মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধে আইন চাই

শফিকুল ইসলাম(শফিক)
Published : 14 June 2015, 06:24 AM
Updated : 14 June 2015, 06:24 AM


মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধে 'Genocide Denial Law' এর দাবিতে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ গতকাল প্রেসক্লাব চত্বরে সমাবেশ করেছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শত শত মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেছে। অর্ফিয়াস রিবর্ণ নামের একজন যুব্ক ফেসবুককে " মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধে Genocide Denial Law চাই" ইভেন্ট খুলে আহবান জানিয়ছেন সকল স্তরের মানুষকে প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়াতে। তাতে মিলেছে অভূতপূর্ব সারা। চট্টগ্রামেও একই দাবিতে মিছিল, সমাবেশ , মানবন্ধন হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ আয়োজনের আলোচনা চলছে। কিছুদিনের মধ্যে হয়তো এই দাবি আরো জোরালো রূপ ধারণ করবে।

আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা জাতি গুলোর মধ্যে একটি যারা ইতিহাসের নামে উপন্যাস রচনা করি। ঐতিহাসিক সত্য কে পাশ কাটিয়ে নিজের ইচ্ছামতো নায়ক, পার্শ্বনায়ক সৃষ্টি করে ইতিহাস(উপন্যাস) রচনা করে নতুন প্রজন্মকে উপহার দিই।আমার নিজের ইতিহাস নামক উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে ইতিহাস বিকৃতির সবচেয়ে ঘৃণিত অধ্যায়ের সূচনা হয়।।যখন বুঝতে শুরু করি তখন আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায়।বাংলাদেশের ইতিহাস আলোচনায় স্বাধীনতার ঘোষণা অংশে আমরা পড়েছি গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ ঘোষণা তদানীন্তন ইপিআর এর টেলিগ্রাম, ট্রান্সমিটার, টেলিপ্রিন্টারের সাহায্যে প্রচার করা হয়।২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগ নেতা এম এ হান্নান ববঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন। ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেজর জিয়ার On behalf of our great leader Sheikh Mujibur Rahman এর স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছি।এভাবেই বিশ্বাস করে এসেছি।'স্মরণীয় বরণীয় যারা' শিরোনামের প্রবন্ধে মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার অবদানকে স্বীকার করা হয়েছে।নির্মলেন্দু গুণের 'স্বাধীনতা এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো' নামক দীর্ঘ কবিতায় ৭ মার্চের ভাষণের প্রকৃত চিত্র উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। মাধ্যমিক পেরোনোর আগেই চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। নতুন বই হাতে নিয়ে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি বাংলাদেশের স্বাধীনতার নতুন ঘোষক পয়দা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জায়গায় এখন স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া। যে বঙ্গবন্ধুকে বাঙ্গালি জাতির জনক, বাংলাদেশের স্থপতি জেনে এসেছি তাঁর অবদান অবদান কে দুই একটি বাক্যের মধ্যে শেষ করে দেওয়া হয়েছে।পাঠ্যবইয়ের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্মরণীয় ব্যক্তির তালিকায় বঙ্গবন্ধুর নাম নেই। যে নিজামি, মুজাহিদরা বাঙ্গালি জাতির বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে অখন্ড পাকিস্তানের স্বপ্নে স্বজাতি নিধনে সহযোগিতা করেছিল তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ছবক দেওয়া শুরু করল। পত্রিকা পড়ার প্রচণ্ড আগ্রহ থেকে জানতে পারি বিএনপিপন্থি কিছু বুদ্ধিজীবীর পরামর্শে খালেদা জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক তত্ব নিজেদের মতো করে লিখাতে সম্মতি দান করেন যা জিয়াউর রহমান জীবদ্দশায় কখনোই দাবি করেননি। ঐ জ্ঞানপাপীরা জানেনা স্বাধীনতা শুধু কাগজে লেখা ৫ মিনিটের একটি ঘোষণা নয়।এটি অর্জন করতে দীর্ঘ কণ্টক পথ অতিক্রম করে আসতে হয়।শেখ মুজিব সে পথ অতিক্রম করেই জাতির পিতা ও স্বাধীনতার ঘোষকের মর্যাদা লাভ করেছে ।শেখ সাহেব নামক ক্ষণজন্মা পুরুষ কে বইয়ের পাতা থেকে মুছে ফেলা গেলেও কোটি মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যায় না।বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে এমন সত্যও আদালত কে নির্ধারণ করে দিতে হয়। তবুও কিছু মানুষ তা মানতে চায় না।

বিএনপি সরকারের বিদায়ের পর আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল নিশ্চয় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরবে এই আশাই আমরা করতে পারি। কিন্তু আশায় গুঁড়ে বালি। আওয়ামীলীগ আগের মেয়াদে লিখিত মুক্তি যুদ্ধের ঘোষণা কে চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা এমএ হান্নান পর্যন্ত থামিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণার অন্যতম পাঠকারী জিয়াউর রহমানের নাম তারা উল্লেখ তো করেইনি মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের নেতা এবং সেক্টর কমান্ডার জিয়াকে সংসদ, সংসদের বাইরে পাকিস্তানের দালাল, রাজাকার বলতেও দ্বিধা করেনি। রাজাকার পুনর্বাসন, বঙ্গবন্ধু হত্যায় রহস্যজনক ভূমিকা, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের প্রতক্ষ্য মদদ দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত সংবিধানকে পালটে দেওয়া ইত্যাদি কারণে তাঁর সমালোচনা হতেই পারে। সেটা ৭৫ পরবর্তী ঘটনা। তাই বলে ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান কে রাজাকার তকমা দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক? আওয়ামীলীগ এই কাজটি না করলে তাদের কি খুব ক্ষতি হতো? হুমায়ন আজাদ বলেছেন,"মুক্তিযোদ্ধা চিরদিন মুক্তিযুদ্ধা নাও থাকতে পারে,কিন্তু রাজাকার চিরদিনই রাজাকার"। তাই একাত্তরের বঙ্গবীর, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক এর ২০১৫ তে কিছু কথা মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে গেলে তাঁরা আপাদমস্তক রাজাকার হয়ে যায় না।তাঁদের বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করতে চাইলে, ইতিহাস তার সত্য ও কঠিন সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। তা আর ইতিহাস থাকে না, উপন্যাস হয়ে যায়।

