বিবর্তনঃ সাংবাদিকতা ও নৈতিকতা

রুদ্র আমিন
Published : 4 March 2015, 07:48 AM
Updated : 4 March 2015, 07:48 AM

এ বি এম মূসা, সরকারের নিমোর্হ সমালোচনায় তিনি ছিলেন নির্ভীক ও সোচ্চার। তাঁর লেখনী ছিল ক্ষুরধার। তিনি আমৃত্যু সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। মৃত্যুর পূর্ববর্তী বছরগুলোতে তিনি টেলিভিশন টক-শোতে গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কথা বলে জনপ্রিয়তা অর্জ্জন করেন। তাঁর মৃত্যু পরবতী সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয় "এবিএম মূসা ছিলেন আমাদের সাংবাদিক সমাজের জ্যেষ্ঠতম সদস্য ও অভিভাবক।" এমন আরও সাংবাদিক আছেন যারা নিজের কথা চিন্তা করেননি দেশ ও দশের চিন্তা করেছেন। এমন অনেকেই আছে তাদের মধ্যে যাদের নাম বলতেই হয়, শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, শহীদুল্লা কায়সার। এই সকল গুণী সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধাদের কর্ম দেখে আমাদের কি তাদের নিকট থেকে কিছুই শিক্ষা নেবার নেই, তারা আমাদের জন্য দিয়েছেন আমরা কেন আগামীর জন্য কিছু দিতে পারবো না।

বর্তমানে আমরা যারা সাংবাদিক বা মিডিয়ায় কর্মরত আছি তারা পারি না পজিটিভ খবর পেশ করতে ? আর কেন পারবো না, সত্যের পেশা, জীবনের সাথে যুদ্ধের পেশায় যুক্ত হয়েছি সে তো জেনে শুনেই তবে কেন চাকরির কিছুদিন পরেই ভুলে যাই আমাদের নৈতিকতা। নিজের জন্মস্থানকেও ছোট করতে আমরা দ্বিধা করি না। এমন কিছু ঘটনা দেখলে মনে হয় আমাদের মিডিয়াগুলো কখনো আমাদের দেশের উন্নতি চায় না। আজ এমনটিই মনে হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজনকে নিয়ে নিউজ পড়ে। কিন্তু এমন একটি দেশ ভারত তাদের তো কোন মিডিয়া খায়েল করতে পারে না। উল্টাপাল্টা কোন খবর প্রকাশ করতে পারে না। বিশ্বকাপে ভারত দলের কোন খেলোয়াড় নিয়ে কোন মিডিয়া তেমন কথা তো বলতে পারে না। কিংবা মিডিয়ার সাথে তাদের কথা বলতে দেওয়া হয়না কোন সিরিজ চলাকালীন। তাদের বিচার হয় সিরিজ শেষ হওয়ার পর। দলকে দূর্বল করার জন্য এমন কিছু কাজ করে আমাদের মিডিয়া ব্যক্তিরা কেন করে আমি বুঝতে পারি না। একটি সিরিজ খেলার জন্য প্রয়োজন দলের সবার মনের শক্তি। হোটেলে গেলে নারী খেতে গিয়েছে, ঘুড়তে গেলে ম্যাচ পাতানোর জন্য কোন সূত্র খুজতে গিয়েছিল, কোন না কোন খুদ বের করবেই মিডিয়া গুলো।

আমার কথা হলো তারা কতটুকু সচেতন থাকে দেশের মানুষগুলো যখন পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয় তখন ? মিডিয়া ব্যক্তিদের লাইভ ক্যামেরা কি পথে প্রান্তরে সেট করা থাকে যে নাকি মিডিয়া ব্যক্তিরা অগ্রীম খরব পায় ? সামান্য ইনক্রিমেন্টের জন্য তরতাজা মানুষের পুড়ে যাওয়া ছবি তোলায় ব্যস্ত মিডিয়া ব্যক্তিরা। তাদের কি কোন কিছুই করার থাকে না। বিশ্বজিতকে গণপিটুনী দিচ্ছে আর মিডিয়ার ব্যক্তিরা সেটা ভিডিও করে চলছে। আমি যতটুকু জানি অপরাধ সৃষ্টিকারীরা আগেই মিডিয়ার কাউকে না কাউকে জানিয়ে দেয় কখন কোন স্থানে কোন গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ঘটাবে। মিডিয়া এমন একটি মাধ্যমে যার মাধ্যমে সত্যকে উপস্থাপন করা যায়।

কিন্তু আমাদের মিডিয়া ব্যক্তিরা সামান্য কিছু অর্থের জন্য চোখের সামনে ছটফটিয়ে মানুষ মরে যাক সেটাই চায়। তবুও তাদের তরতাজা ছবির প্রয়োজন। মিডিয়া কর্মীদের বেতন কত ? দুদক তাদের কেন তল্লাসি করে না, তাদের এতো কড়িকড়ি টাকা, ঢাকা শহরে বাড়ি গাড়ি এর উৎস কোথায় ? সাধারন মানুষ পুলিশ থেকে ১০ হাত দূরে থাকতে চায় বা দূরে সরে যায় আর পুলিশ সাংবাদিক এবং মিডিয়ার ব্যক্তিদের থাকে ১০ হাত দূরে পালিয়ে থাকে। আমরা পুলিশকে যা মুখে আসে তাই বলি। কিন্তু মিডিয়া ব্যক্তিরা যে কতটা খারাপ তা কেউ জানি না। পুলিশ না হয় দেশের নোংরা রাজনৈতিক ব্যক্তির প্রভাবে প্রভাবিত। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা পুলিশকে অন্ধ করে রেখেছে, কানে তুলা দিয়ে রেখেছে, বুঝদার হয়েও অবুঝ সেজে বসে থাকে।

