বাতাসে সেই পুরনো সাম্প্রদায়িকতা

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 2 April 2016, 09:04 AM
Updated : 2 April 2016, 09:04 AM

আবার কি সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেওয়া হচ্ছে? অপকৌশলে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে? সব জায়গায় সব কিছু নিয়ে এমন অস্থির করার প্রবণতা ভালো কিছু নয়। ভাবখানা এই যে, যা ঘটছে যা হচ্ছে তার পেছনে আছে সরকার। তনুর কথায় আসি।

শালীন সুন্দর চমৎকার মেয়েটির ব্যাপারে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে এমন এক জগাখিচুড়ি পরিন্থিতি তৈরি করা হয়েছে যে সত্য কী সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। কথায় বলে, ছেলের হাতের মোয়া। ছেলে যদি শিশু হয় তো সে মোয়ার ভালো-মন্দ বোঝে না। আমাদের দেশ ও সমাজে মানুষ এখনও মনোজাগতিক দিকে প্রাগৈতিহাসিক আমলে বসবাস করছে। তাদের চিন্তা-চেতনা-মননে আলো নেই। থাকার কথাও নয়। তাকিয়ে দেখুন, যাদের আমরা বিপ্লবী জানতাম, যাদের বাম ধারা বলে সম্মান করতাম, তাদের অবস্থা কতটা শোচনীয়। তাদের এককালের মুখপাত্র সাপ্তাহিকের চটি পায়ে ব্যাগ-ঝোলানো সম্পাদকের বহুল প্রচারিত কাগজটি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অঘোষিত 'জেহাদ' করেই চলেছে। সুযোগ পেলেই উস্কে দেয়। তনু ইস্যু বা ক্রিকেট ইস্যু কোনোটাই বিষয় নয়। বিষয় ঘটনাগুলো সরকারবিরোধী করে তোলা।

বলছিলাম মিডিয়ার কথা। আমরা খুব গর্ব করে বলি, এক একজন মানুষ এখন একেকটি মিডিয়া। হাতে একটা আধুনিক মোবাইল থাকলেই হল। আসলে কি তাই? আন-এডিটেড মিডিয়াগুলোর দিকে দেখুন, তাদের দেশ, জাতি বা চেতনা কিছুর প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই। খবরের পেছনের খবরের নামে তিলকে তাল করে সামাজিক মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে আর তা নিয়ে মেতে উঠছে মানুষ। এটা কি সুস্থতার পরিচায়ক? খুন-জখম-দূর্ঘটনা-হত্যা-ধর্ষণ সব বিষয়ে এমন মাতামাতি এক ধরনের অনাধিকার চর্চা।

এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। এর পেছনে কাজ করছে জামায়ত-বিএনপির চক্রান্ত। তারা ওপেন বা প্রকাশ্যে সুবিধা করতে পারছে না। জাতীয় রাজনীতিতে জ্বালাও-পোড়াও আর ধ্বংসের কারণে কোনঠাসা বিএনপির সমর্থকরা নেমেছে চরিত্রহননে। আওয়ামী লীগ বা সরকারের নামে তারা এখন জাতির চরিত্রহননে ব্যস্ত। দেখবেন কী কৌশলে তারা গুজব ছড়ায়।

এসব আমরা স্বাধীনতার পরপরও দেখেছিলাম। যারা বলেন এতে কাজ হয় না, আমি তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। কাজ হয়। অনেক মানুষকে অনেক কালের জন্য তো বটেই কিছু মূর্খদের সারাজীবনের জন্য অন্ধকারে রাখা যায় এতে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ওপর যে কালিমা লেপন করা হয়েছিল তার কালো জের এখনও ফুরোয়নি।

এবার যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার লোপাট হল, ফিলিপাইন-শ্রীলংকা-ভারত-বাংলাদেশ সব ছাড়িয়ে সন্দেহের তীর ছুটল আবারও শেখ পরিবারের দিকে। প্রবাসে বিশেষত আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশে ন্যূনতম লেখাপড়া ও যোগ্যতা ছাড়া আসা যায় না। অন্তত সেটাই নিয়ম। কিন্তু আমরা বারবার প্রমাণ করি সার্টিফিকেট মূলত কোনো শিক্ষা নয়। এই মানুষরা প্রবাসে পরিকল্পিত গুজবে এমন আবহ তৈরি করেন যাতে বিভ্রান্ত হবার বিকল্প থাকে না।

