মেঘালয়ের দেশে পিয়াইন নদীর স্রোতে

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 11 Oct 2016, 08:39 AM
Updated : 11 Oct 2016, 08:39 AM

শীত তখনো জেঁকে বসেনি শহরের বুক জুড়ে ।হঠাৎ করেই পেয়ে গেলাম তিন দিনের ছুটি ,এবার ইচ্ছে হলো পুরো সিলেট ঘুরে বেড়াবো ।কিন্তু ৩,৪৯০ বর্গ কিলোমিটার সিলেট জেলা কি আর দুই দিনে ঘুরে দেখা সম্ভব। একদিন যাবে কেবল যেতেই ।তার পাশে আরো আছে সুনামগঞ্জ , হবিগঞ্জ এবং মৌলভিবাজার ।তাই ঠিক করলাম এক পাশ থেকেই আরম্ভ করবো ।মেঘালয় থেকে শুরু করলে প্রথমেই আসে জাফলং।

এবার আর রাতের বাসে না ,দিনের ট্রেনেই যাত্রা আরম্ভ করেছি ; পৌঁছতে পৌঁছতেই রাত্রি গভীর । কমলাপুর থেকে জয়ন্তিকা ছেড়েছিল দুপুর বারোটার কিছু পরে ।রাস্তায় তেমন কোন ঝামেলা হয়নি ,রাত আটটা বাজতেই নেমে গিয়েছিলাম সিলেট রেলস্ট্যান্ডে ।আমাদের নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি থাকার কথা ছিল ,কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে ড্রাইভার খুব দেরী করে ফেললো ।প্রতিবারের মতোন এবারো আমার গন্তব্যস্থল পর্যটন কর্পোরেশনের মোটেল ।এ এক আশ্চর্য রকম অনুভূতি ।আমার সাথে থাকা অন্য দুই'জনো এই শহরে প্রথম।আর ড্রাইভার চেনে শৃমঙ্গলের রাস্তা ,সিলেটের রাস্তা সম্পর্কে তার কোনই ধারণা নাই।

আমরা ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সেই ধারণা বিহীন শহরের বুক চিড়ে ছুটে চলেছি ।কোথাও একটু ঝাঁকি খেলাম না, এমন মসৃণ পথ।আলো আঁধারের খেলার মধ্যে একটি অভিজাত শহরের মুখটাই বার বার দেখতে পেলাম ।কিছু পথ যাচ্ছি আর বার বার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পথিককে দেখে গাড়ি থামাচ্ছি -ভাই পর্যটন মোটেল কোন দিকে ? তারা আমাদের ভাষা ঠিক বুঝলো কীনা জানিনা,তবে আঙ্গুল দিয়ে যে পথ দেখালো তার শেষ যে কোথায় ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।কেবল চলছিতো চলছিই ,তাও ভালো ; গাড়ি ভর্তি তেল ছিল। রাত যখন প্রায় দশটা তখন পুরো শহরে অন্ধকার নেমে এলো  ,সব দোকান বন্ধ হয়ে গেল ।পর্যটনে ফোন করে জানলাম ,আগে এয়ারপোর্ট রোড পেতে হবে তারপর মোটেল ।খুব অল্প সময় পর সিলেট ক্যাডেট কলেজ পাওয়া গেল শহরের একদম সীমান্তের কাছাকাছি ।গাড়ি ধীরে ধীরে ডানে টার্ণ নিল। মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে আলো খেলে গেল যেন ,পাহাড়ের গায়ে আলোকিত মোটেল সেই সাথে ঘন হয়ে আসা চাঁদের রূপালি আলো -আমরা সম্মোহনের মতোন নেমে পড়লাম -আহা, চায়ের দেশে রাত এতো স্নিগ্ধ হয়!

