দেশের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিল ’আয়নাবাজি’

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 12 Oct 2016, 07:39 PM
Updated : 12 Oct 2016, 07:39 PM

বাড়ির কাছে ব্লকবাস্টার হলগুলোতে ঢুঁ মেরেও যখন দেখা যায় দুই দিনের টিকিট হাউজফুল হয়ে গেছে তখন স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে -কী আছে এই সিনেমায়? এতো দর্শক কেন? একদিকে ট্রাফিক জ্যাম আর অন্য দিকে দর্শকের জোয়ার উপেক্ষা করে বিকেল চারটা থেকে দাঁড়িয়ে থাকলাম একটি টিকিটের প্রত্যাশায়। পোস্টারের দিকে যতোবার তাকাচ্ছিলাম বোঝাই যাচ্ছিল -চঞ্চল চৌধুরী একসাথে বেশ কয়েকটা চরিত্রের উপস্থাপন করেছেন। গত ৭ অক্টোবর মুক্তি পেয়ে যে সিনেমা দুই সপ্তাহ ধরে হাউজফুল চলছে তাতে নিশ্চই এমন ম্যাটারিয়াল আছে যা দর্শক ধরে রাখতে পেরেছে ।

আয়নাবাজি সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে ঢাকা শহরের অনেকগুলো পরিচিত স্থানে । দুই ঘন্টা চল্লিশ মিনিটের ছবিটি পরিচালনা করেছেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী ।যৌথভাবে প্রযোজনায় আছে কন্টেন্ট ম্যাটারস লিমিটেড এবং  হাফ স্টপ ডাউন ।চলচ্চিত্রের কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছেন সৈয়দ গাওসুল আলম শাওন, অনম বিশ্বাস এবং সংলাপ লিখেছেন আদনান আদিব খান। সার্থকতার সাথে চিত্রগ্রহন করেছেন রাশেদ জামান ।

সিনেমার গল্পটা আর দশটা গতানুগতিক সিনেমার মতোন নয় ।জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া একজন অসহায় যুবক যে কীনা জীবনের প্র্য়োজনে অন্যের হয়ে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ায় আর বিচারক যে রায় দেন তাই মাথা পেতে নেয় শুধুমাত্র অর্থের বিনিময়ে ।সিনেমার শেষ থেকে যদি আলোচনা আরম্ভ করি তবে দেখা যায় পূর্ণ দৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্রে একজন নেতিবাচক চরিত্রের জয় দিয়েই ছবিটি শেষ করা হয়েছে। আয়না অর্থাৎ চঞ্চল যার মা অসুস্থ, কিন্তু ঠিক সময় মতোন টাকা জোগার করতে না পারায় সে মাকে হারিয়ে ফেলে। এরপর থেকে সে যে পথ ধরে হাঁটা শুরু করে তা মোটেও মসৃণ নয়। দাগী আসামিরা তাকে ভাড়া করে অন্যের হয়ে জেল খাটার জন্য। ছোট্ট একটা স্কুল চালায় যেখানে বাচ্চাদের অভিনয় শেখায় কিন্তু মঞ্চে বা টিভিতে সে কাজ করে না ।সবাই জানে সে জাহাজের কুক, কিন্তু  যে পথে সে আয় করে তা আসলে কোন বিলাসিতার জন্য নয়  তা স্পস্ট তার সাধারণ জীবন প্রণালিতে। আয়নার চলাফেরা খুব সাধারণ, বেশীরভাগ সময় তাকে ফুলহাতা শার্ট এবং সাদামাটা প্যান্টে দেখা যায়। তাহলে এই বিপথে যাবার কারণ কী কেবলই ফেঁসে যাওয়া নাকি সমাজের প্রতি একধরণের জেদ তা বোঝা যায়নি।

