঃ) পুরা এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিলেও সময়ের সাথে সাথে শাসক বদলেছে। সোনারগাঁও এর সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ্ (১৩৩৮-১৩৪৯ খ্রীঃ)১৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে ক্ষমতা গ্রহণের পর পরবর্তীতে ১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দে সুর বংশের শের শাহ্ সুরির নিকট বাংলার সুলতানি বংশের শেষ সুলতান সুলতান গীয়াস উদ্দীন মুহাম্মদ শাহ্ পরাজিত হলে হলে এই এলাকা আবারো আরাকান রাজ্যের হাতে চলে যায় এবং আরাকানীদের বংশধররা এই অঞ্চল শাসন করতে থাকেন। আরাকানের সাথে চট্টগ্রামের একটা যোগসূত্র পাওয়া যায় সেটা তাহলে সেই আমল থেকেই শুরু। খুব বেশি দিন আরাকান রাজ্য সুস্থিরভাবে শাসন করতে পারেনি। তারপর আসে পর্তুগীজরা। ১৫৩৮ খ্রী: থেকে ১৬৬৬ খ্রী: পর্যন্ত এই অঞ্চল পর্তুগীজ ও আরাকানী বংশধররা একসাথে শাসন করে। তারপর তাদের সাম্রাজ্যে হামলা চালিয়ে ১২৮ বছর পর ১৯৬৬ খ্রী: মুঘল সেনাপতি বুজরুগ উন্মে খান এই অঞ্চল দখল করে নেন।
পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দেৌলার পরাজয়ের ফলে বাংলার সূর্য অস্তমিত হলে এই সীতাকুন্ডও ব্রিটিশ রাজত্বে চলে যায়। আরাকানের আগে কারা এই সীতাকুন্ডকে শাসন করত তার কোন তথ্য নেই।
১৯০৮ সালে স্বদেশী আন্দোলনের ফলে কতৃত্ব চলে আসে স্বদেশীদের হাতে। তারপর থেকে এই এলাকা কলকাতা থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। আহা আমরা কলকাতা থেকে নিয়ন্ত্রিত হতাম!