কতজন যে আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছে, এই ডলার চুরির পেছনে নাকি অমুক-তমুক আছে! তাদের ধারণা, যারা লেখালেখি করে তারা সব জানে। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে বলেছি, যাদের কথা বলছেন তাদের কি এভাবে ডলার চুরি করে টাকা কামানোর দরকার আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাকা চৌধুরীর অনুরক্ত একজন তো ক্রূর হাসিতে এ-ও বললেন, এগুলোরও নাকি বিচার হবে একদিন। যে বা যারা দায়ী তাদের বিচার হবেই। সময়ের হাতেই এর বিচার।

কিন্তু এরা কারা? যারা আমাদের দেশের শান্তি, প্রগতি, অর্জন বা উন্নয়ন থমকে দিতে চাইছে তারা কিন্তু সুযোগ নিচ্ছে এগুলোর। তনুর অপমৃত্যুতে সেনাবাহিনীকে টেনে আনা, গুজবের পর গুজব তৈরি, অতঃপর কার কাজের মেয়ে আত্মহত্যা করল তার দায়ও তুলে দিচ্ছে সরকারের কাঁধে। আর এগুলোর সারমর্ম বেরিয়ে এসেছে ক্রিকেটের ফলাফলে।

একজন লিখেছেন, ভারত হারার পর তিনিও আনন্দিত হয়েই রাস্তায় নেমেছিলেন। নেমে তো তার আক্কেল গুড়ুম। তার বয়ানে শুনি:

''কিছু মানুষ বলাবলি করছে, ইন্ডিয়া হেরেছে, খুব ভালো হয়েছে। এদের কারণেই আমরা দেশ ভেঙেছি। পাকিস্তানে থাকলে আজ আমরা অনেক ভালো থাকতাম! নিজেও দেখলাম জগন্নাথ হলের ছাত্ররা তাদের ভালোবাসা থেকে আনন্দ-উল্লাস করার পরও অবিশ্বাসের শিকার। সবচেয়ে ঘৃণার ব্যাপার, এগুলোর পেছনে কাজ করছে কথিত সুশীলরা। কবিপুত্র, ঔপন্যাসিক নামে পরিচিত একজন লিখেছে, ওয়েন্ট ইন্ডিজ নাকি চারদিকে শান্তি আর শান্তি লিখে দিয়ে গেছে!''

ভারতের এই পরাজয়ে আমার মতো হাজার হাজার সংখ্যালঘু নামে পরিচিত মানুষ জন আনন্দিত। তাদের ক্রিকেট আমাদের সঙ্গে গাদ্দারি করেছে। তাদের দেশে এমনকি বিদেশেও তাদের দাপটে আমরা ন্যায্য জয় থেকে বঞ্চিত হয়েছি। রাগ থাকার একশ একটা কারণ আছে। কিন্তু দাদাগিরির এই চক্রান্ত বা হামবড়া ভাব ভাঙতে আবেগের অপব্যবহারে কাজ হবে? না লাগবে যৌক্তিক কাজ? কোথায় প্রতিবাদ করতে হবে, কীভাবে খেলতে হবে, কীভাবে খেললে শক্তি কব্জা করা যাবে, সেগুলো নিয়ে কথা নেই। কেউ বলছেন না আমরা ওয়েষ্ট ইন্ডিজের কাছ থেকে শিখলাম দূঃসময়ে কীভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে টেনশন লুকিয়ে ছক্কা হাঁকিয়ে জিতে আসতে হয়।

পুরো ব্যাপারটা চলে গেছে ভারত-বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িকতার খাতায়।

এভাবে চলে না। এভাবে পচনশীল সমাজ ও অপবুদ্ধিকে স্বাধীনতার নামে বাড়তে দিলে একদিন সরকার তো সরকার, জাতিকেই উপড়ে ফেলবে এরা। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পুরনো শক্তি জামায়াত-বিএনপি-মুসলিম লীগের সঙ্গে জুটেছে নতুন ও নব্য রাজাকারের দল– তথাকথিত সুশীল সমাজ। এরা পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায়। যাক। কে তাদের আটকে রেখেছে? বোমা, জিহাদ, আত্মঘাতী শরিয়া আর গৃহযুদ্ধের শান্তিতে থাক তারা। আমাদের দেশটি নষ্ট করার কোনো অধিকার নেই তাদের।

এ কথা জানানোর দায়িত্ব কেবল সরকারের নয়। তাদের দলেও ভূতের অভাব নেই। আমাদের চাই প্রগতির ঐক্য। না হলে এরা আমাদের জান-মাল-চেতনার ওপরও হামলা চালাবে। সেদিন খুব দূরে নয়। আমরা সাবধান হব কি আদৌ?