সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার প্রথা একটি অনাচার

শ্যামল আতিক
Published : 2 August 2017, 01:50 AM
Updated : 2 August 2017, 01:50 AM

ধরুন কারো বাসায় দাওয়াত খেতে গেলেন। কলিংবেল টিপে বাসায় প্রবেশ করতেই (খাতা কলম নিয়ে টেবিলে বসা) একজন আপনাকে বললেন, উপহারটা আমার হাতে দিন, আর আপনার নাম-ঠিকানা বলুন।এই ঘটনা দেখে আপনার ছেলে আপনাকে জিজ্ঞেস করলো, বাবা, এটাতো হোটেল না, তাহলে উপহার দিয়ে দাওয়াতে আসতে হবে কেন? আপনি বললেন- এটাই নিয়ম। ছেলের পাল্টা প্রশ্ন, 'উপহার বা টাকার বিনিময়েই যদি দাওয়াত খেতে হয়, তবে এখানে কেন? তার চেয়ে বরং হোটেল ভালো, আমি আমার পছন্দ মত খেতে পারব। ছেলের এই প্রশ্নের জবাবে আপনি কী উত্তর দিবেন, তা আমাদের জানা নেই। তবে যুক্তিসঙ্গত সদুত্তর দিতে পারবেন না- এটা নিশ্চিত।

.

প্রিয় পাঠক, উপরের কথোপকথনগুলো কাল্পনিক হলেও এই উপহার বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবার অবকাশ আছে। আমরা উপহারের বিরোধী নই। জন্মদিনে বই উপহার দেয়া অথবা বিবাহ বার্ষিকীতে ফুল দেয়া- এই কাজগুলো অবশ্যই প্রশংসনীয়। এর ফলে নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই উপহার দেয়াকে আমরা যখন একটি নিয়ম বা রেওয়াজ বানিয়ে ফেলি অথবা প্রথা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি, তখনই বিপত্তি ঘটে। কেননা উপহার দেয়া যখন প্রথা হয়ে যায় তখন সামাজিকতা রক্ষার জন্য আমরা অনেকটা বাধ্য হয়েই উপহার দেই। ধনী সমাজে উপহার প্রথা হচ্ছে একধরনের ফ্যাশন, স্ট্যাসাস সিম্বল এবং বিলাসিতা। দামি দামি উপহার দিয়ে তারা আশেপাশের মানুষজনকে তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সামাজিক অবস্থান প্রদর্শনের চেষ্টা করে। দামি উপহারের বিনিময়ে তারা সমাজে বাড়তি সম্মান ও মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর জন্য উপহার প্রথা এক ধরনের গলার কাটা।

একজন নিম্ন আয়ের কর্তার কথাই ধরুন। প্রতি মাসে গড়ে ৩-৪ টি বিয়ে, জন্মদিন, খাৎনা অথবা বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে উপহার দিতে গেলে, তার সংসারটা কিভাবে চলবে- একটু ভেবে দেখুন। এমন পরিস্থিতিতে হয় সে পরিবারের প্রয়োজনীয় খরচের খাত কাটছাট করে উপহার দিবে অথবা ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে অনুষ্ঠানে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। উপহার দিয়ে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলেও মাসের বাকী দিনগুলোতে কীভাবে সংসার চলবে, এই চিন্তায় তিনি পুরো মাস অস্থির থাকবেন। আবার ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে অনুষ্ঠানে না গেলেও স্ত্রী সন্তানদের কাছে নিজেকে খুব অসহায় মনে করে হীনমন্ম্যতায় ভুগবেন। দারিদ্রতাকে তিনি পাপ হিসেবেই ধরে নেবেন। আর নৈতিক শিক্ষা দুর্বল হলে এই কর্তাই একদিন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়বেন।

ব্যক্তি সৎ কিনা সেটা আমাদের কাছে বিবেচ্য নয়, আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তিনি কতটা ধনী। যিনি যত বেশি খরচ করতে পারবেন তাকে তত বেশি সম্মান করা হয়। একজন অসৎ লোক যিনি দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর অথবা ভদ্রবেশি শিক্ষিত চোর, তার কাছে দামি উপহার কোন বিষয়ই না। কিন্তু একজন সৎ লোক দামি উপহার কেনার আগে অন্তত দশবার চিন্তা করবে।

সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার প্রথা একটি মারাত্মক ব্যাধি। এই ব্যাধি সমাজের ধনী শ্রেণি থেকে ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত ও গরীব মানুষদের মধ্যে সংক্রমিত হয় এবং পরিণামে সামাজিক অস্থিরতার কারণ হয়। তাই সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার বর্জন করা উচিত। বিয়েসহ নানা অনুষ্ঠানে আমরা নিজেরা যদি উপহার গ্রহণ থেকে বিরত থাকি, তবেই এই প্রথাকে সমাজ থেকে অনেকাংশে নির্মূল করা সম্ভব।