পুরান ঢাকা বৃত্তান্ত

রবি হোসাইন
Published : 22 August 2017, 08:13 PM
Updated : 22 August 2017, 08:13 PM

ঢাকা! জাদুর শহর ঢাকা। এক সময় যাকে বলা হতো 'প্রাচ্যের রোমান্টিক শহর'। ঢাকার সাথে পরিচয় বাংলাদেশ টেলিভিশন দেখে। সার্ক ভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে বিভিন্ন ডকুমেন্টারি দেখানো হতো। নেপাল, ভূটানের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকার সাথেও পরিচয় ও ওভাবে। টিভি দেখেই জেনেছি ঢাকা আর পুরান ঢাকা দুটো আলাদা। বাবা বেশ কয়েক বছর বাড়ি থেকে পালিয়ে ছিলেন ঢাকায়। আমার কাছে ঢাকার গল্প করতেন। অবশ্য তার ও আগে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এই পাঠ নিতে হয়েছিল।

ফেসবুকে আসার পর ঢাকার অনেক মানুষের সাথে যোগাযোগ হলো। স্বপ্ন সব ঢাকাকে ঘিরে মাথা উঁচু করে দাড়াতে শুরু করেছে। ইন্টারমিডিয়েট দেয়ার পরদিনই চলে যাব ঢাকাতে। কি করব? ভাবতাম কোন একজনকে বলে তাদের বাসায় থাকব। তাদের ছেলে মেয়েকে পড়াব। আর আমার পড়ালেখাও হবে। ইন্টারমিডিয়েট দেয়া হলো কিন্তু পিছুটানের কারণে ঢাকা যাওয়া আটকে গেল। যে শহরের স্বপ্নে আমি আমি অতটা ডুবে গেছি সেটায় যাবার সুযোগ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে।

ফকিরাপুল একটা হোটেলে ছিলাম। রাস্তার চারপাশ দেখে অবাক হচ্ছিলাম। আরে এ তো আমার শহর। পরদিন পরীক্ষা ছিল ঢাকা মেডিকেলের পাশে একটা কলেজে। জাবির পরীক্ষা হলো নীলক্ষেতের পাশে একটা স্কুলে। বাবা মধুর ক্যান্টিন, কলা অনুষদ, শাহবাগ, টিএসসি ঘুরে দেখালেন। পরদিন পরীক্ষা শেষে ফেরার পর আর ঢাকা যাওয়া হলো না। চট্টগ্রামেই কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মাঝখানে হারিয়ে গেল ঢাকা যাওয়ার স্বপ্ন।

১৫ এর শেষের দিকে প্রেম ভেঙ্গে যাওয়ায় ঢাকায় উঠলাম। পুরান ঢাকায়। ঢাকার সেই দিনগুলি এখনো যেন বর্তমান। এর পর আরো অসংখ্যবার গেছি ঢাকা। পুরান ঢাকায় আমি যেখানে উঠি জায়গাটার নাম ওয়ারী। ওয়ারী হলো পুরান ঢাকার শেষ অংশ এবং অন্যতম অভিজাত এলাকা। এটি পুরতান ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। এ এলাকা গড়ে তোলা হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন আমলে। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বিনামূল্যে আবাসিক প্লট বরাদ্দ করা হতো ওয়ারীতে। এখনের মত স্থানীয় বাসিন্দরা ছিল না। তখন সরকারি চাকুরেদের বেশিরভাগই ছিল হিন্দু ধর্মালম্বী তাই ওয়ারী হিন্দু-প্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিতি পায়। সে সময় ওয়ারী ছিল সবুজ ছিমছাম নিরিবিলি একটি আবাসিক এলাকা। যেমন দেখি এখন নদীয়ার কল্যাণীতে। কল্যণীর বাড়ি গুলোতে যেমন সামনের অংশে বাগান আর ভেতরের দিকে উঠান আছে তেমন ছিল এখানেও। বাড়ি ঘর ও ছিল এক তলা। দোতলাও খুব বেশি নয়। অসংখ্য পুকুর আর খেলার মাঠ ও ছিল। সেই ওয়ারী আজ আধুনিক সময়ে এসে তার সবুজ হারিয়েছে।

