কিস্তি শোধে বসতঘর বিক্রি এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নোবেল প্রাপ্তি

শফিকুল ইসলাম(শফিক)
Published : 3 May 2015, 04:50 PM
Updated : 3 May 2015, 04:50 PM

bdnews24.com এ প্রকাশিত খবরে জানা যায় মাদারীপুরে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় এক নারী দিনমজুরের বসতঘর বেচে দিয়েছে ক্ষুদ্র ঋণদাতা বেসরকারি সংস্থা আশা। ওই নারীর অভিযোগ, কিস্তি শোধ করতে না পারায় আশার স্থানীয় কর্মকর্তারা জোর করে তার ঘর বিক্রি করে দিয়েছেন।কালকিনি উপজেলার এনায়েতনগর এলাকার কাচারিকান্দি গ্রামের আলী খার স্ত্রী নাছিমা বেগম আশার সমিতিরহাট শাখা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। শনিবার দুপুরে তার ঘর ভেঙে নিয়ে যাওয়া হয়।বসতঘর ভেঙে নেওয়ায় স্কুলপড়ুয়া মেয়েসহ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে অসহায় এ পরিবার।আশার কর্মকর্তারা বলছেন, কিস্তি দিতে না পেরে ওই পরিবারই ঘর বিক্রি করেছে। আর ক্রেতা ঠিক করে দিয়েছেন তারা।

অভিযোগকারী এবং সংশ্লিষ্ট আশা কর্মকর্তা দু'জনের দাবিই সত্য। চারপাশে ঘটে যাওয়া ক্ষুদ্রঋণ সংশ্লিষ্ট কিছু ঘটনা থেকে এর সত্যতা নিরুপণ করা যেতে পারে। ক্ষুদ্রঋণ ধারণার জনক বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস। সুদনির্ভর ব্যাংকিং ব্যবস্থার আদলে দরিদ্র মানুষকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে চক্রবৃদ্ধি মুনাফার এক ঋণদান ব্যবস্থার নাম ক্ষুদ্রঋণ। অর্থনীতির এক নতুন ধারণার আবিষ্কার করে তিনি ও গ্রামীণ ব্যাংক শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান । প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বারাক ওবামার শান্তিতে নোবেল লাভ আর সুদ নির্ভর ঋণব্যবস্থার প্রবর্তন করে ডঃ ইউনুসের নোবেল পুরস্কার লাভ একই সূত্রে গাঁথা।শান্তির উদাহরণ হত পারে লিবিয়ায় হাজার হাজার নির্দোষ মানুষের জীবন দান অথবা কালনী উপজেলার দরিদ্র পরিবারটি ।

ক্ষুদ্র ঋনের মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্র পরিবারকে ঘর তুলতে সাহায্য যেমন করা হয় তেমনি ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে ঘর ভেঙ্গে নেয়ার উদাহরণও কম নেই। গতকালেরর ঘটনা ছোটবেলায় চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনাকে মনে করিয়ে দেয়। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহায়তায় যখন এর সদস্যরা ঘর ভেঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিল তখন দরিদ্র ঘরের মালিক মহিলার কান্না বা অবুঝ শিশুদের আবদার কোন কাজে আসেনি। তবুও শান্তি, তবুও পুরস্কার।