আমরা সাংবাদিক সম্পর্কে যতটুকু জানি তা হলো সাধারণভাবে যিনি সংবাদপত্রের জন্য সংবাদ সংগ্রহ করেন ও লিখেন তাকেই সাংবাদিক বলে অভিহিত করা হয়। তবে বর্তমান সময়ের আধুনিক সাংবাদিকতার বিশাল পরিসরে সাংবাদিককে নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় বেঁধে দেওয়া কষ্টসাধ্য বিষয়। এখন সংবাদপত্রের ধরনে যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি সাংবাদিকদের কাজের পরিধিতেও পরিবর্তন এসেছে। সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। 'শতভাগ সঠিক সংবাদ প্রচারের কোনো বিকল্প নেই। মানুষ ঘটনার সঠিক সংবাদ জানতে চায়। সত্য লুকানোর মধ্যে ঘটনার প্রতিকার হয় না। সঠিক ও সৎ সাংবাদিকতা সমাজ বদলে দিতে পারে।

সততা একজন সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় গুণ। অনেক যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকলেও সততার অভাবে অর্জিত সম্মান ধুলোয় মিশে যেতে পারে। যেহেতু গণমাধ্যমকে সমাজের দর্পণ বলা হয়, তাই গণমাধ্যমকর্মীদেরও দর্পণের মতো স্বচ্ছ হতে হবে। এটা তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশবিশেষ ও বিশেষ ভূষণও বটে। সাংবাদিকতা যতোটা না পেশা তার চেয়ে অনেক বেশি নেশা, ভালোলাগা। এই নেশাটা হচ্ছে দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করার নেশা। আমার মনে হয়, একজন চিকিৎসক যেভাবে মানুষের সেবা করতে পারেন তার চেয়ে অনেক বেশি সেবা করতে পারেন একজন সাংবাদিক। কোন সাংবাদিকের এই নেশা কেটে গেলে তিনি তখন যতোটা না সাংবাদিক থাকেন তার চেয়ে বেশি চাকুরিজীবী।

স্যাটেলাইটের যুগে হাজারো অনুষ্ঠানের ভীড়ে সেরকম উল্লেখ করার মত অনুষ্ঠান খুবই কম। এখনকার অনুষ্ঠানের মধ্যে বেশীর ভাগই মধ্যবিত্তদের উপদেশ দেয়ায় ব্যস্ত – কিভাবে গ্ল্যামারযুক্ত জীবন যাপন করবেন, কোথায় যাবেন, কি পড়বেন, কি শুনবেন, কি দেখবেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি তার সাথে আরও রয়েছে গান, মডেলিং ইত্যাদি বিভিন্ন প্রতিযোগিতা নিয়ে রমরমা বাণিজ্য। এক টিভি চ্যানেলের গানের প্রতিযোগীতায় এক আদিবাসী বালিকার জন্যে এসএমএস ভোটের জন্যে যে পরিমাণ তদবির, ক্যাম্পেইন, মিছিল ইত্যাদির কথা শুনলাম তাতে মনে হল  ব্যাপারটি অসুস্থতার পর্যায়ে গিয়েছে। সেই মেয়েটি জিতেছিল কিনা জানিনা – তবে মানুষের এই আবেগকে পুঁজি করে সেই চ্যানেল আর মোবাইল কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছে নিশ্চয়ই – এই ব্যাপারগুলো কিন্তু সংবাদ হয় না। মিডিয়া কর্মীরা এসব বলতেই চায় না।

খবরের কাগজে দেখলাম অগ্নিদগ্ধ এক রোগিকে হাত উঁচু করে ছবি তুলছে হাসপাতালের ভেতর। কেউ একজন বড় একটি পাথড়ে চাপা পড়ে রয়েছে আর মিডিয়ার মানুষটি তার অবস্থা জানতে চাইছে। এরা কি সুস্থ না অসুস্থ? মানুষ না অমানুষ? আঞ্চলিক কথা মনে পড়ে গেল "গু খায় সব মাছে নাম পড়ে ঘাইড়া মাছের" তেমনি যতদোষ আজ পুলিশের সংবাদিকরা আজ সুশীল হয়ে গেছে। যেন ভাজা মাছটা উলটিয়ে খেতে জানে না।

সকল সাংবাদিক এবং মিডিয়া ব্যক্তিরা আসুন আমাদের দেশকে বাঁচিয়ে রাখি, বাঁচিয়ে রাখি নিঃষ্পাপ অবুঝ শিশু এবং নির্দোষ মানুষগুলোকে। দেশকে এবং দেশের আইন যেন সঠিক পথে চলতে পারে সেই পথে হাটুন। কতদিন আপনি আমি বেঁচে থাকবো পৃথিবীর বুকে ? ক্ষণিকের এই পৃথিবীতে ক্ষণিক সময়ের জন্য আমাদের সবার আসা। ঠিক নাট্য মঞ্চের মতো। পরিচালক যখন সমাপ্ত ঘোষনা করবেন তখনি সমাপ্তি হবে। কর্ম যদি ভাল হয় তবেই বেঁচে থাকা যাবে যতদিন পৃথিবী টিকে থাকবে।

হট নিউজের জন্যে আমরা এমনও কিছু কর্ম করে থাকি একটি মেয়ের জীবনকে না বাঁচিয়ে আত্মহত্যার পথ দেখিয়ে দেই। আসুন পজিটিভ খবর প্রকাশ করি, সত্যতে আলোতে নিয়ে আসি, অসত্যকে ধবংস করে সত্য প্রতিষ্ঠা করি। সুন্দর এবং পজিটিভ সোনার বাংলাদেশ গড়ি।