অমর একুশে বইমেলা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু অভিজ্ঞতা

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 1 Feb 2017, 04:30 PM
Updated : 1 Feb 2017, 04:30 PM

"আমার আকাশ মেঘে ঢাকা
জমতে থাকা আগুন;
একটু আলোর পরশ পেলেই
ঝরবে রোদের ফাগুন।।"

এমন এক ফাগুন দিনেই ইচ্ছে করেছিল বসন্ত বাতাসে নিজের লেখা গুলো ছড়িয়ে দিতে । ২০১০ সালের কথা, তখন এমন ভিড়ভাট্টা লেগে থাকতো না রাস্তা-ঘাটে। দিনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছি আজিজ সুপার মার্কেটে আড্ডা দিয়ে। পত্রিকায় লেখার পাশাপাশি যেটুকু সময় পেতাম তার অধিকাংশ সময় কাটাতাম বাংলা ব্লগে । তখন প্রথম আলো ব্লগ জীবিত ছিল, সোচ্চার ছিল তার ব্লগ সঞ্চালকেরা । তাদের দুই জনই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই । যেহেতু কবিতা লেখা দিয়েই ব্লগিং আরম্ভ করেছি তাতে করে দীর্ঘ তিন বছর প্রথমালো ব্লগ আর ছয় বছরে সামহোয়্যার-ইন ব্লগে কবি খেতাব কেমন করে যেন গায়ে লেগে গেল। আর সেই খেতাবকে সার্টিফিকেট দিতে কিনা ঠিক মনে নেই, ঝাঁপিয়ে পড়লাম কবিতার বই করতে। এখন যদি হতো তবে নিশ্চিত করে বলতে পারি আমার প্রথম বই 'ফাগুনঝরা রোদ্দুর', আমি কোনকালেও আলোতে আনতাম না। কারণ এতো কাঁচা সেই হাতের লেখা, মনে পড়লেই হাসি পায়। কিন্তু ভাষাচিত্র প্রকাশনী কোন এক অজানা কারণে এই অখাদ্য প্রকাশ করেছিলেন। বইয়ের ফ্ল্যাপ লিখে দিয়েছিল -মাহবুব মোর্শেদ। এখন ও কালের কন্ঠে আছে । তখন আমি জানতাম না- ফর্মা কী? ৮০ গ্রাম, ১০০ গ্রাম সম্পর্কেও কোন ধারণা ছিল না। কেবল বইমেলায় গিয়ে হা করে হুমায়ুন আহমেদ স্যারের রহস্যময় মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। একজন লেখক তার ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছেন, কী লম্বা লাইন সেখানে। মুগ্ধতা খেলে বেড়াতো আমার চোখে-মুখে। আচ্ছা এতো বড় লেখক জীবনের প্রথম বইটি কি টাকা দিয়ে করেছিলেন? হবে হয়তো, নইলে এমন রিস্ক কোন প্রকাশক নেবে! তাই আমিও ভাষাচিত্র চাওয়া মাত্র ত্রিশ হাজার টাকা গুনে গুনে দিয়ে দিলাম, কারন আমার জন্য কেউ ঝামেলায় পড়ুক তা আমি চাইনি। তিনি কথা দিয়েছিলেন পরের বছর উপন্যাস করে দেবেন। আমার উপন্যাস কিন্তু কবিতার মতোন অখাদ্য না হলেও সেটা আর প্রকাশিত হয়নি, এ নিয়ে বহু কথা বলা হয়ে গেছে। শুধু এইটুকুই বলবো বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন তৌহিদ হাসান। অসাধারণ ছিল তার কল্পনাশক্তি ।