প্রতিশোধের রাজনীতি আমাদের সবাইকে ইতিবেত্তা বানিয়ে দিয়েছে। আমরা সবাই ইতিহাসবিদ। আর বাংলাদেশের স্মরণকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদের উপাধি দেওয়া যায় তারেক জিয়াকে। লন্ডনে বসে তিনি ইতিহাসের নতুন নতুন সত্য উদঘাটন করেন আর লাদেনীয় কায়দায় বাংলাদেশ পাঠান। বাংলাদেশের কিছু চাটুকার তার দেওয়া মিথ্যা তথ্য কোরাসে প্রচার করতে থাকে। এই চাটুকারদের দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিজ্ঞ আইনজীবী, তুখোড় ছাত্রনেতা, কঠোর নামাজি, ৫০ টাকার বিনিময়ে মিছিলে অংশগ্রহণকারী সবাই আছে। এদের চক্ষু লজ্জার বালাই নেই,পদ ও অর্থের লোভে এরা নেতার মূত্রপান করতেও দ্বিধা করে না। তারেক রহমান তার গবেষণায় দেখতে পান বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তান প্রেমী। তারেক জিয়া যেমন ১/১১ এর সরকারকে আজো ভালবাসেন তেমন বোধ করি। তিনি গবেষণা করে দেখেন তার বাবা দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট। আমরা তার আরো গবেষণালব্ধ ফলাফল পেয়ে নিজেদের আরো সমৃদ্ধ করতে পারতাম কিন্তু হাইকোর্ট সে সুযোগ নষ্ট করে দিয়েছে। আমরা হয়তো একদিন জানতে পারব বাংলাদেশ মূলত স্বাধীন হয়েছে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর যার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে ২৭ মার্চ, ১৯৭১।

একাত্তরের রাজাকার জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিষফোঁড়া। ইসলাম রক্ষার নামে তারা একাত্তরে নিজের ভাইকে হত্যা, মা -বোন কে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করেনি। তবুও তাদের মনোবাসনা পূর্ণ হয়নি। তাই জামাত নেতারা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ কে গৃহযুদ্ধ বলে মনের ঝাল মিটাতে চাইছে। জামাতি রাজাকার রা মনে করে হয় নারীর লোভে অথবা অর্থের লোভে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে গিয়েছিল। তারপরও কিছু মুক্তিযোদ্ধার তাদের প্রতি ভালোবাসাই মানুষকে মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকার বলতে উদ্ধুদ্ধ করে। রাজাকার পুত্ররা রাজাকারদের চেয়েও এগিয়ে। তাদের মনে হয় একাত্তরে শহীদের সংখ্যা অথবা নির্যাতিত মা বোনের সংখ্যা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের রায় নিয়ে মনগড়া তথ্য দিচ্ছে। তাদের কিছু পেইড এজেন্ট কথাগুলোকে প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছে।আর ডেভিড বার্গম্যানরা আমাদের ইতিহাস শিক্ষা দিতে চাচ্ছে।স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের কিছুই করতে পারছে না বা করছে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর সময় নাৎসি গণহত্যায় অসংখ্য মানুষ মারা যায়। ইউরোপের অনেক দেশে সেই গণহত্যাকে অস্বীকার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। খেলার মাঠে, বা চলতে গিয়ে নাৎসিদের প্রতি কোন ভালোবাসা দেখালে সবাই ছিঃ ছিঃ করে ওঠে। ওই মানবতা বিরোধী অপরাধে সমর্থন দেওয়ার কারণে অনেক রাজনীতিবিদ, লেখক, ধর্মযাজক কে শাস্তি পেতে হয়েছে।অথচ বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিপক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কেউ কোন কথা বললে তাকে মিডিয়ায় প্রচারের আলোয় নিয়ে এসে নায়ক বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

তাই এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তার ইতিহাসকে বিকৃত করে, এমন ব্যক্তি গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইন হোক, সে আইনের প্রয়োগ হোক। কেউ যেনো আর কখনোই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা, নির্যাতিত মা-বোনের সংখ্যা, মুক্তি বাহিনীর কর্মকাণ্ড, একাত্তরে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের কুকীর্তি ইত্যাদি স্বাধীনতা ইতিহাসের মৌলিক বিষয় নিয়ে অসত্য বক্তব্য না রাখতে পারে।

তারিখঃ ১৪/০৬/২০১৫ ইং
ছবি ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
শহিদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান ডা. নুজহাত চৌধুরীর লেখা ইতিহাস-বিকৃৃতিরোধে আইন করার এখনই সময় নিবন্ধটিও পড়ে দেখতে পারেন।