একসময় এসব এলকাতে ঘোড়া ও পরবর্তীতে রিকশাই ছিল একমাত্র বাহন। কিন্ত এ চিত্রটা ভেতরের দিকে থাকলেও ওয়ারীর দিকে অনেকটা বদলে গেছে। তখনের অভিজতা ব্যবসায়ীরা গাড়ি কিনছেন। বাইরে থেকে এসেও অনেক এদিকে বসত গড়েছে। পুরোনো বাড়ি গুলো ভেঙ্গে নতুন ঢাকার আদলে ওয়ারী গড়ে উঠেছে। আমার তো মনে হয় ওয়ারী পুরান ঢাকার সম্মানটাই হারিয়ে বসেছে। আধুনিক জীবনের যত অনুষঙ্গ যেমন বিভিন্ন নামি-দামি ফাস্টফুডের দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় শপিং মল কি নেই ওয়ারীতে? শুধু যে ওয়ারী সবুজ ছিল নদীয়ার কল্যাণীর মত গোছানো আর ছিমছাম ছিল সেটি হারিয়ে গেছে।

টিপু সুলতান রোডেই ভাইয়ার বাসা। ভাইয়ার শ্বশুর হলো এই এলাকার আদি বাসিন্দা। চট্টগ্রামের মানুষের অতিথিপরায়ণতার কথা শুনি। এখানে সেই বিশেষণের সাথে নতুন কিছু যোগ করার সময় এসেছে।

এখানে থাকতে থাকতে যেটা বুঝেছি এদিককার মানুষ ঢাকার অপরাপর অংশের মত নয়। তারা ধর্ম কর্ম করে। তাদের খাদ্যভাস, জীবন যাপনের অনেক কিছুই বৃহত্তর ঢাকা থেকে ভিন্ন। আমি পশ্চিমবঙ্গ যেতে আসতে পুরান ঢাকার অনেকের সাথেই পরিচিত হয়েছি। বেশিরভাগের পেশা ব্যবসা। হবেই না বা কেন? দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান চামড়া প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলটি হাজারীবাগ এলাকায়। লালবাগের পোস্তা জায়গাটা হলো দেশের অন্যতম কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ অঞ্চল। ইসলামপুর হলো থান কাপড়ের বৃহত্তম বিপণন অঞ্চল। নবাবপুর এলাকায় পুরান ঢাকাইয়াদর সব দোকান। বংশ পরস্পরায় তাদের এ পেশা। তারা আবার উর্দুতেও পটু।

খাবারের ব্যপারে রয়েছে বিশাল বৈচিত্র্য। রমজান আসতেই গণমাধ্যমে পুরান ঢাকার খাবার আলোচনায় চলে আসে। উত্তর ভারতের বিভিন্ন খাবার যেমন টিক্কা, জালি কাবাব, কাঠি কাবাব, শাম্মি কাবাব, বটি কাবাব, নার্গিস কাবাব, দই-বড়া, মুরগি মুসাললাম, খাসির পায়া, পাক্কি বিরিয়ানী, মোরগ পোলাও, নান রুটি, বাকরখানি, বোরহানী। এর মধ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে কর্মরত এক পুরান ঢাকাইয়ার সাথে দেখা হতেই নিয়ে গেল হাজীর বিরিয়াণি খাওয়াতে। ভোজনরসিক হলে আপনার একবার পুরান ঢাকায় আসতেই হবে।

