যেসব কারণে ঘাতকেরা প্রাণ ভিক্ষা চায় না

সাব্বির আহমেদ
Published : 21 Nov 2015, 08:49 AM
Updated : 21 Nov 2015, 08:49 AM

যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর অপর দুই নেতা যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা এবং যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের দুইটি পৃথক মামলার রায় অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলেও তারা কেউই নিজ নিজ অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চায়নি। যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মুজাহিদ কিংবা যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজ নিজ কৃতকর্ম স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইবে এমনটা কেউ ভাবছে না। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে হলে তাদের কৃতকর্ম স্বীকার করতে হবে। অপরাধ স্বীকার করলেও ক্ষমা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। প্রায় শূন্য সম্ভাবনা নিয়ে অপরাধ স্বীকার করলে যুদ্ধাপরাধীদের কয়েকটি বড় বড় রাজনৈতিক ক্ষতি হয়ঃ

১) বাংলাদেশকে স্বীকার করতে হয় – মুক্তিযুদ্ধের যারা বিরোধিতা করেছে তারা তা জেনে-শুনে-বুঝেই করেছে। তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অভ্যুদয় চায়নি। তারা ধর্মীয় মৌলবাদী; জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান ভিত্তি সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা তারা মানে না। এরকম মৌলিক কিছু কারণে তারা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করেছিল; মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানীদের পক্ষ নিয়েছিল। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে তারা অসংখ্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। এসব অপকর্মকে তারা রাজনৈতিক দ্বায়িত্ব বলে বিবেচনা করে। যুদ্ধাপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে বাংলাদেশকে স্বীকার করা হয়। জামায়াতের গঠনতন্ত্রে বাংলাদেশকে স্বীকার করা হয় নি বলে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। তবুও তারা বাংলাদেশকে স্বীকার করে গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করেনি। এতদিন যেসব কাজকে তারা সঠিক বলে বিবেচনা করেছে তাকে অস্বীকার করা করা হয়। কয়েকটি প্রাণ বাঁচানোর জন্য যদি তারা নিজেদের একাত্তরের কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবে স্বীকার করে বাংলাদেশ স্বীকার করে নেয় তবে পরবর্তীদের জন্য বিকৃত উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়।

২) জামায়াত রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি নষ্ট হয় – জামায়াতে ইসলামী একটি ইসলামী মৌলবাদী রাজনৈতিক দল। এদের রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর জন্মস্থান পাকিস্তানকে তারা তীর্থস্থান বলে বিবেচনা করে। সেই তীর্থস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে তারা চায়নি। জামায়াত চেয়েছিল পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন বজায় থাকুক; সৌদি এবং তাদের জঙ্গিবাদী ওয়াহাবী রাজনীতির দোসর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের প্রভাব বজায় থাকুক। মধ্যপ্রাচ্য ধারায় ইসলাম ভিত্তিক রাজনীতি বাজায় থাকুক। বাংলাদেশ সৃষ্টির অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র জামায়াতের রাজনৈতিক দর্শনের পরিপন্থী। অন্যদিকে পাকিস্তানের চির শত্রু ভারত এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্রী এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের রাজনীতি করে তাই বাংলাদেশ সৃষ্টি হলে এখানে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়বে। ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বিদ্বেষী জামায়াত কোন ভাবেই বাংলাদেশে ভারতের রাজনীতি বরদাস্ত করতে পারে না। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতারা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন অপকর্মকে অপকর্ম হিসেবে স্বীকার করে নিলে তাদের দলের নৈতিক ভিত্তি দূর্বল হয়ে যায়। পক্ষান্তরে সে সকল কাজকে সঠিক বলে দাবী করা হলে এবং ভবিষ্যতে জঙ্গিবাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারলে জামায়াতের রাজনীতি করার পথ সুগম হবে; বাংলাদেশে পাকিস্তানী রাজনীতির আলোকে তাদের স্বপ্নের 'বাংলাস্তান' প্রতিষ্ঠা সহজ হবে।

৩) শহীদ উপাধি পাওয়া যায় না – যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর তার পুত্র সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, তার পিতা বাংলাদেশে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। কাদের মোল্লার কবরের উপর লেখা ফলকে তাকে শহীদ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের অনুসারীরা শহীদ উপাধি দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ড পাওয়া আরেক যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানকেও। যুদ্ধাপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইলে মৃত্যুর পরে শহীদ উপাধি পাওয়া যাবে না। শহীদ উপাধি পাওয়া গেলে রাজনৈতিক অনুসারীরা এবং বংশধরেরা জিহাদি জোশে মৌলবাদী রাষ্ট্র স্থাপন করতে পারলে ভবিষ্যতে মহামানব হিসেবে স্বীকৃতি জোটার সুযোগ থাকবে।

সংবিধান অনুসারে ৪৯ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে দণ্ড মার্জনা, মওকুফ, বিলম্বন, স্থগিত বা হ্রাস করার যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ৪৭(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তা গণহত্যা জনিত অপরাধ, মানবতা বিরোধী অপরাধ, এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। উপরন্ত, ৪৭ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উল্লেখিত অপরাধের ক্ষেত্রে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যাক্তির আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার নেই। তদুপরি, যুদ্ধাপরাধীরা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে বাঁধা দেয়ায় এবং গণহত্যা, মানবতা বিরোধী অপরাধ সংগঠিত করায় জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি কেনই বা এই সকল জঘন্য অপরাধীদের ক্ষমা করবেন? এসকল বিষয় বিবেচনা করেই মৃত্যুদণ্ড ভোগ করার আগে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা এবং যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি। যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদ এবং যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও একই কারণে প্রাণ ভিক্ষা চাইবে না – এটাই স্বাভাবিক।