আরাফাত-রানার মৃত্যু এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যখন ঘাতক প্রশাসন

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 28 May 2017, 02:00 PM
Updated : 28 May 2017, 02:00 PM

সময়  তখন ৪ঃ৫০। ২৬শে মে শুক্রবার ভোর বেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী কলমার মার্কাস মসজিদ থেকে তাবলিগের জামাত শেষে অটোরিকশা করে ক্যাম্পাসে ফিরছিল আরাফাত ও রানা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-বেরুনী হলের আবাসিক ছাত্র ছিল। রানা পাবনা সদর উপজেলার নূরপুর গ্রামের আবদুল কুদ্দুসের ছেলে। আর আরাফাতের বাড়ি নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলায়।

আনুমানিক ৫:১৫-২০ এর মধ্যে  একটি  যাত্রিবাহী এসে অতর্কিতে তাদের রিক্সাকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এতে দু'জন গুরুতর আহত হয়। তখন প্রত্যক্ষদর্শীরা আরাফাতের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে কামরুলকে কল দেয় ৫:২৫ এ। কামরুল, আল মামুন, এমদাদ কলমা থেকে আনুমানিক ৫:৩৫ এ ঘটনাস্থলে গিয়ে এম.এইচ হলের গার্ড এবং প্রশাসনের দায়িত্বশীল একজনকে দেখতে পায়। কামরুল তখন এ্যাম্বুলেন্সের কথা বলে। প্রত্যক্ষদর্শীরা কামরুলকে কল করার সময় এ্যাম্বুলেন্সকে কল দিয়েছিল। আল মামুন তখন দায়িত্বরত প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে এ্যাম্বুলেন্স না আসার কারণ জিজ্ঞাস করে। তারপরেও কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় বহিরাগত ২ জন নিজস্ব গাড়ি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাম্বুলেন্স আনতে যায়।

প্রায় ৬:২০। এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে তারা আসে এবং ঐ এ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন ছিল না। স্থানীয়রা দ্রুত তাদের সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রানাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে লাইফ সাপোর্টে রাখা অবস্থায় দুপুর ১২টার দিকে মারা যান আরাফাত। এনাম মেডিকেলে তাদের নিয়ে যাওয়ার পর অপুর্ব নামের এক পুলিশ অফিসার রানার লাশ নিয়ে যেতে চায় এবং আরাফাতের চিকিৎসা বাদ দিয়ে রানার লাশ আটকাতে হয় উপস্থিত শিক্ষার্থীদের। যে কারনে আরাফাতের চিকিৎসা বিলম্ব হয়। প্রশাসনের লোকজন জানার পরেও প্রশাসনের কেউ এনামে ছিলনা। সকাল ৮:৩০ টা পর্যন্ত প্রশাসনের কেউ এনামে ছিল না এবং ঐ সময়ই পুলিশ রানার লাশ পুলিশের গাড়িতে তোলার জন্য তার সহকর্মীকে নির্দেশ দেয়। পরে কয়েকজন ছাত্র পুলিশের সাথে কথা কাটাকাটি শুরু হলে ঐ পুলিশ অফিসার ওসির সাথে কথা বলতে বলে। ছাত্ররা প্রক্টরের সাথে কথা বলেছে জানার পরেও সে বলে আপনাদের প্রক্টরকে আমার ওসিকে কল দিতে বলেন।

৮:৩০ এর দিকে এনামে গিয়ে উপস্থিত ছাত্রদের আশ্বাস দেয় সহকারী প্রক্টর দেবাশীষ সাহা এবং আল বেরুনি হলের প্রভোস্ট আমজাদ হোসেন। তারা বলেন রানার আত্মীয়েরা না আসলে লাশ রিলিজ করতে পারবেন না। তখন রানার চাচা, চাচাতো ভাই উপস্থিত থাকার পরও তারা উপর মহলেের অযুহাতে লাশ রিলিজ করতে টালবাহানা করে। অবশেষে ৯:১৫ টার দিকে এই শর্তে লাশ রিলিজ দেয় যে জানাযা এনাম মেডিকেলে হবে। ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়া যাবেনা কারণ উপরের মহলের নির্দেশ আছে। উপস্থিত সকল শিক্ষার্থীর বারবার অনুরোধেরর পরও উপরের মহলের নির্দেশে তারা লাশ ক্যাম্পাসে নিতে পারবে না, বরং এনামে জানাযার পর লাশ রানার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু জানাযা শেষে লাশ নিয়ে পাবনা যাওয়ার পথে ক্যাম্পাসের ডেইরি গেটে ছাত্র এবং অভিভাবকদের গাড়ি ১৫ মিনিট আটকিয়ে স্বাক্ষর নেয়া হয় অথচ রানার অভিভাবকরা ১১:০০ টা পর্যন্ত এনামে ছিল, তখন স্বাক্ষর নেয়া হয়নি। পাবনায় যাওয়ার পথিমধ্যে আনুমানিক ১২:০০ টায় আরাফাতেরর মৃত্যুর খবর জাবিতে পৌঁছে এবং একই প্রক্রিয়ায় আরাফাতের লাশকেও ক্যাম্পাসে ঢুকতে না দিয়ে এনামে জানাযার পর বাসা নরসিংদী পাঠানো হয়।

পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত, এত ছাত্রের অনুরোধ সত্ত্বেও, আরাফাত এবং রানা, ক্যাম্পাসে একই সাথে বেড়ে ওঠা সহপাঠির জানাযা হয়নি, লাশকেও ঢুকতে দেয়া হয়নি। এখানে ছাত্রদের চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা। এরপর পরই কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ইস্যু নিয়ে জাবির ছাত্রছাত্রীরা রাস্তা অবরোধ করে।

১। ডেইরি গেটের সামনে স্পিড ব্রেকার ঠিক করতে হবে

২। উপরের মহল কারা যাদের কারনে ক্যাম্পাসে নিজ ছাত্রের লাশ ঢুকতে দেয়া হয়না?