মোটেলে শুয়েই পড়ে নিলাম প্রকৃতি কন্যা জাফলং-এর ইতিবৃত্ত ।জাফলং, বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার অন্তর্গত যা  সিলেট শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে, ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত । এখানে পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন বলে এই এলাকা বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটনস্থল হিসেবে পরিচিত ।ঐতিহাসিকদের মতে বহু হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা-রাজার অধীনে থাকা এক নির্জন বনভূমি। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে জমিদারী প্রথার বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে খাসিয়া-জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটলেও বেশ কয়েক বছর জাফলংয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা পতিতও পড়েছিল। পরবর্তিতে ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌপথে জাফলং আসতে শুরু করেন, আর পাথর ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকলে একসময় গড়ে ওঠে নতুন জনবসতি। প্রকৃতি কন্যা হিসেবে সারাদেশে এক নামে পরিচিত এই জাফলং। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়। সীমান্তের ওপারে ইনডিয়ান পাহাড় টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম ধারায় প্রবাহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেলপানি, উঁচু পাহাড়ে গহীন অরণ্য ও শুনশান নিরবতার কারণে এলাকাটি পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে।

সিলেট শহর  থেকে ৬২ কিলোমিটার রাস্তা পাড় হতে প্রায় দু'ঘন্টা লেগে গেল ।শহরের রাস্তা মসৃণ হলেও সময় যতো এগুচ্ছিল পাহাড় গুলো ততো বেশী কাছাকাছি এসে পরছিল ।কিন্তু শেষ দিকে রাস্তা খুবই খারাপ লাগলো ,কিন্তু এর মধ্যে চোখে পড়লো এনার মতোন এসি বাস সার্ভিস। পথে যেতে যেতে দেখলাম বেশ কিছু পর্যটন হোটেল হয়ে গেছে। দশ বছর আগের দেখা সেই সিলেট আর নেই । সাধারণত বর্ষায় জাফলং এর রূপ লাবণ্য একটু ভিন্ন মাত্রায় ফুটে ওঠে। শীত আসি আসি করলেও দূর থেকে প্রবাহমান ঝর্ণার পানি কিন্তু চোখ এড়ালোনা ।আমরা সারাদিনের কন্ট্যাকে গাড়ি নিয়েছি তাই মাইক্রোবাসটি বাজারের ভেতরে রেখেই নেমে পড়লাম।

বাজার দেখতে ছোট খাট মনে হলেও এখানে সব কিছুই পাওয়া যাচ্ছে পর্যটকদের জন্য ।চড়া দামে বিক্রী হচ্ছে রোদ আগলানো বিশাল টুপি ।ক্যামেরা ঘাড়ে বেশ কয়েকজন ইয়াং গাইট এসে হাজির ; তাদের হাতে আবার জাফলং-এ ঘুরতে আসা দম্পতিদের হাসি হাসি ছবি ।এই ছবি দেখিয়েই তারা নিজেদের ট্যুরির্স্ট হবার যোগ্যতা প্রমাণ করে ।পাঁচ স্পট ঘুরলে একটি প্যাকেজ এবং ঘন্টা হিসেবে নিলে আলাদা প্যাকেজ ।পাঁচ স্পটের মধ্যে আবার মায়াবী ঝর্নাও আছে ,এই অসময়ে ঝর্নায় গিয়ে কী হবে ভেবে আমি বলে দিলাম -থাক ঝর্না বাদ দাও, ওখানে এখন পানি নেই ।গিয়ে লাভ হবে না ।

একটি ছেলে এগিয়ে এলো-আপনি কেবল আমার সাথে চলেন, পানির গ্যারান্টি আমার ।আমি হেয়ালি করে বললাম-আবার ফয়েজ লেকের মতোন কৃত্রিম ঝর্ণা দেখাইওনা। পিয়াইন নদীর বুকে ভেসে চলেছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা। মাঝি সেখানে দু'জন ,বয়স বেশি হলেও ছোট জনের সাত পেরুবেনা আর বড় জন সবে তেরোতে পড়লো ।আমি এহেন বলিষ্ঠ মাঝি দেখে হেসে উঠলাম-এই পানিতে চুবিয়া মাড়বি নাতো?

আমাদের গাইড রাসেল উত্তর শুনে খুব হাসলো-এই পানি বড় জোর আপনার গলা সমান হবে।

-কীরে সারা বছর এমনই থাকে নাকি?