তার জীবনে যখন হৃদি নামক একটি মেয়ের আগমন ঘটে তখন সে প্রথম নিজেকে বদলে ফেলার তাগিদ অনুভব করে যদিও শেষ পর্যন্ত বদলাতে পারেনি। হৃদির চরিত্র এই গল্পে কেবলই একজন নারী । তার কোনো পরিচয় এখানে পাওয়া যায়নি, সে পুরনো ঢাকার একজন ভাড়াটিয়া হিসেবেই পুরো ছবিতে অবস্থান করেছে। এমন কি সত্য জানার পর বেশির ভাগ সিনেমাতে নায়িকার কারণে যেমন নায়ক তার নিজের সঠিক পথ খুঁজে নেয় এই ক্ষেত্রে তা হয়নি। আইন-শৃংখলা বাহিনীর নাকের ডগার উপর দিয়েই চলতে থাকে আয়নাবাজের ভেলকিবাজি।

গল্পের আসল মজা আরম্ভ হয় বিরতীর পর, যখন নেতা আয়নাকে বাড়ি থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসে ।দর্শক হিসেবে মনেই হতে পারে এবার বুঝি আয়না আর বিপথে ফিরছে না, কিন্তু আয়না তার অসাধারণ ইন্টারচেঞ্জ ফুটিয়ে তোলে। কন্ডেমসেলের ভেতর বসে পাহাড়াদারকে সম্মোহন করে তাকে কয়েদে পুরে আয়না পালিয়ে যায়। পরিচালক বোঝাতে চেয়েছেন -অপরাধীরা ভেতরে থাকে না, বাইরে থাকে। তার এই বক্তব্য প্রতিষ্ঠায় আয়নাবাজি নামকরণ সার্থক ।

এই সিনেমার অন্যতম আকর্ষন হচ্ছে-দৃশ্যায়ন। অনেক নামী পরিচালকের ক্যামেরাতেও এতো রকম ভিন্ন এংগেলে একটি দৃশ্যকে উপস্থাপন করা হয়নি। আয়নাবাজিতে প্রতিটি দৃশ্য বিভিন্ন এঙ্গেলে দেখানো হয়েছে যা সত্যি দৃষ্টিনন্দন। বাড়ির সামনে এসে হোন্ডা থামানোর দৃশ্যটা নেওয়া হয়েছে একটি দেওয়ালের উপর থেকে ।সাধারনতো আমরা সোজা ভাবেই সব কিছু দেখতে পছন্দ করি, কিন্তু দেখার এই অভিনব কায়দা আসলেও খুব ভালো লেগেছে। চির চেনা ঢাকা শহরকে মনে হয়েছে আবার নতুন ভাবে দেখছি। ড্রোন ক্যামেরার ব্যবহারে দুর্দান্ত লং শট,  আসামী বদল (যদিও অবিশ্বাস্য ), খোলা ছাদের দৃশ্য (ওয়াড শট), ঝুম বৃষ্টিতে চঞ্চলের কান্না, জমজমাট বাজার তুলে ধরা, চঞ্চলের সাজ-সজ্জার ক্লোজশট, সব কিছুতেই পাকা হাতের ছাপ পাওয়া যায়।

যারা মনপুরা দেখেছেন তাদের আর নতুন করে চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই যদিও পাবনার আঞ্চলিক ভাষা থেকে তাকে আলাদা করা সত্যি কঠিন হয়ে পড়েছিল বেশ কয়েক বছর। আয়না চরিত্র দর্শকদের সেই সুযোগ করে দিল ।একটি চরিত্র থেকে আর একটি চরিত্রে ঢুকে পড়তে খুব সময় লাগেনি চঞ্চলের ।এর পেছনে তার দীর্ঘ সময়ের অধ্যাবসায় একমাত্র প্রধান কারণ ।এক ছবিতে একসাথে ছয়টি চরিত্রে অভিনয় করা চারটি খানি কথা না। পোস্টমাষ্টার চঞ্চল যখন নাবিলার হাতে চিঠি দেন তখন একটু ধাক্কাই লাগে দর্শক হিসেবে ,এতোটা সাবলীল অভিনেতা আসলেও কম আছে এই দেশে। ক্রাইম রিপোর্টারের সাথে তার কমেডি সংলাপ হাততালি কেড়ে নেয়। হাসপাতাল থেকে মাথায় ব্যন্ডেজ দিয়ে ভেলকি দেখানো ,পা দিয়ে হোন্ডা বানানো দর্শকের মধ্যে হাসির ফোয়ারা তোলে।তবে নাবিলার সাথে চুম্বন দৃশ্যতে  চঞ্চল একটু শেকি ছিল তা ভালোই বোঝা গেছে ক্যামেরায় । পুরো সিনেমায় সেরা পার্ফর্মেন্স তিনি দেখান যখন নেতার সাথে কথা বলার সময় ইন্টারচেঞ্জ হয়ে নিজেই নেতার ভঙ্গিমায় কথা বলেন ।বলা যায় পুরো সিনেমা্র চরিত্রগুলোকে পোস্টমর্টেম করলে এই একজন অভিনেতাকেই পাওয়া যাবে ।