আমি মনে করি মানুষ দরিদ্র থাকার পেছনে অন্যতম কারণ পড়ালেখা না জানার কারণে জীবনের হিসেব বুঝতে না পারা এবং অদৃষ্টের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা । দরিদ্র মানুষের অসচেতনতাকে পুজিঁ করে গ্রামীণ সুদখোর মহাজনরা যেমন হাজার হাজার মানুষ কে নিঃস্ব করেছে, আশা, ব্র্যাক বা গ্রামীণ ব্যাংকরা তাই করছে।এখানে শুধু সুদ গ্রহীতার পরিবর্তন হয়েছে; চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হয়নি। উপার্জিত অর্থের সঠিক ও পরিকল্পিত ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান না থাকার কারণে মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম দরিদ্র থাকে। তারা যে উপার্জন করতে পারেনা তা নয় তারা এর ব্যবহার করতে পারেনা। এই সুযোগ গ্রহন করতো সুদখোর মহাজনরা ।১০০ টাকায় মাসে ১০ টাকা হারে ঋণ গ্রহণ করে তা শোধ করতে না পেরে পোষা প্রাণী থেকে শুরু করে ঋণদাতার পরামর্শে ঘরবাড়ি বিক্রি করতে হয়েছে অনেকের বা ঋণদাতা ঘর ভেঙ্গে নিয়ে গেছে। এখানে ঋণ দাতারা শুধু ঋণ দিয়ে যেকোন উপায়ে তা আদায়ের চেষ্টা করতো মাত্র।

আজকের ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থাগুলো সেই গ্রামীনণ মহাজনদের মতো। তারা শুধু ঋণ দিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিস্তি দানে ব্যর্থ হলে ৪/৬ মাস পর আবার নতুন ঋণ দিয়ে ১ বছরের সুদে আসলে কেটে নিয়ে কিছু টাকা তাদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকে। তাদের দেনা বাড়ে কিন্তু গৃহীত ঋণ তাদের জীবনে শান্তি নয় অভিশাপ বয়ে নিয়ে আসে। এমন একজন গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতাকে আমার জানা আছে যে কিস্তি পরিশোধ করার জন্য মাসিক শতকরা ১০ টাকা হারে গ্রামীণ সুদ ব্যবসায়ীদের কাছে ঋণ নিতো। এক পর্যায়ে সে তার বাড়ি ভিটার একটা অংশ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে।অনেককে দেখতাম ঋণের টাকা দিয়ে ১০-১৫ দিন ইচ্ছামতো খরচ করে খেয়ে পরে অনাহারে থেকে ঋণের টাকা পরিশোধ করেছে।ঋণের টাকা দিয়ে গ্রাহকরা কি করছে এই ব্যাপারে ঋণদানকারী সংস্থার খোঁজ রাখার নিয়ম থাকলেও কিস্তি সংগ্রহ ছাড়া তাদের তেমন কোন তৎপরতা দেখা যায় না।অডিট বা কোন বিদেশী সংস্থা পরিদর্শনে আসলে নির্দিষ্ট কিছু সদস্যদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার ব্যবস্থা করা হয় যা ঐ সদস্যের নিজের নয় কর্মকর্তার শিখিয়ে দেয়া। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা শুধু গ্রামের দরিদ্র বা অস্বচ্ছলরা নয়, অনেক স্বচ্ছল মধ্যবিত্তও এখন ঋণ গ্রহণ করে বরং অনেক ক্ষেত্রে অস্বচ্ছলরা ঋণ পায় না। আমি অস্বচ্ছলদের কথা বলছি যাদের এই ঋণের এবং ভাগ্যোন্নয়নে এর সদ্ব্যবহার প্রয়োজন।