২০১১-তে আমি আর কোন বই বের করিনি। ব্লগ থেকেই সংকলন করা হয়েছিল । ওখানেই 'নগ্ন মৃত্তিকা' উপন্যাসটি ছোট গল্প হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল । বাংলা একাডেমির দূর্নীতির ইতিহাস তখন এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। বেশ শিক্ষিত লোক জনই বই প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কাউকে পাণ্ডুলিপি পড়তে দিয়ে শুনিনি- নারে ভাই, আমার এতো সময় কোথায় সবার পাণ্ডুলিপি পড়ে দেখবার। আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে কিন্তু অনেক সময়! তারা মাঠে বই পেতে বসে আছে- কে কার ধর্মে আঘাত দিল আর ধর্ম বলতে তো সেটা ইসলাম। আপনি হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে লিখে ভরিয়ে ফেলুন তাতে কেউ আপনার ঘাড় থেকে মাথা ফেলে দেবে কীনা সেটা আজো অজানাই রয়ে গেল। কিন্তু বেশীরভাগ নব্য প্রকাশক পাণ্ডুলিপি পড়তে নারাজ। তাদের এক হাতে থাকে মোটা অংকের টাকা আর অন্যহাতে থাকে পাণ্ডুলিপি। সেটা হতে পারে কোনো সেলিব্রেটির বই যিনি হয়ত সারা বছর নাটক ছাড়া কিছুই করেননি। সেটা হতে পারে কোন নেতার বই যিনি লিডারের পা চেটে প্রতিটা পাতা ভরিয়ে ফেলেছেন। কার লেখা, কী লেখা সেটা মূখ্য নয় । এখন মূখ্য হলো-পয়সা। আমি এমন দেখেছি -অনেক লেখক ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দেন, প্রকাশকদের সাথে জীবনেও তাদের দেখা হয় না। অনেক প্রকাশক তাদের লেখা ডলার হিসাবে মূল্যায়িত করে, কেউ ছাপায় ,তাতে ১০০ গ্রাম গেল নাকি ৮০ গ্রাম গেল সেটা দেখার সাধ্য ওই প্রবাসীর নেই। বিশ্বাসটাই তখন সম্পর্কের আসল কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, বেলা শেষে গুটি কয়েক বই হাতে স্তব্ধ হয়ে যায় সেই প্রবাসী লেখক যার চোখ ভরা ছিল হাজার রঙের স্বপ্ন ।

দেখতে দেখতে ২০১৫ চলে এলো। এবার ভাবলাম, অনেক দেখেছি, আর টাকা দিয়ে নয়। বই হবে মান -সম্মত, আমি লাভও নেব না, লোকশানও গুনবো না। নিজের অর্ধেক বই নিজেই কিনে নেব। পরিচয় হলো যমুনা প্রকাশনীর সাথে। তারা অবশ্য একাডেমিক বই বেশি করেন। তবু আমার লেখা কিছু গল্প নিয়ে 'রোদ্দুরের গল্প' আর দ্বৈত কবিতার জন্য 'নীলপদ্ম' করে দিলেন। তবে বিধাতা সহায় না থাকলে যা হয়, অনেক বই থাকার পরও সেবার তারা স্টল পেল না। কিন্তু সুখের বিষয় পাবলিক লাইব্রেরিতেই আমার রোদ্দুরের গল্প সর্বাধিক বিক্রি হয়ে গেল। একেই বুঝি বলে কপাল, বই মেলার বাইরেও বই বিক্রি হচ্ছে।

বাংলা একাডেমিতে কম বই নিয়েও স্টল বরাদ্দ পেয়েছে, এমন কাহিনী বেশ কয়েকবার এসেছে। এটা নিয়ে অনেক প্রভাবশালী প্রকাশকদের সাক্ষাতকারও নেওয়া হয়েছে। তাদের দূর্নীতির ইতিহাস  কারোই এখন অজানা না, তারপরও  সেই একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি হয়েছে। এমন কি কার স্টল কোথায় পড়বে তা নিয়েও আছে নিপূণ ছক। আমি অবশ্য এইসব ছকের ভেতরে বেশি যাই না। মামুলি লেখক মানুষ। জাহাজের খবর নেবার প্রয়োজনটা কী! তবে প্রতি বছর প্রকাশকদের কাছ থেকে সেই একই অভিযোগ আসে- বইমেলা শুরু হয় ৩ টায়, আর রাত ৮টা বাজতেই সব আলো নিভে যায়। গতবারতো এমন হলো  যে, আমি একটু টয়লেটে যাব তার জন্য এক ফোঁটা পানিই পাচ্ছিলাম না। যেদিকে তাকাই কেবল পুলিশ আর পুলিশ ।

