বিজয় মানে ‘মা’ বলতে পারার আনন্দ

রনি ভৌমিক
Published : 15 Dec 2015, 09:42 PM
Updated : 15 Dec 2015, 09:42 PM

আজ আমরা সবুজ ভূখণ্ডটির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করতে ভুলে যাই, মনোনিবেশ করতে চাই না কি করে অনাগতরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শির উঁচু করে জীবন-যাপন করবে তাদের জন্য সেই পরিমণ্ডল প্রণয়ন করা এবং সুরক্ষা দেওয়ার কথা । আমরা শুধু নিজেদের উদর পূর্তি করার মাঝে নিজেকে সঙ্কুচিত করে রাখি । আজ আমরা শুধু ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে হীনমনা ভাবে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ বলিদান করতে বেস্ত থাকি ।

প্রতি বছর আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় শহীদ মিনার এবং  স্মৃতিসৌধে মায়ের নামে শপথ নেই আর দেশের  স্বপ্ন পূরণের কথা বলে থাকি, দেশের সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা করি । কিন্তু সেই চত্বর পার না হতেই আমরা অকপটে সেই শপথের কথা ভুলে যাই নিরন্তর ভাবে; যদিও শুনতে অনেক খারাপ মনে হচ্ছে তারপরেও এটি অতীব সত্য কথা । ১৬ ডিসেম্বরের এই দিনটি ত্রিরিশ লাখ তাজা রক্তের বিনিময়ে পেয়েছিলাম; মা-বোনেরা তাঁহাদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের জন্য এই অসাধারণ এক উপহার রেখে গিয়েছে, যার নাম স্বাধীনতা, আর এই সেই স্বাধীনতা যাকে আমরা প্রতিনিয়ত অপ-ব্যাবহার করে থাকি ।

মা আজ তোমার এই ছোট সবুজ ভূখণ্ডটির বুকে সেই ধবল বকের সারি দেখতে পাওয়া যায় না, তুমি হয়তো আর দেখবে আজ তোমার সেই হলকর্ষক ছেলেরা বলদের কাঁধে জোয়াল বাঁধিয়া দিয়া লাঙ্গল ঠেলিয়া জমির বুকে লাঙ্গলের ফলায় মাটি ফাটিয়া সবুজের মাঠ জন্মায়তে হয় না, সেথায় চলে এসেছে প্রযুক্তির দানব নামক বলদ যে কিনা নিমিষেই মাঠ কি মাঠ ফলনের উপযোগী করে তুলে । কিন্তু মা তার মানে এই নয় যে তোমার খেতিমজুর ছেলেদের ভাগ্য খুলে গিয়েছে, তোমার জন্মের আগে যেমন করিয়া ভাগ্য দেবতা তাঁহাদের সাথে খেলা করিত এখনো তেমনিটি করে থাকে । তোমার সেই সব সন্তানদের নিয়ে উচ্চ পাড়ার মানুষদের এত চিন্তা করার মতো সময় হয়ে উঠে না । বুক ফাটা জমির পাশে একখানা মরা গাছের মগডালে যেমন করিয়া দুরন্ত  শুকন বসিয়া থাকিত, আজ সেই সত্যি কারের শুকন নামক পাখি অনেকটা হারিয়ে গিয়েছে কিন্তু তেমন করিয়া বসিয়া থাকে শুকন নামক কিছু অমানুষ, যারা তোমার সর্বনাশ করার জন্য উট পেতে থাকে ।

মা তুমি জেনে হয়তো অনেক খুশী হবে, আগে যেমন করিয়া তোমার সন্তানেরা রাজার খজনা দেওয়ার তাগিদে একবেলা পেট ভরিয়া আহার করতে পারত না, সেই জায়গায় আজ তাঁহাদের অনেক পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগিয়াছে । মা তোমার সন্তানেরা এখন শুধু মাতম করে না, তোমার সোনার বাংলা গড়তে ছুটে চলে নিরন্তর । চারিদিকে কত আয়োজন । তোমার ভালো লাগবে জেনে, এখন আর কাঙ্গালি ভোজএ বাঙালির ভিড় হয় না । আশীর্বাদ করো, একদিন তোমার বাঙালি সত্যি মানুষ হবে, সেদিন এদেশে কোনো কাঙ্গালি থাকবেনা । অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধ শুরু হয়েছে, এখন আমরা আত্মসম্মান আর মর্যাদার লড়াই করেই এগিয়ে চলেছি, কেবল নৈতিকতার যায়গাটা একটু ঠিকঠাক করা বাকি ।

আজ আমার বুকের সব হাহাকার নিয়ে তোমায় অভিশাপ দিয়ে দিলাম মা তুমি একদিন অনেক সুখী হবে, তোমার সোনার সন্তানরা বিশ্বের বুকে তোমার নাম প্রতিষ্ঠিত করবে তাঁহাদের পরিশ্রম এবং মেধা দিয়ে । বিশ্বকবির স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বাস্তবে রূপ দেবে; যেখানে ধর্মে ধর্মে বিরোধ থাকবে না, মানুষে মানুষে বৈষম্য থাকবে না এবং স্বাধীন বাংলাদেশে নারী-পুরুষ সবাই সমঅধিকার ও সমমর্যাদা নিয়ে থাকবে ।

মা তোমার যে সন্তানেরা মন থেকে তোমার জন্মের ইতিহাস মনে রাখে তাহারা কক্ষনো তোমার ক্ষতি সাধন করিতে পারবে না যদি না সে বিকৃত মস্তিষ্কের হয় । কারণ সেই দিনে আমাদের এই বিজয় এসেছিল বলে আজ আমরা স্বাধীন, আজ তোমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করতে পেরে নিজেকে বড় গর্বিত এবং অস্তিত্বশীল মনে হয়; নিখিল সৃষ্টির মাঝে নিজেকে বাংলাদেশী বলে পরিচয় দিতে গর্বে বুকটা ফুলে উঠে ।

রনি ভৌমিক
লেখক এবং প্রভাষক, ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ।

বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব চাইনিজ একাডেমী অব সাইন্স, বেইজিং, চীন।