আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, নতুবা সব ফাঁস করে দেবো- আ স ম আবদুর রব

সেলিম আহমেদ
Published : 29 August 2014, 04:28 PM
Updated : 29 August 2014, 04:28 PM

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের(জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, সিরাজুল আলম খান স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিউক্লিয়াস থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কখন কি করেছেন, কেমন করে ৭ই মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তৈরি করেছিলেন, ২রা মার্চ, ৩রা মার্চ, বিএলএফ, মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল কখন কিভাবে কি হবে- সেই সব একজন আব্দুল গাফফার চৌধুরীর পক্ষে জানা সম্ভব নয়, ছিলোনাও না। গাফফার ভাই একজন লেখক সাংবাদিক, বয়োবৃদ্ধ লোক।আমি তাকে ভালোবাসি।আমরা তিনির লেখা গানকে পছন্দ করেছি।কিন্তু তার অর্থ এই নয়, তিনির মনে যা আসে, যা তিনির মতের সাথে মিলেনা বা স্বার্থের উপর আঘাত আসে, তার বিরোধীতা করতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার সিরাজুল আলম খানকে মূর্খ, ভণ্ড ইত্যাদি অশালীন শব্দ ব্যবহার করে জাতীয় পত্র পত্রিকায় তিনির মনের রঙ লাগিয়ে লিখবেন আর বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে যারা জড়িত, তারা চুপ করে বসে থাকবে। সিরাজুল আলম কেমন ছাত্র ছিলেন- সেটা গাফফার চৌধুরীর কাছ থেকে জানতে হবেনা। সিরাজুল আলম খানের পাণ্ডিত্য, জ্ঞান, গরিমা, নতুন নতুন রাজনৈতিক তত্ব, তথ্য, চিন্তা-ভাবনা দেশ বিদেশে সকল সময়ই আলোড়িত হয়েছে।

আ স ম আবদুর রব বলেন, সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন বলেই বাঙালি জাতি একজন বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলো।সেই সিরাজুল আলম খানকে জড়িয়ে কুৎসা রটানোর জন্য অশ্লীল ভাষায় আব্দুল গাফফার চৌধুরী বিভিন্ন পত্রিকায় যে বক্তব্য ও লেখনী দিয়েছেন, তা প্রত্যাহার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। নতুবা ৬০ এর দশক থেকে আব্দুল গাফফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোথায় কি বলেছেন, কি করেছিলেন জাতির কাছে সব ফাঁস করে দিতে বাধ্য হবো।

গতকাল লন্ডনের বেতার বাংলার সাথে এক লাইভ সাক্ষাতকারে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডির সভাপতি, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি আ স ম আবদুর উপরোক্ত কথাগুলো ব্রিটেন প্রবাসী জনগণের কাছে আবেদন আকারে রাখেন। আ স ম আবদুর রবের এই লাইভ সাক্ষাতকার যখন বেতার বাংলায় প্রচারিত হচ্ছিলো, তখন দেশ বিদেশের হাজারো বাংলাদেশী জনগণ বেতার বাংলায় টেলিফোনে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তারা একদিকে যেমন আ স ম আবদুর রবের এই লাইভ সাক্ষাতকারের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছিলেন, একই সাথে বলছিলেন, বেতার বাংলা প্রবাসের বুকে এরকম ব্যতিক্রম ধর্মী সময়োপযোগী অনুষ্ঠান প্রচার করায় ধন্যবাদ জানানোর সাথে সাথে এরকম অনুষ্ঠান আরো বেশী করে প্রচারের অনুরোধ জানান।

বেতার বাংলার উপস্থাপক সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদের মর্নিং এক্সপ্রেস উইথ সেলিম এই অনুষ্ঠানে আ স আম আবদুর রবের সাক্ষাতকারের অংশ বিশেষ এখানে তুলে ধরা হলো-

সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত মহীউদ্দিন বুলবুলের জাসদ ও কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম নিয়ে মন্তব্যের প্রেক্ষিতে এক প্রশ্নের জবাবে আ স ম আবদুর রব বলেন, এ সময় আমি জেলের মধ্যে বন্দী ছিলাম। তখনকার সরকার মিথ্যা বানোয়াট ধোঁকার মাধ্যমে আমাকে অসুস্থ সাঝিয়ে জার্মানি প্রেরণ করে।তবে মহীউদ্দিন বুলবুল আমাদের দলের সাথে জড়িত ছিলেন।বুলবুল আমাদের দল করতেন। ৭ই নভেম্বর এবং কর্নেল তাহের ও জাসদ নিয়ে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন- সেটা নিয়ে তার রচিত বই এখনো যেহেতু প্রকাশিত হয়নি, সেজন্য অপ্রকাশিত বই নিয়ে মন্তব্য করাটা এখনই ঠিক হবেনা। বাজারে বইটি আসুক, তার পর সেটা পড়ে নিয়ে মন্তব্য করা যাবে। প্রথম আলোতে তিনি যে লেখা দিয়েছেন, সেটা নিয়ে এটাই বলবো তিনি সেই তথ্য কোথায় পেয়েছেন সেটা তাকেই জাতিকে জানাতে হবে। কেননা সেই তথ্য তিনিই বলেছেন। তার সেই তথ্য কতোটুকু সঠিক সেটাও দেখতে হবে। কেননা বানানো ও মনগড়া তথ্য দিয়ে কিছুদিন বাজার গরম করা যায়। জনগণের মনে রেখাপাত করা যায়না। রব বলেন, ইতিহাসের সত্যতা কেউ লুকিয়ে কিংবা নিজের মতো করে প্রচার করে পার পায়নি অতীতেও, বর্তমানেও সম্ভব হবেনা। কেননা সত্য ইতিহাস সেটা ১০০ বছর পরে হলেও বের হবে। যেমন তিনি বলেন, ৭ই মার্চ, ২রা মার্চ, ৩রা মার্চের ইতিহাস- যুগের পর যুগ ধরে স্বার্থ-বাদীরা লুকিয়ে ও মিথ্যে তথ্য দিয়ে বই পুস্তক ভরে রেখেছিলো। অথচ ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে সেটা প্রকাশিত হয়েছে।

এ সময় আ স ম আবদুর রব বলেন, ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে সিরাজুল আলম খান সত্য ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। ২রা মার্চের পতাকা উত্তোলনের ইতিহাস জাতি এখন অবগত। এই সব সত্য ইতিহাস যখন প্রকাশিত হচ্ছে তখনি একের পর এক স্বার্থবাদী আর মিথ্যের ফেরিওয়ালাদের গাত্রদাহ শুরু হয়ে গেছে। তারা একের পর নাটকের পর নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছেন।

আ স ম আবদুর রব বলেন, যার স্বার্থে যত আঘাতই লাগুক, জাতিকে, নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানার সুযোগ করে দিতে হবে।

জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ও বিচার পতিদের অভিশংসন নিয়ে মন্ত্রী পরিষদে পাশ হওয়া প্রস্তাবিত আইনের ব্যাপারে বেতার বাংলার উপস্থাপকের এক প্রশ্নের জবাবে আ স ম আবদুর রব  ডঃ কামাল হোসেনের সাম্প্রতিক একটি লেখা যা পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, সেটার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন- দেশে বর্তমানে এক শ্বাস রুদ্ধকর এবং রাজনীতিকে বিরাজনীতি করণের অবস্থা চলছে। গণতন্ত্রের নামে এক ব্যক্তির খেয়াল খুশী মতো একধরনের গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরাচারী শাসন চলছে।বিরুদ্ধ মত ও পথ দমন, নিপীড়নের জন্য, বাক ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হরণের ও জনমতকে স্তব্ধ করে কেবলমাত্র একজনের ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রতিফলনের জন্য একধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনের দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।দেশে গুম,খুন, হত্যা, রাহাজানি বেড়েই চলছে।মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের সকল ব্যবস্থাই করা হয়েছে।