৩।ফোন দেয়ার পরও কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আহত ছাত্রকে হাসপাতালে নিতে ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়? অথচ মেডিকেল থেকে ঘটনাস্থলের দুরত্ব মাত্র ৫ মিনিট।

৪। বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানায়  নির্দিষ্ট গতিসীমা নেই কেন?

৫। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ঘাতক বাসের ড্রাইভারকে খুঁজে বের করতে হবে ।

[তথ্যসূত্র ঃ কামরুল(public health 43),আল মামুন(micro biology 41,এমদাদ(zoology 41)]

৪৮ ঘন্টা অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম বেশ কিছু শিক্ষক এবং বিশেষ ছাত্রদের যারা ছাত্রলীগের নেতা হিসেবেই সুপরিচিত। তাদের সাথে  নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে অনেক কথা বলেন। কিন্তু ঘাতক বাসের ড্রাইভার বা স্পিড ব্রেকার বসানোর কোন আভাস তার মুখে শোনা যায়নি। নিজ বন্ধুর লাশের জানাজা কেন ক্যাম্পাসে হবে না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন-

'আজ আরাফাত ও রানার জানাজা ক্যাম্পাসে হলে কাল হিন্দুধর্মের কোন একজন মারা গেলে তার দাহের জন্য আন্দোলন হবে। আমি আমার ক্যাম্পাসকে তো শ্মশান বানাতে পারিনা।'

-মাননীয় ভিসি ,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

https://www.youtube.com/watch?v=RIjsNj0PhgQ

(ভিডিও ধারণ করেছেন: মোঃ শফিকুর রহমান সিফাত)

এ সময় তাদেরকে উচ্ছৃংখল হিসেবেও আখ্যা দিতে প্রশাসন একটুও ভুল করেনি। ট্রাফিক জ্যাম সড়ানোর কথা বলে ছেলেমেয়েদের উপর চলে গুলিবর্ষণ আর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ। ডেইরিফার্মের সামনে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা আগেও ঘটেছে। প্রাক্তন ছাত্রী হিসেবে বলতে পারি-সে সময় আমরা প্রতিবাদ করেছি। প্রতিবাদের সময় প্রশাসন আমাদের পাশেও থেকেছে। ঘাতক চালককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এবার ২০১৭ -তে এসে সেই চেনা ক্যাম্পাসের নতুন চিত্র দেখলাম বিস্ময়ে। ড্রাইভারকে ধরতে যাওয়া তো দূরের কথা, পুলিশ এরেস্ট করে নিয়ে গেছে ৪৭ জন ছাত্রকে। আমরা আসলে বুঝতে পারছিনা একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের আসল ভূমিকা এই সময় কী হওয়া উচিৎ? আটক ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা না থাকলেও তাদের কোর্টে চালান দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। তারা হলো -জয়, পার্থ, জাহিদ, পৃথিবী, চন্দন, রাকিব, নাঈম, প্রমুখ।

একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে অভিভাবক বলা হয়। এরা কেমন তর অভিভাবক যারা সন্তানদের অনিশ্চিত অন্ধকারে ঠেলে দেয়! কোন কিছু ঘটলেই মামলা-হামলা এই সরকারের নিত্যদিনের কাজের মধ্যে অন্যতম একটি। আর তাদের ছত্রছায়ায় হৃষ্টপুষ্ট জাবি প্রশাসন ফুলে ফেঁপে বেড়ে উঠছে। তারা চাইছে ক্যাম্পাসে কোন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী থাকবে না। কেবল আওয়ামী লীগের সোনার ছেলেরা এখানে পড়ার নামে তাণ্ডব করবে। এরাই আবার শিক্ষক হবে, তারাই আবার ছড়ি ঘুরাবে।এটা এক অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে এ দেশের পাবলিক  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।

দুই দিন পর ছাত্র-ছাত্রীদের ফাইনাল পরীক্ষা। শনিবার রাতে জরুরি সিন্ডিকেট সভা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের রোববার সকাল ১০টার মধ্যে হল ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী, বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রী হল ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

আমার প্রশ্ন – এই ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন দিয়েই কি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চলছে না? স্টুডেন্ট ছাড়াই কি এভাবে ধীর লয়ে ক্যাম্পাস চলবে? ছাত্ররা যদি কথা না শোনে তবে দায়িত্ব কার? কিছু হলেই হল ভ্যাকেন্ট করে দেওয়াই কি সমাধান? এতোগুলো ছেলে-মেয়ে নিরাপদে এই রোজার মধ্যে বাড়ি পৌঁছতে পারবে কিনা সেই দায়িত্ব কে নেবে? গ্রীষ্মকালীন ছুটির অবকাশে ইফতারির প্লেটে মধু মাসের ফল সাজিয়ে প্রশাসন নাকে তেল দিয়ে খাক, আমরা সাধারণ মানুষ না হয় কেবল চেয়ে চেয়ে দেখি!

ছবি কৃতজ্ঞতা:
আশীক আল অনিক, শফিক মিতুল, www.bdnews24.com এবং সংগৃহিত