সিনেমার নায়ক যখন কেন্দ্রে তখন এই ধরণের সিনেমায় কোন নায়িকার প্রয়োজন পরে না।কেবল আয়নার মানসিক অবস্থা দেখানোর জন্যই একটি নারী চরিত্র রাখা দরকার সেটাই হৃদি অর্থাৎ নাবিলা। আদতে হৃদিকে, পুরনো ঢাকায় তার আগমনের কারণ, হুট করে আয়নার প্রেমে পড়ে সিলেট বেড়ানোর পরিকল্পনা করা একেবারেই অবিশ্বাস্য ঠেকেছে। ঘটনার পেছনের গল্প তুলে ধরবার জন্য অনেক সময় ছিল, কিন্তু এই চরিত্রের শুরু বা শেষ কিছুই পরিষ্কার নয়। তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিটা কী তা বোঝানো হয়নি। বাবার মৃত্যূর পরে নাবিলার এক্সপ্রেশন দর্শকদের মন কাড়তে সক্ষম হলেও শেষ বেলায় তার দ্বারাই আয়না সঠিক পথে ফিরে আসবে এমনটা বাঙালি ইমোশন্যাল জাতি আশা করতেই পারে। যেহেতু এটা প্রেমের সিনেমা নয় তাই এই নারী চরিত্রের কোন মূল্যায়ন করা হলো না। সর্বোপরি হৃদি চরিত্রে নাবিলাকে বেমানান লেগেছে । নাবিলা অনেক বেশি পার্সোনালিটি সম্পন্ন নারীর নাম ভূমিকায় যায় ।তার চোখ, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং উচ্চারণ নারী কেন্দ্রিক চরিত্র রূপায়নে সক্ষম ।

ছোট ছোট চরিত্রের মধ্যে স্টুডিওতে থাকা বাচ্চা ছেলেটাকে কিন্তু খুব ভালো লেগেছে ।ও ক্যামেরায় আসা মাত্র দর্শক হাততালি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে ।নারী নির্যাতনের স্বীকার ইফফাত তৃষার অভিনয় মনে রাখার মতোন ।শুরুর দিকে ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে পার্থ বড়ুয়ার চরিত্রের গতি নির্ধারণ না করা গেলেও শেষ পর্যন্ত সে আয়নার ভেলকি বাজি ধরতে পারে ।সে আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়,সেই ব্যর্থতা পার্থ পরিষ্কার ভাবেই প্রকাশ করতে পেরেছেন তার অভিনয় গুণে । সে কিভাবে আয়নার আসল পরিচয় জানতে পারল এ নিয়ে  অবশ্য খটকা থেকে যায়। ব্যর্থ রিপোর্টারের বৌ হিসেবে বিজরীর একবার আগমন বিজলী চমকিয়ে দিল । তৃষার বাবার চরিত্রে যিনি ছিলেন তাকে দেখে মনে হয়েছে প্রশ্ন করার আগেই উত্তর দিয়ে ফেলছেন, ভালো লাগেনি। এছাড়া অন্যান্য চরিত্র – পারভার্ট বসের চরিত্রে লুৎফর রহমান জর্জ, স্টুডিও মালিক শাওন, কমেডি চরিত্রে জামিল, পুলিশ গার্ডের চরিত্রে বৃন্দাবন দাস ভালো করেছেন। আর অতিথি চরিত্রে আরিফিন শুভ দর্শকদের যথারীতি মন জয় করেছেন ।