গল্পের বইতে ভালো রকম সাড়া পেয়ে আমি অতি উৎসাহে লিখলাম-'চলতি পথের গপ্পো' যেটা একেবারেই শহুরে জীবনকে কেন্দ্র করে লেখা । সাথে কবিতার পাণ্ডুলিপি তৈরি করতেও ভুলে গেলাম না, কারণ কবিতা আমার জীবনের সাথে মিশে আছে। অবশ্য গতবছর ইংরেজী অনুবাদ করেই পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছিলাম – 'নিমগ্ন গোধূলী '। পুরো বছর ধরে আমি এই দুইটি বইকে নিজের মতোন করে সাজিয়েছি, কিন্তু তার বাস্তবের রূপ দেবে তো প্রকাশক। তাই আবারো গদ গদ হয়ে যমুনা প্রকাশনীতেই হাজির হলাম। সেবার কিছুটা আশাই ছিল – বই ভালো চললে কিছু তো সন্মানী পাব। কিন্তু বইমেলার দ্বিতীয় দিন যখন নিমগ্ন গোধূলি হাতে নিলাম মনে হলো প্রত্যেকটি পাতা খুলে খুলে পড়ে যাচ্ছে, ভেতরের পাতা উল্টাতেই দেখি -ছাপাখানার কোন চিহ্ন সেখানে নেই। কেবল কম্পিউটারে কম্পোজ করে বইটি মেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি খুব দ্রুত সব ক'টা বই হাতে নিলাম। সেই একই অবস্থা, মাথা ঘুরছিল, কিছুই চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কি করবো? কোথায় যাব? কে এই মুহূর্তেকে আমার বইয়ের দায়িত্ব নেবে? আমি সব বই সরিয়ে ফেলতে বললাম ।

সে রাতেই জানতে পারলাম বিদ্যা প্রকাশের কর্ণধার দেশে ফিরেছেন । মজিবুর রহমান খোকা ভাইয়ের সাত্থে আমার জীবনে কোন দিন দেখা হয়নি, ফেইসবুকে যেটুকু পরিচয়। আমি অনুনয়ের সুরে আমার গল্পের বইয়ের পাণ্ডুলিপি তাকে ই-মেইল করে দিলাম আর কবিতার বইয়ের দায়ি্ত্ব দিলাম আমাদের প্রকাশনী – অন্যধারায় । ধ্রুব এষের করা প্রচ্ছদ  আমার হাতে আগেই ছিল, তাই প্রকাশকদের ওই ঝামেলা পোহাতে হয়নি। পোহাতে হয়েছে বানানগত ঝামেলা। আমি বাংলা বানানে অসম্ভব কাঁচা আর এর আগেই যমুনা প্রুফ না দেখিয়েই প্লেট করে ফেলেছে। সব মিলিয়ে এমন বিশৃংখল অবস্থা, কিন্তু প্রেসে গিয়ে আমার কাজ করা সম্ভব না । না হলে আমিই কাজ করা শুরু করতাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে খোকা ভাই মাত্র তিন দিনে 'চলতি পথের গপ্পো' স্টলে নিয়ে এলেন। কথা মতোই আমি একশ কপি কিনে নিয়েছিলাম, কিন্তু সব চাইতে লজ্জার বিষয় ওই স্টলে আমার কোন বই বিক্রী হতো না। যাও বা হতো তাও খুব পরিচিত বন্ধুরা নিত। হবে কীভাবে, ডঃ মোহিত কামালের (স্কু্লের বড় ভাই) মতোন বড় বড় লেখকদের বই ওখানে শোভা পাচ্ছে, আমি ভীষন অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। বার বার স্টলের সেলসের ছেলেরা মুখ টিপে হাসছে, আমি ঘেমে নেয়ে অস্থির। মাঘ মাসের শীতও যেন আমাকে শান্ত করতে পারছে না। খোকা ভাই প্রচণ্ড রকম যত্ন করতেন মেলায় গেলেই, কিন্তু আমি বেশিক্ষণ বসতে চাইতাম না। আমার সব পাঠক তখন ভিড় করে আছে অন্যধারা প্রকাশনীতে, মনে হচ্ছে কবিতার বই যেভাবেই হোক পড়তেই হবে। আমার বলতে ইচ্ছে করতো- কিছু গল্প পড়ে যাও বন্ধুরা। কিন্তু তা কি আর বলা যায়!