-নাহ,ভরা বর্ষায় পানিতে ঢেউ ওঠে।

শান্ত নদীর সারা শরীর জুড়ে কেবল পাথর বোঝাই নৌকোর মেলা। এ যেন পাথরের হাট ,এক পয়সা দু পয়সা দিয়ে পাথর কেনা যাবে অনায়াসে ।নৌকো যখন পাড়ে ভিরলো তখন চোখ গিয়ে ঠেকলো বড় বড় পাথরের উপর খেলতে থাকা জলরাশির দিকে ।পানি আসছে মেঘালয়ের কোল ঘেষে বয়ে চলা কোন এক পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে ।শুধু দেশি পর্‍্যটক নয় ,ভীর করে আছে অনেক ভীনদেশি ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ।পাথর গুলো শ্যাওলা দিয়ে মাখানো ,তাই পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।কিন্তু যখন ঠান্ডা পানিতে বসে পড়লাম তখন অবাধ্য স্রোত ভিজিয়ে দিল হিমেল পরশে।আহা! ঝর্নার পানি এতো ঠান্ডা হয়। আবার রাসেলকে উদ্দেশ্য করে বললাম -কীরে, এই তোমার ঝর্না?

রাসেলের ঠোঁটে তখন রহস্যের হাসি খেলা করছে-আর একটু সামনে হাঁটেন ,ঝর্না পেয়ে যাবেন ।আমি বোধ করি বিশ্বাস করতেই পারছিলাম না এখানে ঝর্না থাকতে পারে ।তাই কিছু পথ হেঁটে যখন ক্লান্ত তখন মেঘালয়ের খোলা অরণ্যে খানিক্ষনের জন্য বসে পড়লাম ।আহা ,ভারতের মানুষ গুলো যাচ্ছে গাড়ি হাঁকিয়ে আর আমরা কী হতভাগ্য ,পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করতে হচ্ছে ।ছোট্ট একটা নদী পাড় হতেই ১২'শ টাকা গুনতে হচ্ছে নিরুপায় হয়ে।এখানে কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থাও নেই ,না আছে একটি খাবার হোটেল ,না আছে চেঞ্জিং রুম ,না আছে র‍্যাব অথবা বিডিয়ার ।দূরে চোখ রাখতেই অতি উচ্চতায় বি এস এস এফ-এর পাহাড়ামগ্ন চেহারাটা নজরে পড়লো ।

রাসেলের তাড়া খেয়ে আবার হাঁটছি ,বেশি হলে দশ মিনিট ।হঠাৎ কানে এসে ধাক্কা দিল হৈ চৈ উল্লাশের শব্দ ,তার মধ্যেই ঝপাৎ ঝপাৎ পানি পড়ার আওয়াজ আমাকে বুঝিয়ে দিল মায়াবতী ঝর্নায় এসে গেছি ।আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখলাম একটি পাহাড় সীমাহীন দাঁড়িয়ে , তার বিভিন্ন ওলি গলি পেরিয়ে পানি ঝরছেইতো ঝরছেই ।রাসেলকে ধন্যবাদ দিলে অনেক কমই হবে,ওর পাওনা কোন শব্দমালায় বাঁধা যাবে না ।ব্যাগে কাপড় নিয়েই এসেছি ,সুতরাং -আজ আর কোন নিয়ম মা্নছি না।মুহূর্তের মধ্যেই আমি কৈশরে ফিরে গেলাম, ঝর্না স্নানরত ছেলে মেয়েদের সাথে আরম্ভ করলাম জল স্নান।এমন শুদ্ধ আর সুন্দরের গোসল এক জীবনে বার বার আসে না ।

শুভলং ঝর্নার মতোন এখানে টিকিট কাটার ব্যবস্থা নেই ,নেই কোন চানাচুর বা চিপ্সের প্যাকেট ।কোন বাড়তি উতপাৎ নেই ,নিমিষেই আমরা হারিয়ে গেলাম বুনো অরণ্যে ।যেন স্কুল ফেরত এক দঙ্গল বাঙ্গাল ছেলে মেয়ে সুযোগ পেয়েই নাইতে নেমেছি ।কোন কোন সুড়ঙ্গের সামনে দাঁড়ালে পানির ধাক্কায় নিজেকে সামাল দেওয়াই মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল ।বেলা গড়িয়ে কখোন দুপুর নেমেছে সে খেয়াল আমার ছিল না, পেটে ক্ষুধা নামক কোন অনুভূতিও আক্রমণ করেনি ।রাসেল বার বার তাড়া দিচ্ছে-ম্যাডাম,খাসিয়া পাড়ায় যেতে হবে দেরী হয়ে যাচ্ছে ।