প্রতিবছর ১৪ বা ১৫ই জানুয়ারি পুরান ঢাকা'র প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদে ঘুড়ি উড়ানো হয়। এ উৎসবকে সাকরাইন বলে। যে উৎসবটি মূলত উত্তর ভারতের। দুটোর মধ্যে যোগসূত্র খুঁজতে গিয়ে জানলাম বাংলাদেশ সহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খন্ড এবং উড়িষ্যার অর্থাৎ সুবাহ্ বাংলার রাজধানী ছিল এই ঢাকা। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১০ সালে যখন এই এলাকাকে রাজধানী মর্যাদা দান করেন।তখন সুবাদার ছিলেন ইসলাম খান। প্রচলিত আছে তিনি আনন্দে ঢাক বাজানোর নির্দেশ দিলে সেখান থেকেই পরে এই অঞ্চলের নাম হয় ঢাকা। সম্রাট জাহঙ্গীরের আমলে এই ঢাকাকে জাহাঙ্গীরনগর ও বলা হতো।

আবার কারো মতে সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ঘুরতে এসে কাছের একটি জঙ্গলে হিন্দু দেবী দুর্গার একটি বিগ্রহ খুঁজে পান। দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ রাজা বল্লাল সেন ঐ এলাকায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু দেবীর বিগ্রহ ঢাকা বা গুপ্ত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো, তাই রাজা, মন্দিরের নাম রাখেন ঢাকেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের নাম থেকেই কালক্রমে স্থানটির নাম ঢাকা হিসেবে গড়ে ওঠে। সেই ঢাকেশ্বরী মন্দির এখনো রয়ে গেছে।

আমার বহুদিনে ইচ্ছে সদরঘাট যাব। আয়ানের জন্মদিনে ঢাকাতে আসার পর সদরঘাট যাবার সুযোগ ও হয়ে গেল। ওয়ারী থেকে বের হলেই দেখা যায় রাস্তা গুলো খুব সরু। রিকশা ছাড়া চলাচলের উপায় থাকে না। আবার রিকশার যে জ্যাম তাতে হেঁটেই আগে চলে যাওয়া যায়। তবে আরেকটু দক্ষিণে গেলে রাস্তা গুলো চওড়া। দেখা মিলবে ঘোড়ার গাড়ির। যেগুলো যাত্রী নিয়ে আসছে সদরঘাট থেকে।

পুরান ঢাকার ঘোড়ার গাড়িআমরা গেছি ধোলাইখালের ভেতর দিয়ে। তবে সেখানে কোন খালের অস্তিত্ব চোখে পড়েনি। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খান চিশতীকে রাজমহলের সুবেদার নিযুক্ত করেন । ১৬১০ সালে যখন ঢাকা সুবেহ্ বাংলার রাজধানী তখন ঢাকার প্রধান জলপথ ও নগর রক্ষা পরিখা ছিল এ ধোলাই খাল। নগর রক্ষার পরিখা নির্মাণ ও জলপথ হিসেবে ব্যবহারের জন্য ঢাকার প্রথম সুবেদার ইসলাম খান ধোলাই খাল খনন করিয়েছিলেন। কিন্তু হায়! সেই ধোলাইখাল তার রঙ হারিয়েছে। আজ সে পরিণত হয়েছে বিভিন্ন খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির কেন্দ্রে। খুব কম জিনিসই আছে, যা কি না সেখানকার দক্ষ কারিগররা তৈরি করতে পারেন না কলকাতা গেলে সেখানে বিভিন্ন লেনের নাম দেখে মনে হয় কত শত বছরের ইতিহাসের উপর দিয়ে হাটছি। ঠিক তেমনই অভিজাত পুরান ঢাকার এলাকা গুলোর নাম। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী মিটফোর্ড রোড, জিন্দাবাহার, বংশাল, ওয়াইজঘাট, ইসলামপুর, জনসন রোড, সুভাষ বোস এভিনিউ, নর্থব্রুক হল রোড, কে জি গুপ্ত লেন, পাতলা খান লেন, রূপচান লেন, প্রতাপ দাস লেন, আর এম দাস লেন, ডিস্টিলারি রোড নাম গুলোও দারুণ লাগে। এ ছাড়াও ওয়ারীতে স্ট্রিট নামে অনেক এলাকা আছে সেগুলোর নাম ও বেশ সুন্দর। নবাব স্ট্রিট, ভজহরি সাহা স্ট্রিট, র‌্যাংকিন স্ট্রিট, লারমিনি স্ট্রিট।