ক্ষুদ্রঋণ জামানত বিহীন ঋণ ব্যবস্থা বলে যে প্রচার তা এক ধরনের ভাওতাবাজি।ঋণ গ্রহণের পূর্বে গ্রহীতাকে কিছু সঞ্চয় রাখতে হয়। এই সঞ্চয়ের পরমাণ ৫০০ টাকার কম নয়। সঞ্চয় রাখার পর তাকে প্রথম দফায় ৩০০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০০ টাকা ঋণ প্রদান করা হয়। কিস্তি গ্রহণ শুরু করা হয় ঋণ প্রদানের পরের সপ্তাহ থেকে এবং প্রত্যেক সপ্তাহের কিস্তির সাথে ঋণ গ্রহীতাকে ৩০ টাকা (২ বছর আগের তথ্য) সঞ্চয় জমা দিতে হয়। এই সঞ্চয়ের উপর প্রতি ৬ মাস অন্তর ৫% হারে সরল সুদ প্রদান করা হয় । এভাবে ঋণ গ্রহীতার সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়তে থাকে ।অনেক সময় জমাকৃত সঞ্চয়ের পরমাণ গৃহীত ঋণের পরিমাণের চেয়ে বেশি হয়। ধরা যাক একজন সদস্যের সঞ্চয় জমা ১৫০০০ টাকা এবং সে ঋণ গ্রহণ করেছে ১০০০০ টাকা। এক্ষেত্রে সে ১৫০০০ টাকার ৫% সরল সুদ গ্রহণ করছে বিপরীতে ১০০০০ টাকা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ প্রদান করছে।চক্রবৃদ্ধিতে সুদের হার কেমন তা বোঝার জন্য ক্ষুদ্র ঋণের আদলে গ্রামের হাটবাজার গুলোতে ঋণদাঙ্কারী কিছু সমবায় সমিতির সাথে কথা বলি। কয়েকটি সমিতির সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম ১ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করলে বছর শেষে লাভ ৭০ হাজার টাকার কম হয় না। এবার বুঝুন জামানত বিহীন ক্ষুদ্র ঋণের ক্যারিশমা।

আর ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থায় কর্মরতদের নিয়ে বলতে খারাপ লাগে। তাঁদের অবস্থা বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অবস্থার চেয়ে খারাপ।পুলিশ বাহিনী যতই ভালো কাজ করুক না কেনো কোন এক পক্ষ তাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়। তবে তাঁদের বেতন কাটা যায় না। কিন্তু অনেক এনজিও মাঠ কর্মকর্তারা কাঙ্খিত অর্থ আদায় করতে না পারলে তাঁদের বেতন থেকে অনাদায়ী অর্থ কেটে নেয়।বাংলাদেশের বেকারদের শেষ আশ্রয় এই এনজিও গুলো। সারাদিন মাঠে সাইকেল চালিয়ে রাতে শুতে গিয়ে পরিবার কে কিভাবে অর্থ পাঠাবে তা ভাবতে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে দেয়। সকাল ৬ টার সময় ঘুম থেকে উঠে ৭ টায় ঠিকই অফিসে যোগ দেয়। বাংলাদেশের বড় বড় এনজিও গুলোর কর্তারা যখন মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই বিঘা জমি কবিতাটির কথা মনে পড়ে।"তুমি মহারাজ , সাধু হলে আজ ,আমি………… "-থাক আর বলতে চাইনা।

ক্ষুদ্রঋণ সবক্ষেত্রে নেতিবাচক ফল নিয়ে এসেছে তা নয়। অনেক পরিবার ঋণের অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে জীবনমানের উন্নতি করেছে। এই ঋণের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ঋণদানকারী সংস্থাগুলোর দৃশ্যমান ভূমিকা প্রয়োজন। গ্রামীণ ব্যাংক যে দাবি করে এই ব্যাংকের মালিকানা তার সদস্যসের তবে কেনো সদস্যরা এই বৈষম্যের শিকার তা নিয়ে ভাবা দরকার এবং এই সমস্যা সমাধানের উপার বের করা প্রয়োজন।

পরিশেষে একটা কথা, গ্রামীণ সুদখোর মহাজনদের কবলে পড়ে অনেক পরিবার কে স্থাবর , অস্থাবর সম্পতি অনেক সময় জীবন হারাতে হয় সেদিক থেকে ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থা শুধু ঘর নিয়েই শান্ত থাকে। মন্দের ভালো হিসেবে পদ্ধতিটিকে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন । তখন এটি হয়তো কষ্ট লাঘবে কিছুটা সহায়ক হবে কিন্তু সামগ্রিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় এর ভূমিকাকে যেভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা হচ্ছে তা এক ধরণের কপটচারিতা।

সুত্র লিঙ্ক-bangla. /bangladesh/article963027.bdnews