আয়নাবাজির সংলাপ ছিল খুব তীক্ষ্ম। আয়নাকে বাঁচাতে ব্যর্থ রিপোর্টারের প্রশ্নের এক জবাবে পত্রিকার সম্পাদক বলেন-ক্রিমিনালরা বাইরেই থাকে ।এর মধ্য দিয়ে হয়োতোবা পরিচালক এই দেশের বর্তমান চিত্রটাই তুলে ধরতে চেয়েছেন । সম্পাদনা ও শব্দগ্রহন ছিল একদম  ঠিকঠাক। আয়নার বিভিন্ন চরিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন তারিক আনাম খান, আলী যাকেরদের মতো সেরা অভিনেতারা। তাদের ডাবিং রেকর্ডও ভালো হয়েছে।

আয়নার মেকাপ এক কথায় বিস্মিত করার মতোই । কোলকাতার মোহাম্মদ আলী এই জায়গাতে  দারুণ কাজ করেছেন। চঞ্চলের প্রতিটি চরিত্রে আলাদা আলাদা মেকআপ এবং সবগুলোই ছিল একটা আরেকটার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেন ছয়জনকে ছয়ভাবে সাজানো হয়েছে। আর পোশাক প্রত্যেকটি মেকাপের সাথে ছিল মানানসই। অন্য সবার পোশাক স্বাভাবিক লাগলেও নাবিলার চরিত্রকে যদি সাধারণ মধ্যবিত্ত নারী হিসেবেই তুলে ধরা হয়, বিশেষ করে পুরনো ঢাকার, তবে তার ওড়না ছাড়া দৃশ্যগুলো কোন ভাবেই চরিত্রের সাথে যায়নি ।পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে পার্থ বড়ূয়ার পোশাক ও মেকাপ একদম মানিয়ে গেছে ।জেল হাজতের প্রথম দিকে চঞ্চলের পরণের পোশাক কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করলেও শেষ অবধি তা একশোতে একশো পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।

সিনেমার মূল আকর্ষণ অনেক সময় গানে থাকে। এই সিনেমার গানগুলো খুব মুখে মুখে শোনা না গেলেও লিরিক্স বেশ বাস্তব সম্মত । ছবির আবহসঙ্গীত পরিচালনা করেছেন কোলকাতার ইন্দ্রদীপ আর সঙ্গীৎ পরিবেশন করেছেন অর্ণব, ফুয়াদ, হাবিব ও চিরকুট ব্যান্ড। অর্ণবের "প্রাণের শহর" দিয়ে ঢাকার বিভিন্ন লোকেশন দিয়ে চিত্রায়ন খুব মুগ্ধ করেছে । জেলখানায় চিরকুটের "দুনিয়া" আর  কোরিওগ্রাফি ছিল অসাধারণ। চঞ্চল-নাবিলার রোমান্টিক সিন পূর্ণতা পেয়েছে  হাবিব-অন্বেষা জুটির "ধীরে ধীরে যাও সময়"  গানটিতে । ফুয়াদের কন্ঠে "লাগ ভেলকি লাগ" আয়নাবাজিকে গতিশীল করেছে নির্দ্বিধায়।

পরিশেষে পরিচালক অমিতাভ রেজাকে অভিবাদন না জানালেই নয়। তিনি কোটি দর্শককে ইউটিউব থেকে সোজা সিনেমা হলের সামনে দাঁড় করিয়েছেন। গরমের মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখতে পেরেছেন। শুধু তাই নয়, ২৫০ টাকায় বলাকা সিনেমা হলে এসি ছাড়াই বসিয়ে সিনেমা দেখতে বাধ্য করেছেন। সিনেমার সমাপ্তি ঘটে  একজন বিপথগ্রস্থ নেতিবাচক চরিত্রের জিতে যাওয়ার আনন্দ নিয়ে তাই প্রশ্ন থেকেই যায়, এই সিনেমা যদি বহিঃবিশ্বে প্রচার করা হয় তাহলে আমাদের দেশের আইন-শৃঙ্খলার নাজুক অবস্থার চিত্রটাই কী অধিক প্রাধান্য পাবে না? প্রশ্নটা পরিচালকের জন্যই রেখে গেলাম ।