আ স ম আবদুর রব বলেন, গত ৫ জানুয়ারী যে নির্বাচন হয়েছে- সেটা অত্যন্ত কলঙ্কজনক এক অধ্যায়। ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত- ৩০০ আসনের পার্লামেন্টে অর্ধেকেরও বেশী এভাবেই নির্বাচিত আর বাকী যারা নির্বাচিত বলা হচ্ছে তারাও ৫ পার্সেন্টেরও ভোট পেয়েছে বলে নিজেরাও দাবী করতে পারছেনা, অথচ সেই ৫% ভোটকে এখন রঙ লাগিয়ে ৪০% বানানো হচ্ছে। এধরনের নির্লজ্জ নির্বাচন বিশ্বের কোথাও হয়নি।দেশের আইন শৃঙ্খলা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ সবই আজ সর্বত্র স্বজনপ্রীতি আর দলীয় করণ চূড়ান্তভাবেই করা হয়েছে। কোথাও জবাবদিহিতার বিন্দুমাত্র রেশ নেই। সমালোচনা করলেই তার উপর নেমে আসছে জেল জুলুম, মামলা, মোকদ্দমা, আক্রমণ। দেশে যখন রাজনীতি থাকেনা তখন এধরনের বিরাজনীতি করণের দিকেই নিয়ে যাওয়া হলে সর্বত্র নেমে আসে ধ্বস। আর সেই ধবস যখন নেমে আসবে তখন হবে আরো ভয়াবহ অবস্থা।

এ থেকে উত্তরণের পন্থা প্রসঙ্গে আ স ম আবদুর রব বলেন, আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে ১৯৭২ সালের জোড়াতালি দেয়া সেই সংবিধান।এই সংবিধান বিগত ৪৪ বছরেও বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষা কিছুই পূরণ করতে পারেনি।এই সংবিধান বঙ্গবন্ধু, জিয়াউর রহমান কাউকেই রক্ষা করতে পারেনি। সেজন্য এই সংবিধানের আমূল পরিবর্তন করে সকল পেশা, শ্রেণী ও কর্মের জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার আলোকে এবং পার্লামেন্ট ও প্রশাসনে শ্রম-কর্ম-পেশার জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে।

আ স ম আবদুর রব বলেন, রাজনৈতিক সংকটের যে কারণ, সেই তত্বাবধায়কের বিকল্প পার্লামেন্ট উচ্চ কক্ষ বা আপার হাউস গঠন করে এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। আমাদের ক্রমবর্ধমান জনগণের ঊর্ধ্বমুখী চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে পার্লামেন্টের আসন বৃদ্ধি করে ৫০০তে উন্নীত করে সকল শ্রম-কর্ম-পেশার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনী ব্যবস্থায় রি-কল(প্রত্যাহার) ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে আ স ম আবদুর রব বলেন,  সমস্যার মূল কারণ অনুসন্ধান ও সমাধানের পরিবর্তে ২০৪০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার উচ্চাভিলাষী মানসিকতা থেকেই মেট্রোরেল, হাই ওয়ে, পদ্মা, কুইক রেন্টাল, পাওয়ার প্ল্যান্ট, আকাশ রেল, ফ্লাই ওভার, উচ্চ মধ্যবিত্তের দেশে পরিণত হওয়া ইত্যাদি নানামুখী চমকপ্রদ স্বপ্ন ও আশা জাগানিয়া প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে- আগামী একশত বছর পরে বা পঞ্চাশ বছর পরে সেই সব প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য কি পরিণতি বয়ে নিয়ে আসবে তা ভাবা হচ্ছেনা, সেই সবকিছুই মূলত সুপার কমিশন আর নিজেদের পকেট ভারি করার আধুনিক টেকনিক ছাড়া আরো কিছুই নয়। একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহর জলাবদ্ধতায় তলিয়ে যায়, বাংলাদেশের আয়ের অন্যতম খাত গার্মেন্ট শিল্পে অস্থিরতা আর ধ্বংসের সকল ব্যবস্থা করে সেই সব নিরসন না করেই আকাশচুয়ী অবাস্তব স্বপ্ন জাতিকে দেখানো হচ্ছে- কমিশন বাণিজ্য ঠিক রাখার জন্য।

আ স ম আবদুর রব তার সাক্ষাতকারের শেষ পর্যায়ে এসে আবারো প্রবাসী সকল বাংলাদেশীদের এবং রেডিও স্রোতা ও অনলাইনের মাধ্যমে যারা এই অনুষ্ঠান শুনছেন সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ এবং প্রবাসীদের দেশ ও জনগণের উন্নয়নে সঠিক পদক্ষেপ এবং সহযোগী হওয়ার আহ্বান জানান, সকলের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু এবং সুন্দর জীবন কামনা করেন। বেতার বাংলার মাধ্যমে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দেয়ার জন্যও আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

(বেতার বাংলা লন্ডনে জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মুশতাক হোসেন যে সাক্ষাতকার দিয়েছেন, সেটাও আসছে শীগ্রই )

28th August 2014, London.