নদীর পাড়ে বেড়ে ওঠা বালু এতো চিক চিক করে রোদ পড়লে এবার বহু বছর পর দেখলাম ।আর মাঝে মাঝে জেগে উঠেছে চারা গাছ ।খালি পায়ে এখানে হাঁটা যায় না এতো গরম হয়ে আছে ।তবু আমি ভেজা পায়ে বালি মাড়িয়ে পাহাড়ের উপর উঠলাম। সরু রাস্তা ,তার সাথে ঘন ঘন বসতি ।এটাই খাসিয়াদের পল্লী ,এখানে আছে রাজবাড়ি তবে আমাদের জমিদার বাড়ির মতোন না ।সবটাই কাঠ দিয়ে গড়া ।সবাই বলছিল তিন চাকা নিয়ে পুরোটা ঘুরতে ,কিন্তু আমিই বাধ সাধলাম-ভ্যানে যাব,আস্তে আস্তে দেখতে দেখতে যাব।

পাড়াটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে কেবল চা বাগান বিছানো ।ততোক্ষনে সূর্য যাই যাই করছে ,আমিও সূর্যকে বন্দি করলাম ক্যামেরায় তার সাথে সবুজ চা পাতার অবারিত বয়ে চলা ।পাশেই হয়েছে মার্কেট যেখানে পশরা করে আছে -মালা,কানের দুল ,চাদর ,অনেকটা মিনি কক্সবাজার ।কেবল ডাবের পানি আছে ,সমুদ্র নেই ।সে পথেই সূর্যকে বিদায় জানিয়ে নদী পাড় হয়ে জাফলং বাজার এলাম ।তখনি পেট মহাশয়ের টনক নড়লো ,ঢুকে গেলাম বাংলা রেঁস্তোরায় ,হাত চুবিয়ে খেয়ে নিলাম ভাত ডাল দিয়ে মাছ ।

আগেই বলেছি পুরো সিলেট দেখা যাবে না এই দুই দিনে ।তবু যতোটা পারি সব জায়গা স্পর্শ করে যাব।পথেই পড়লো জৈন্তাপুর রাজবাড়ি,  শ্রীপুর এবং তামাবিল স্হলবন্দর। বিচ্ছিন্ন কিছু ছবি তুলে এগুতে লাগলাম ।

যারা ঢাকা থেকে সহজে যেতে চান তাদের জন্য কিছু কথা ঃ

ঢাকার কমলাপুর ও ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন থেকে প্রতিদিন ৩টা ট্রেন ছাড়ে সিলেটের উদ্দেশে। ট্রেনের ভাড়াপ্রকারভেদে ১২০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। আর সময় লাগবে ৭-৮ ঘণ্টা। ট্রেনে গেলে রাত ৯.৫০টার উপবন এক্সপ্রেসে যাওয়াটাই সব চেয়ে ভালো। এছাড়া বাসেও যাওয়া যাবে। বাসে যেতে চাইলে অনেক বাস আছে। এর মধ্যে শ্যামলি, হানিফ, সোহাগ, ইউনিক, গ্রীন লাইন উল্লেখযোগ্য। ভোর থেকে শুরু করে রাত ১২.৩০টা পর্যন্ত এসব বাস পাবেন। বাসে যেতে সময় লাগবে ৪ থেকে ৪ ঘন্টা ৩০ মিনিট। ননএসি ৩০০/৩৫০ টাকা। এসি ৯০০ টাকা পর্যন্ত।

