গুলিয়াখালি সৈকতে সকাল

রবি হোসাইন
Published : 20 July 2017, 07:21 AM
Updated : 20 July 2017, 07:21 AM

সমুদ্রের ও পাড়ে যাবার গল্প করতাম তখন। বালুচরে জোয়ার আসবে। জোয়ারে পা ভিজবে। আমরা হাটব দ্বীপের এ মাথা থেকে ও মাথা। যেদিকেই যাব সমুদ্র। এ গল্প গুলো কাচাঁ প্রেমের।

সমুদ্রকে অত কাছে পাবার অধিকার নেই। ছিল না কখনো। তাই অবসর হলেই যাওয়ার জন্যে প্রথম পছন্দ বঙ্গোপসাগরের কোন তীর।

সীতাকুন্ড উপজেলা থেকে সমুদ্র দূরে জানতাম। তাই অত দূরে যাবার জন্যে কাউকে পাওয়া যেত না। বন্ধু মিশু বলল গুলিয়াখালি সি বিচ যাবে। আমিও রাজি।

শহর থেকে উপজেলা সদরে যেতে সময় লাগে ৪০ মিনিটের ও কম। সদর থেকে পশ্চিমে যেতে হবে অনেকদূর। সেখানেই সিএনজি আছে অনেক। লোকাল কোন সিএনজি পাওয়া গেল না। রিজার্ভ সিএনজিতে ২০ মিনিটেই পৌছে গেলাম মুরাদপুর এলাকার বেড়িবাঁধে। এদিকে ও পাড়ে মানে সন্দ্বীপে যাওয়ার ঘাট আছে। তাই কিছু দোকানপাট ও আছে। কিছুটা ব্যস্তও।

সমুদ্র তখনো আরো অনেকদূরে। কেওড়া গাছের বাগান। আমরা কেরবা গাছ বলতাম। কিছু বাচ্চা ছেলে ফিরছে লাঠিসোঁটা নিয়ে। কেউ কেউ সমুদ্রে ভেসে আসা গাছ নিয়ে ফিরছে। বেড়িবাঁধের পরেও বিশাল জায়গা রয়ে গেছে। যেখানে চাষবাষ হচ্ছে। পাশ দিয়ে চলে গেছে খাল। সেই খালে ৫/৬ টা ছেলে। কাদায় মাখামাখির শৈশবের দিন গুলো আবারো সামনে। সামনে লাঠি দিয়ে কোন রকমে দাড় করে রাখা একটা দোকান। দোকান নয় যেন পুরোটাই জানালা। ছাউনি বাদে চার পাশ দিয়েই যেন বাতাস ঢুকছে। দুজন বুড়ো বুড়ির দোকান। চা খাওয়ার পর দাদীর সাথে ছবি তুলতে চাইলাম। দুজনের লজ্জা কাটিয়ে ছবি তোলা হলো।আমরা আরো সামনে যাব। অনেক দূরে তখনো পানি। বিশাল চর। জোয়ার না আসলে এই চর রোদে উত্তপ্ত হয়। ছোট লাল কাকঁড়ার ছোটাছুটি ছাড়া খুব নীরব এই চর। খালের ও পাড়ে বাগান আছে। কেওড়া গাছের বাগান। ছোট বেলায় খাল পেরোতে ভয় হত। ভয়টা এখনো হলো। তবে কাদা লেগে যাবার ভয়। আর ছোট বেলায় সেটা ছিল চোরা বালুতে ডুবে যাবার ভয়। সেই চোরা বালুর দেখা পাইনি কখনো।

কেওড়া গাছে জোয়ারের আঘাতে নিজের অস্তিত্ব হারাতে হারাতে শ্বাসমূলে গিয়ে আটকে আছে। এ বাগান যেন গরুদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র। এটা ভরা জোয়ারের সময় নয়। তাই গ্রামের সব গরু এনে রাখা হলো এখানে। ওদিকে ঘাট থেকে বোট ছাড়ছে। সাগরে ঢেউ নেই অত। তাই ছুটছে দ্রুত। রোদের আসা যাওয়ায় তখন রং বদলাচ্ছে বারবার। ততক্ষণে জোয়ার আরো কাছে এসে গেছে। জোয়ারের শব্দে হাহাকার আছে।

পোনা মাছ ধরার জাল নিয়ে খালের ধারে দুজন। কয়েক জায়গায় মাছ চাষ হচ্ছে বাঁধ দিয়ে। পানি যাবার মুখে ডু্ব বসিয়ে রাখা। এই ডুব আমাদের পুকুরেও বসাতাম। বর্ষায় পানি বাড়লে পুকুরে যেদিক দিয়ে পানি যেত সেখানে বাঁশের তৈরি লম্বাটে একটা ফাঁদ বসাতাম যেটার শেষে গিয়ে মাছ আটকে যাবে। অসুবিধে হতো সাপ আটকে গেলে। মা আর আমি অথবা আমি আর দাদী যেতাম। অনেক রাতে। অথবা ভোরে। কোন বিষাক্ত বা নির্বিষ সাপ মুখে মাছ নিয়ে বসে থাকত। আলো বন্ধ করে অপেক্ষা করতাম কখন সাপ চলে যাবে। ফেরার সময় শোল মাছ, শিং মাছ নিয়ে ফিরতাম। বহুদিন পর এই ডুব দেখা।

ফেরার পথে আর খাল পেরোনোর সুযোগ নেই। খালে জোয়ারে পানি ঢুকেছে। কাদা মাটি পেরিয়ে চলতে হলো। বহুদিন পর জুতা খুলে কাদায় মাখামাখি করা। নিজের শেকড়ের ভেতর চলে যাওয়া।

ফিরতে ফিরতে বিকেল। বিশাল আকাশের শেষে পাহাড়ের সারি। এ পাহাড়গুলোকে কালো দানবের মত লাগে।

একটা খোলা মাঠ। বিশাল আকাশ। পূর্ব দিকে তাকালে পাহাড় পশ্চিমে তাকালে সাগর। এটাই আমার সীতাকুন্ড। জীবনের নানামুখী জটিলতা কত দূরে সরিয়ে রাখে নিজের শেকড় থেকে।