কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদির অতীত ও বর্তমান…

ম, সাহিদ
Published : 28 August 2011, 11:33 AM
Updated : 28 August 2011, 11:33 AM

প্রাচীনকাল থেকেই এ উপমহাদেশের হস্তচালিত তাঁত শিল্প জগদবিখ্যাত ছিল। ঢাকাই মসলিনের মতো বিখ্যাত ছিল কুমিল্লার খাদি। তখন খাদি কাপড় বিদেশেও রপ্তানি হতো। এখনও হয় তবে যৎসামান্য। পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে কুমিল্লার খাদিপাড়া আবার জেগে উঠেছে। বর্তমানে খাদির বেডসিট, ব্লক করা থ্রীপিস, পাঞ্জাবী, ইত্যাদি ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বর্তমানে যে কাপড় খাদি নামে পরিচিত প্রথমে এটি অন্য নামে পরিচিত ছিল। কেননা খাদি কোন কাপড়ের নামও নয় সুতার নামও নয়। দেশীয় কাপড় হিসেবে এ ধরনের কাপড়ের চাহিদা দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় পায়ে চালিত প্যাডেলের নীচে মাটিতে খাঁদ বা গর্ত করা হতো। এই গর্ত বা খাঁদ থেকে যে কাপড় উৎপন্ন হতো তাকেই খাদি কাপড় বলা হতো। এখন মেশিনে তৈরি এ ধরণের কাপড় ও খাদি কাপড় নামে পরিচিত। খাদি শিল্পের বিকাশে চান্দিনার শৈলেন গুহ ও তার ছেলে বিজন গুহ চান্দিনাতে আখতার হামিদ খান প্রতিষ্ঠিত"দি খাদি কো অপারেটিভ এসোসিয়েশন লিমিটেডে"র হাল ধরেন। ১৯৬৫-৬৮ সালে আখতার হামিদ খানের চেষ্টায় ভাল মানের তুলা পাওয়া যেত। ভাল তুলার অভাবে পরে উন্নতমানের খাদি তৈরি অসম্ভব হয়ে পড়ে। বর্তমানে খদ্দরের উন্নয়নে কাজ করছেন তার ছেলে অরুন গুহ। খদ্দরের উজ্জ্বলতা নেই। বাহ্যিক চাকচিক্য নেই। আছে স্বদেশ প্রেমের পরিচয়। সরকারর পৃ পোষকতার অভাবে খাদি শিল্প মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছেনা। খাদি নিয়ে শৈলেন গুহের বরাবরই আকুতি ছিল। তা হলো আপনারা এই খদ্দর কাপড় ব্যবহার করে খদ্দর শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখুন। সেটাই করে চলছেন অরুন গুহ।

স্বদেশী আন্দোলনের সসময় খাদি কাপড়ের চাহিদা অসম্ভব ভাবে বেড়ে যায়। তখন মানুষ বিদেশী পন্য বর্জন করে দেশীয় কাপড়ের প্রতি আর্কষ্ট হয়। বিশেষ করে মহাত্মা গান্ধীর অনুপ্রেরণায় কুমিল্লার খাদির বাজার আরো প্রসারিত হয়। চান্দিনায় মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত একটি তাঁত এখনও রয়েছে। আদি খাদি তৈরি করা হতো রাঙ্গামাটির তুলা দিয়ে। আর এখন তৈরি হয় তুলা এবং মেশিনে তৈরি সুতার মিশ্রণে। কুমিল্লা সদও , চান্দিনা এবং দেবিদ্ধার , ও মুরাদনগরের হাজার হাজার তাঁতী এ শিল্পের প্রসারে কাজ করছে। বর্তমানে অল্প কিছু তাঁতী কোন রকমে তাদের পেশা টিকিয়ে রেখেছে। চান্দিনার বারেরা , নূরীতলা ও কলাগাঁওয়ে কিছু কিছু পরিবার তুলা থেকে সুতা বানানোর কাজ করে। খাদি শিল্পীরা ওদের নিকট থেকে সুতা কিনে খাদি তৈরি করে। তবে বর্তমানে শুধু তুলার সুতা দিয়ে খাদি উৎপাদিত হয়না। খাদি সুতার সাথে নারায়নগঞ্জ থেকে সুতা এনে সেই সুতার মিশ্রনে কারিগররা খাদি তৈরি করছে। ফলে খাদির আদি রুপ বদলে গিয়েছে এবং খাদি কাপড় পরে আগের মতো আরাম পাওয়া যায় না।