থাকার জায়গা ঃ

থাকার তেমন বেশি সুব্যবস্থা জাফলং এ নেই। তবে যে কয়টি ব্যবস্থা আছে তার মধ্যে জেলা পরিষদের নলজুরী রেস্ট হাউস (থাকতে হলে পূর্বে অনুমতি নিতে হবে), শ্রীপুর পিকনিক স্পট উল্লেখযোগ্য। কিছু বোডিংয়ের ব্যবস্থা আছে। এছাড়া শ্রীপুর ফরেস্টে একটি বাংলো আছে পর্যটকদের থাকার জন্য।

এছাড়া জাফলংয়ে থাকার জন্য রয়েছে পর্যটন মোটেল, জাফলং। পাহাড়ের পাদদেশে ছায়াশীতল সুনিবিড় পরিবেশে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের নবতম সংযোজন এই জাফলং মোটেল। জাফলং মোটেলের কক্ষ ভাড়া ১,৮০০/- – ২,০০০/- টাকার মধ্যে। এটি বুকিং দিতে হলে যোগাযোগ করুনঃ ০২-৯৮৯৩৭১০ (বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের সেন্ট্রাল রিজার্ভেশন) (সংগৃহিত)

লালাখান

লালাখাল নৈসর্গের আর এক অপূর্ব দৃশ্য আমাদের জন্য গোধুলি লগ্নে অপেক্ষা করছিল ।স্বচ্ছ নীল জল রাশি আর দুইধারের অপরূপ সোন্দর্য্য ঘেরা লালাখান দেখে সত্যি মুগ্ধ হলাম । বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের স্থান এবং রাতের সৌন্দর্যে ভরপুর এই লালাখাল সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার কাছাকাছিই পড়েছে ।সারি নদীর স্বচ্চ জলরাশির উপর দিয়ে নৌকা অথবা স্পীডবোটে করে সহজেই লালাখানে যাওয়া যায় ।যাবার পথের অনাবিল দৃশ্য মন কেড়ে নিচ্ছিল ।লালাখান ফ্যাক্টরি ঘাটে যেতে সময় লেগেছে প্রায় ৪৫ মিনিট ।নীচের দিকে তাকিয়ে নীলচে পানির কালো বর্ণে রূপ নেওয়া দেখছিলাম ।ভারতের চেরাপুঞ্জির ঠিক নিচেই লালাখালের অবস্থান। অনভূত বিষয় হচ্ছে চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই নদী বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত।

সারিঘাটে নেমে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে যাওয়া যাবে লালাখাল। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৩০/৪০ টাকা( ওয়ান ওয়ে)। তবে, সবচেয়ে ভাল হয় ৮-১০ জনের একটা গ্রুপ নিয়ে গেলে। বড় নৌকায় সহজেই ১০/১২ জনের জায়গা হবে। এক্ষেত্রে, রাউন্ড ট্রিপে একটা নৌকায় ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকাতেই সেরে ফেলা যায় আসা যাওয়ার এই ভ্রমণ। যেতে আসতে লাগবে যথাক্রমে এক-এক দুই ঘণ্টা। সিলেট শহর হতে লালাখাল যাবার জন্য পাড়ি দিতে হয় ৩৫ কি.মি রাস্তা। বাস, মাইক্রো, টেম্পু যোগে সহজে যাওয়া যায় ।তবে  লালাখালে থাকার তেমন কোন সুবিধা নাই। সাধারনত পর্যটকরা সিলেট শহর হতে এসে আবার সিলেট শহরে হোটেলে রাত কাটায়।

হযরত শাহজালাল (র.) মাজার

সিলেট ঘুরবো কিন্তু মাজার দেখবোনা তাতো হতে পারেনা । তাই পরদিন সকাল সকাল চলে গেলাম হযরত শাহজালাল (র.) মাজারে ।হযরত শাহজালাল(র.) ছিলেন উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত দরবেশ ও পীর। সিলেট অঞ্চলে তার মাধ্যমেই ইসলামের প্রসার ঘটে। সিলেটের প্রথম মুসলমান শেখ বুরহান উদ্দিনের ওপর রাজা গৌর গোবিন্দের অত্যাচার এবং এর প্রেক্ষিতে হযরত শাহজালাল (র.) ও তাঁর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ কারণে সিলেটকে ৩৬০ আউলিয়ার দেশ বলা হয়। কেউ কেউ সিলেটকে পূণ্যভূমি হিসেবে অভিহিত করেন।

