দৃষ্টি পড়ুক পিছিয়ে পড়া অঞ্চলসমূহের উপর

ড. আবুল বাসার
Published : 5 August 2011, 01:28 PM
Updated : 26 August 2015, 02:39 AM

মানুষ তার নিজের অবস্থার মূল্যায়ন করে আপেক্ষিকতায়। অন্যের দিকে না তাকিয়ে কেউ নিজে ভালো কী মন্দ আছে, সেটা ঠিক বুঝতে চায় না বা পারে না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসে স্বামীর হাতে নিগৃহীতা খিজিরের স্ত্রী তার স্বামীর বর্ণনা দেয় এইভাবে:

''এমনিতে তো লোকটা খারাপ ছিল না। বস্তির আর সকলের মতো দিনরাত কথায় কথায় বৌয়ের গায়ে হাত তোলে না। কখনও কখনও মদ খেয়ে এসে কোনো কারণে মেজাজ চড়ে গেলে চড়টা চাপড়টা দেয় বটে, কিন্ত প্রথম কয়েকটা লাগাবার সঙ্গে সঙ্গে খিজিরের সরু ও শক্ত আঙুলগুলো আপনিই সিঁটকে আসে, হাত দুটোই যেন কুঁকড়ে যায়, সে তখন নিজের এক হাত অন্য হাতের উপর ঘষতে থাকে। এ রকম ঘষতে ঘষতে কিছুই না বলে হঠাৎ বাইরে চলে যায় এবং সেদিন ফেরে একেবারে গভীর রাতে, আরও একটা পাঁইট গিলে।''

খিজির কতটা খারাপের চেয়ে সে অন্যান্যদের তুলনায় কতটা কম খারাপ সেটাই তার স্ত্রীর কাছে মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। আর এখানেই সে সুখ খুঁজে পায়। ব্যক্তির মতো কোনো একটি সমাজ বা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিমাপ করতে গেলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অবস্থার তুলনামুলক আলোচনা এ জন্যই অপরিহার্য হয়ে ওঠে। দেশ বা সমাজের কিছু গড় গাণিতিক হিসাব দিয়ে সবার অবস্থা বুঝা যায় না। অর্জিত উন্নয়ন যদি বৈষম্যহীন না হয়, তাহলে তা উন্নয়নের মঙ্গল প্রদীপের সলতে চেপে ধরে। সমাজের এক অংশের হাতে আনুপাতিক হারের চেয়ে বেশি বিত্ত-বৈভব চলে গেলে আরেক অংশ কখনও নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়েছে বলে মেনে নিতে পারে না।

বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর ধরেই একটা কথা খুব বেশি শোনা যায়; মধ্য আয়ের দেশ। বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করা সরকারের অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য। বিশ্ব ব্যাংক ছাড়া আর কেউ অবশ্য এই নিম্ন, মধ্যম বা উচ্চ আয়ের মাপকাঠিতে কোনো দেশকে চিহ্নিত করে না। বিশ্ব ব্যাংকের নিজস্ব পদ্ধতিতে হিসাব করে যদি কোনো একটি দেশের মাথাপিছু আয় ১০৪০ মার্কিন ডলারের বেশি হয় তাহলে সে দেশ আর নিম্ন আয়ের দেশ থাকে না। তাদের হিসাব অনুযায়ী ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১০৮০ মার্কিন ডলারে। সে হিসাবে বাংলাদেশ এখন, বিশ্ব ব্যাংকীয় অভিধা অনুযায়ী 'নিম্ন মধ্যম' আয়ের দেশ।

এ নিয়ে ডানে বামে অনেক কথাই হয়তো বলা যায়, কিন্ত বাংলাদেশ যে সামগ্রিক বিচারে কিছুটা হলেও এগিয়েছে সেটা অস্বীকার করা যায় না। হ্যালো, মিস্টার কিসিঞ্জার, বাংলাদেশ আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, ছিলও না কোনো কালে। এ ছিল বাংলাদেশকে নিয়ে আপনার কুৎসিত মনের কুৎসা মাত্র।