এতো বিব্রতকর পরিস্থিতির পরে কি আর খোকা ভাইকে বলা যায় ২০১৭ সালে আরো একটি বই প্রকাশ করে দেবার জন্য। তাই আমি যত সিনিয়র লেখক আছেন তাদের কাছ থেকে জয়তী প্রকাশনীর ঠিকানা নিলাম যেটা পায়েল চালায়। বয়সে তরুণ হলেও তার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সাথে লাভ ক্ষতির হিসেব আসে, কিন্তু আমার মতোন রিস্কি লেখকের বেলায় তা খাটে না। তাই আগের মতোন বলেই দিলাম- চিন্তা করো না, অর্ধেক বই আমিই কিনে নেব। কারণ প্রকাশক বার বার ইঙ্গিত করছিল- ফেইসবুক বা ব্লগে কোন দিন বই সেল হয় না। অবশ্য বই সেল নিয়ে তার ভাবনার চাইতে আমাদের ভাবনা অনেক বেশি। আমি পুরো টাকাই এডভান্স করে দিলাম এক মাস আগেই । কেউ কেউ খ্যাতির জন্য জন্মায় পৃথিবীতে, কেউবা টাকার জন্য, আর আমাদের মতোন ইমোশন্যাল গাধারা জন্মায় নিজের মনের আনন্দ মেটাবার জন্য।

হাতের মধ্যে কেউ যদি হীরক খণ্ড রেখে দিয়ে বলে- নে মেয়ে তোকে বর দিলাম, কিন্তু মীন রাশির জাতিকা নির্ঘাত বলবে-আমি তোমার এই বর চাই না।আমি চাই অরিজিন্যাল বর। মানে দাঁড়াচ্ছে, মনের বিরুদ্ধে একটা কাজও এদের দিয়ে করানো যায় না। পকেটে পয়সা থাকুক বা না থাকুক – বই চাই। ঝকঝকে তকতকে, পরিষ্কা্র ঝলমলে একটা বই যেটা বুকে নিয়ে আমি সারা রাত ঘুমাবো। আর বন্ধুরা যখন বই মেলায় যাবে, অটোগ্রাফ দেব এবং সেলফি তুলবো। কতো টাকা গচ্ছা গেল প্রকাশকের সেই চিন্তা তার, তাই সে কোনো রিস্কে যায় না। লেখকের কাছ থেকে পুরো অংক হাতে রেখেই কাজ আরম্ভ করে, কারোটা বা সঠিক সময়ে শেষ করতে পারে, কারোটা বা শেষ করতে মাস শেষ হয়ে যায়।

এবার অবশ্য মেলার বয়স আরো দু'দিন কমলো। এটা বাণিজ্য মেলা না যে বাড়িয়ে দেওয়া হবে, এখানে বাণিজ্য হয় মেলা আরম্ভ হবার আগেই । এই মুহূর্তে চিন্তারা হয়তো আমার কপাল চাপড়ে বাড়ি দিচ্ছে, তবে ভরসা এটাই – প্রুফ দেখাতো হয়েছে। কোনো এক দিন হয়তো তা মেকাপ রুমে যাবে পাণ্ডুলিপি, লিপস্টিক দেবে, কপালে বিশাল সাইজের টিপ চেপে হেসে হেসে প্রেস থেকে বের হয়ে আসবে আমার ভ্রমণের গল্প –'পিয়াইন নদীর স্রোতে'। কোলকাতা বই মেলায় যাব বলে ভিসা করে রেখেছি, মোড়ক উন্মোচনের জন্য পাবলিক লাইব্রেরির হল রুম বুকিং দিয়েছি। কিন্তু আমার পিয়াইন নদী জাফলং থেকে এখনো ঢাকায় পৌঁছেনি। আজ প্রকাশকের দাদা গত হয়েছেন, সবাই তার আত্মার জন্য দোয়া করবেন। আর নদীটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকুন – পিয়াইন নদীর স্রোত যেন ভুল করে মেঘালয়ে হারিয়ে না যায় ।

বইমেলা নিয়ে আগের লেখার লিঙ্ক সংযুক্ত করলাম –http://blog.bdnews24.com/rodela01/181287