ধোলাইখাল থেকে আরেকটু সামনে যেতেই বাহাদুর শাহ পার্ক। এর পশ্চিমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং উত্তর পশ্চিমে জেলা আদালত। এই পার্কের আগের নাম ছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবে শহীদ বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বাহাদুর শাহ্ জাফরের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। এদিকটাতেই আছে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। এর আগে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় মোড় পাড় হবার পর পুরান ঢাকা যেন আরো পরিণত। ব্যস্ত। চারপাশে মানুষ ছুটছে খুব দ্রুত। আরো একটু সামনে গেলেই বুড়িগঙ্গা। সদরঘাট যেটি ঢাকার প্রধান নদী বন্দর।

ছবি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে যে বিদ্যাপীঠ ছিল শ্রেষ্ঠ

প্রতি ঈদে এই লঞ্চ ঘাট টিভিতে দেখি। চারদিকে জীবনের এক অদ্ভুত ব্যস্ততা। বিশাল বিশাল দ্বিতল, ত্রিতল বিশিষ্ট লঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছে। কোনটাতে যাত্রী উঠছে। নদীতে নোঙ্গর করে আছে বহু লঞ্চ। লঞ্চে উঠে বুড়িগঙ্গাকে দেখলাম। চারশ বছর আগে যার তীরে গড়ে উঠে ঢাকা শহর। ব্রিটিশ আমল থেকেই ঢাকা থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নদী পথে যাত্রী বহনের এটিই একমাত্র বন্দর।। এমনকি একটা সময় কলকাতা থেকে বড় বড় নৌকা এদিক দিয়ে যেত।

ভাইয়ার সাথে নৌকায় উঠলাম। ও পাড়ে কেরানীগঞ্জ। ব্রিজ দিয়ে পার হওয়ার চেয়ে নৌকাতেই সহজেই যাতায়াতে সুবিধা এ দিকে। তাই জাহাজের ধাক্কায় তলিয়ে যাবার ভয়ের পর ও মানুষ ছুটছে এ পাড় ও পাড়। আমরা ছোট এক নৌকায়। বুড়িগঙ্গার পানি চিকচিক করছে। বয়ে চলছে নীরবে। সে কি জানে এই নগর তার দান?

বাংলার সুবাদার মুকাররম খাঁর শাসসনামরে নদীর সাথে লাগোয়ো অংশগুলোতে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন নদীর বুকে বুকে অংসখ্য নৌকাতে জ্বলতো ফানুস বাতি। ১৮০০ সালে টেইলর বুড়িগঙ্গা নদী দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন- বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে তখন দুর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো।

এ বুড়িগঙ্গাকেকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই নগর। সেই বুড়িগঙ্গা আজ মৃতপ্রায়। মুঘল আমলে ও ব্রিটিশ আমলে আরো গড়ে উঠেছিল লালবাগের কেল্লা, ঢাকেশ্বরী মন্দির, তারা মসজিদ, হোসেনী দালান, আহসান মঞ্জিল, শাঁখারিবাজার, বড় কাটারা, ছোট কাটারা, বাহাদুর শাহ পার্ক, বেগমবাজার মসজিদ, খান মুহাম্মাদ মসজিদ, বিনত বিবির মসজিদ, রূপলাল হাউজ, আর্মেনীয় গীর্জা, চকবাজার শাহী মসজিদ, শায়েস্তা খান জামে মসজিদ, জিনজিরা প্রাসাদ। কাছাকাছি এলাকাতেই গড়ে উঠেছে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়।