শাহ পরাণের মাজার

শাহ পরাণের মাজার সিলেট শহরের একটি পুণ্যতীর্থ বা আধ্যাত্মিক স্থাপনা। যা হচ্ছে ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্য হতে বাংলাদেশে আসা ইসলাম ধর্ম প্রচারক শাহ জালালের অন্যতম সঙ্গী অনুসারী শাহ পরাণের সমাধি।এটি সিলেট শহরের পূর্ব দিকে খাদিম নগর এলাকায় অবস্থিত। শাহ জালালের দরগাহ থেকে প্রায় ৮ কি.মি. দূরত্বে শাহ পরাণের মাজার অবস্থিত। শাহ জালালের দরগাহর মতো এ মাজারেও প্রচুর দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। ঐতিহাসিক মুমিনুল হকসহ অনেকেই লিখেছেন; সিলেট বিভাগ ও ভারতের বিভিন্ন এলাকায় শাহ পরাণের দ্বারা মুসলিম ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার হয়েছে।

মালনীছড়া চা বাগান

পর্যটন মোটেল থেকে বের হয়ে খানিক এগুলেই মালনীছড়া চা -বাগান চোখে পড়বে ।আমরা গিয়েছিলাম ঢাকায় ফেরার পথে । শহরের কেন্দ্রস্থল জিন্দাবাজার পয়েন্ট হতে গাড়িতে মাত্র ১৫ মিনিটের পথ। মালনীছড়া উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান যা শহরের মধ্যেই অবস্থিত ।  ১৮৪৯ সালে এই চা বাগান প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে বেসরকারি তত্ত্বাবধানে চা বাগান পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৫০০ একর জায়গার ওপর এই চা বাগানটি অবস্থিত। চা বাগানের পাশাপাশি বর্তমানে এখানে কমলা ও রাবারের চাষ করা হয়। মালনীছড়া চা বাগান ছাড়াও সিলেটে  লাক্ষাতুড়া চা বাগান, আলী বাহার চা বাগান, খাদিম, আহমদ টি স্টেট, লালাখাল টি স্টেট উল্লেখযোগ্য।

সিলেটে দর্শনীয় স্থানের তালিকা:

১। জাফলং (জিরো পয়েন্ট, মারি নদী, চা বাগান, খাসীয়া পল্লী)
২। হযরত শাহজালাল (রা.) ও হযরত শাহ পরাণ(রা.) এর মাজার শরীফ
৩। জৈন্তাপূর (পুরানো রাজবাড়ী)
৪। মাধব কুন্ড ও পরীকুন্ড জলপ্রপাত
৫। শ্রীমঙ্গল (চা বাগান, লাওয়াছরা বন, মাধব পুর লেক)
৬। লালাখাল
৭। তামাবিল
৮। হাকালুকি হাওড়
৯। কীন ব্রিজ
১০। ভোলাগঞ্জ
১১। মহাপ্রভু শ্রী চৈত্যনো দেবের বাড়ি
১২। হাছন রাজা জাদুঘর
১৩। মালনী ছড়া চা বাগান
১৪। ড্রিমল্যান্ড পার্ক
১৫। আলী আমজাদের ঘড়ি
১৬। জিতু মিয়ার বাড়ি
১৭। মুনিপুরী রাজবাড়ি
১৮। মুনিপুরী মিউজিয়াম
১৯। শাহী ঈদগাহ
২০। ওসমানী শিশু পার্ক
২১। হামহাম জলপ্রপাত
২২। সাতছড়ি অভয়ারণ্য
২৩। রেমা উদ্দ্যান
২৪। এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং
২৫। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম এর বাড়ি
২৬। মির্জাপুর ইস্পাহানী চা বাগান
২৭। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট
২৮। নীল কন্ঠ ( ৭ রংঙের চা)

আমি সময় মেলাতে পারিনি বলেই অনেক কিছু না দেখেই ফিরে এসেছি ।হয়তো সময় করে আরো একবার যাব ।এখানে দর্শনীয় স্থান গুলো এক নিমিষে দেখে নিতে পারে ।