বর্তমানে দেবিদ্ধার , মুরাদনগর ও চান্দিনার তাঁতীরা কাপড় বুনায় ব্যস্ত। দেবিদ্ধারের বরকামতায় শ্রীনিবাসের ২টি , মতিলাল দেবনাথের ১টি , রনজিত দেবনাথের ৭টি ভুবন দেবনাথের ১টি, চিন্তা হরণ দেবনাথের ২টি তাঁত ছিল। বর্তমানে ভুবন দেবনাথের ১টি রনজিত দেবনাথের ৫টি চিন্তা হরণ দেবনাথের ২টি তাঁত রয়েছে। বাকীগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কারিগড়দের পাশাপশি তাদের ছেলে -মেয়ে –বউরাও কাজ করে। কিভাবে খাদি তৈরি হয়? এ প্রশ্নের জবাবে মতিলালের বউ বল্লেন-৬০ কেজি ওজনের একেকটি গাইট এনে ভাত বা ময়দার মার দিয়ে ১ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে রোদে শুকিয়ে ঝরঝরা করা হয়। তারপর আরো কয়েকেটি ধাপ পেড়িয়ে গজ কাপড় উৎপাদিত হয়। বর্তমানে খাদি তৈরির সুতাসহ সব ধরণের সুতার দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দেবিদ্ধারের তাঁত শিল্প হুমকির সম্মুখিন। জানা গেছে দুই/তিন সপ্তাহের ব্যবধানে তাঁতের তেনা তৈরিতে ব্যবহৃত ৮২/১ পোড়ন সুতা বেল প্রতি ১ লাখ টাকার পরিবর্তে ১ লাখ ১২ হাজার টাকা , ৭৪/১ সুতা বেলপ্রতি ৯৮ হাজার টাকার পরিবর্তে ১ লাখ ১৪ হাজার টাকট। ৬২/১ সুতা বেল ৯৪ হাজার টাকার পরিবর্তে ১ লাখ ৪ হাজার টাকা। ৫৪/১ সুতা বেল প্রতি ৮৮ হাজার টাকার পরিবর্তে ৯৬ হাজার টাকা , ৪০/১ সুতা বেল প্রতি ৭০ হাজার টাকার পরিবর্তে ৮৪ হাজার টাকায় বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ঈদ একই সময়ের ব্যবধানে ৮০ এর কুন সুতা পাউন্ড প্রতি ২৩০ টাকার স্থলে ২৬০ টাকা , ৬০ এর কুন সুতা পাউন্ড প্রতি ২২৫ টাকার স্থলে ২৬০ টাকা , ৫০ এর কুন সুতা ১৭১ টাকা পাউন্ড এর সবথলে ১৯০ টাকা বিক্রি হচ্ছে । এছাড়া ৩২ সুতা বন্ডিলের দাম ৬ শ টাকা থেকে ১৪ শ টাকা এবং রেলিং সুতা ৪০০টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১শ টাাকা করা হয়েছে। বর্তমানে বরকামতার চাদর , লুঙ্গি , থান কাপড় , ইতাদি তৈরি হয়। রনজিত দেবনাথের বাবা শশীমোহন দেবনাথ সাইতলায় ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ৭০/৭৫ বছর ধরে এ ব্যবসা চলছে। তিনি জানান-স্বাধীনতার পর পর এ ব্যবসার স্বর্ণ যুগ ছিল। মুরাদনগরের জাহাপুর , ইসলামপুর , বাখরনগরসহ সকল তাঁতীরা চায় এব্যবসার সুদিন আবার ফিরে আসুক। কিন্তু কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিও কারেণে স্বল্পপঁজির উৎপাদনকারীরা ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে খাদিপাড়া আবার জেগে উঠবে।