কিন্ত মূল প্রশ্ন হল, দেশটা সবাইকে নিয়ে এগোতে পেরেছে কিনা। একজন মানুষ অন্য জনের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে দুই কারণে। তার একটি হল, যদি তার উৎপাদন সক্ষমতা অন্যের তুলনায় কম হয়। আর এই সক্ষমতা কম হবার কারণ হতে পারে তার হাতে উৎপাদন উপকরণের স্বল্পতা। এই উৎপাদন উপকরণ হতে পারে ভূমি, হতে পারে পুঁজি, হতে পারে শিক্ষা, হতে পারে স্বাস্থ্য।

একজন তার নিজস্ব উৎপাদন উপকরণ দিয়ে কতটুকু উৎপাদন করতে পারবে এবং তা বিক্রি করে কতটুকু অর্থ উপার্জন করতে পারবে সেটা নির্ভর করে সে দেশের কোন অঞ্চলে সে বাস করছে তার উপর। এক কেজি আদা উৎপাদন এবং বিক্রয় করে রাঙামাটি এবং কুমিল্লার কৃষক একই দাম পাবে না। আর এইভাবেই অঞ্চল-ভেদে উৎপাদনশীলতা এবং বাজার ব্যবস্থার তারতম্যও হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তি পর্যায়ের এবং আঞ্চলিক বৈষম্যের কারণ। আর এসবের সমাধান বাজারভিত্তিক প্রবৃদ্ধি আপনা আপনি করে দিবে না, বরং রাষ্ট্রকে সক্রিয় হয়ে এ লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।

তার জন্য সবার আগে দরকার বাংলাদেশে আঞ্চলিক বৈষম্য সম্বন্ধে একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা। বাংলাদেশে যেহেতু জাতীয় আয় বিভাগীয় বা জেলা পর্যায়ের জন্য পরিমাপ করা হয় না, তার ভিত্তিতে দেশের কোন অঞ্চল তুলনামূলকভাবে কতটা পিছিয়ে সেটা এখনও অন্যান্য কিছু তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অনুমানই করতে হয়। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং একটি দাতা সংস্থা মিলে সারা দেশের জন্য দারিদ্রের মানচিত্র প্রকাশ করেছে, তা কোনো একটি বিশেষ অঞ্চলের তুলনামূলক অনগ্রসরতা সম্বন্ধে কিছুটা হলেও ধারণা দিবে।

অবশ্য প্রকাশিত এসব তথ্য-উপাত্ত ২০১০ সালের, এক হিসাবে পুরোনোই বলা চলে। ২০০৫ সালেও অনুরূপ একটি মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছিল।

২০১০ সালে বাংলাদেশ দারিদ্রের হার ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্ত একই বছরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬টি জেলায় অর্ধেকেরও বেশি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। দারিদ্রের হার সবচেয়ে বেশি কুড়িগ্রাম জেলায়, যেখানে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬৪ শতাংশ দরিদ্র। আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল দারিদ্রের মধ্যে যতই খ্রিস্টীয় সম্মান খুঁজে পান না কেন, একটি জেলায় এত বেশি দরিদ্র থাকলে সেটা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের মাপকাঠিতে অগ্রহণযোগ্যই হওয়া উচিত। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হবার যে কীর্তি নিয়ে আমাদের অনেকে ইদানিং বেশ আমোদিত, কুড়িগ্রামের মানুষের কাছে সেই আমোদ নির্মম তামাশা ছাড়া আর অন্য কিছু হতে পারে কি?

দারিদ্রের হিসাবে তার পরেই আছে বরিশাল যেখানে প্রায় ৫৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। এক সময় বলা হত, 'ধান, নদী, খাল; এ তিনে বরিশাল'। বরিশাল হতে এ তিন হারিয়ে গিয়ে এখন দারিদ্র এসে বাসা বেঁধেছে। জীবনানন্দ দাশের 'সোনালী ডানার চিল'এর বরিশাল এখন দারিদ্র নামক চিলের নখের আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত। শরীয়তপুরের প্রায় ৫৩ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। জামালপুর, চাঁদপুর এবং ময়মনসিংহের ৫১ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে।

এই ছয়টি জেলার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ দরিদ্র হবার পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? এই ছয়টি জেলাই কিন্ত বাংলাদেশের মূল সমতলভাগে অবস্থিত যেখানে মোটামুটি একই নৃগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। সুতরাং এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, এসব জেলার মানুষ সমূহ আচার-আচরণ এবং জীবনের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে খুব আলাদা যা তাদের উচ্চমাত্রার দারিদ্রের কারণ এবং পরিপোষক। স্বভাবতই তখন যে প্রশ্নটি দাঁড়িয়ে যায় সেটা হল, তাহলে কি এসব জেলায় মানুষের কাছে উৎপাদনের উপকরণ, যেমন আবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ, পুঁজি, শিক্ষা ইত্যাদি অন্যান্য জেলার তুলনায় কম? অথবা এমনও হতে পারে যে, এসব জেলায় ভৌত অবকাঠামো দুর্বল বিধায় উৎপাদনশীলতা কম?

কারণ যাই হোক না কেন, সরকারকে এসব জেলায় নিবিড় দৃষ্টি দিতে হবে। সরকারের উন্নয়ন ব্যয়-বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঞ্চলের তুলনামূলক পশ্চাদপৎতা বিবেচনায় আনতে হবে।

বাংলাদেশের কোনো স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দলিলে অনগ্রসর অঞ্চলসমূহের উপর বিশেষ নজর দেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কিন্ত আর দেরি না করে এখনই তা করা উচিত। এসব অঞ্চলসমূহ যেহেতু অনুন্নত, সেখানে ব্যক্তিগত বিনিয়োগও হয় না, হবে না। ফলে সেখানে কর্মসংস্থানের অভাব চলতেই থাকবে। আর এ কারণে এসব অঞ্চলে দারিদ্রের হার বেশি থেকেই যাবে না শুধু, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বরং এদের পার্থক্য আরও বেড়ে যেতে পারে। অনুন্নয়নের এই দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনার জন্য ঐসব অঞ্চলে দরকার অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি সরকারি বিনিয়োগ।

সরকারি বিনিয়োগসমূহের লক্ষ্যও হওয়া উচিত সুচিন্তিত। কিছু কিছু বিনিয়োগ, যেমন ভৌত অবকাঠামো, বিদ্যুত, কৃষিখাত ইত্যাদি একটি অঞ্চলের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। আবার কিছু কিছু বিনিয়োগ, যেমন স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাখাতের বিনিয়োগ ব্যক্তির উৎপাদনশীলতা এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। প্রথম ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদেই ফলাফল পাওয়া যায়, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সুফল পেতে সময় লাগে। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে সরকারকে দুই ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ করতে হবে। কোনো একটি বিশেষ এলাকার উন্নয়ন কী কারণে থমকে আছে, সেটার কারণ হয়তো একেক অঞ্চলে একেক রকম হবে। এই কারণসমূহ অনুসন্ধান করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

দারিদ্রপীড়িত পদ্মাপাড়ের জেলেপাড়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন:

"টিকিয়া থাকিবার নির্মম অনমনীয় প্রয়োজনে নিজেদের মধ্যে রেষারেষি কাড়াকাড়ি করিয়া তাহারা হয়রান হয়। জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষন্ন। জীবনের স্বাদ এখানে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সংকীর্ণতায়। আর দেশি মদে। তালের রস গাঁজিয়া যে মদ হয়, ক্ষুধার অন্ন পচিয়া যে মদ হয়। ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।"

এই হল দারিদ্রের আঘাতে বিবর্ণ জীবনের চিত্র। যে দেশে কোনো কোনো অঞ্চলের অর্ধেকের বেশি মানুষ এমন জীবন যাপন করেন, সে দেশে নিম্ন, মধ্যম কিংবা উচ্চ আয়ের দেশের মাপকাঠিতে উন্নয়ন পরিমাপ করা সঠিক কাজ নয়। আর এ নিয়ে বেশি আমোদিত বা উল্লসিত হওয়াও মানানসই নয়।