সৌন্দর্যের উৎস-মানুষটি নাকি বৃক্ষটি নাকি রঙের ফোয়ারাটি নাকি সুরের ঝর্ণাটি … আমাদের ভালোবাসার মানুষটি, যাঁর তুলির আঁচড় দেখে বড় হয়েছি। আজও থাকি দেখার প্রতীক্ষায়। আমাদের মন ভরাতে, চোখ জুড়াতে তিনি তাঁর পাতা-ফুল-পাখি-বর্ণমালায় সুগন্ধি মেখে দিতেন। আমরা তাঁর শিল্পের দর্শক। গণমানুৃষ, পত্রিকা পাঠক সবাই তাঁর শিল্পের দর্শক। আমরা সবাই চোখ দিয়ে শুকে নিতাম তাঁর পাঠানো বর্ণগন্ধময় শিল্পকর্ম, বলতাম, আহা। নিত্যনতুন সেই বর্ণগন্ধময় শিল্পকর্ম দেখা ও সুগন্ধি নেওয়া, তা আর সামনের দিনগুলোতে হওয়ার নয়। তার ভালোবাসায় রাঙা এবারের বিজয়ের বর্ণমালা রঙে রেখায় সেজে আমাদের হাতে আসবে না। সৌন্দর্যের উৎস-মানুষটি নাকি বৃক্ষটি, তার শেষ কথাটি বলতে গিয়ে প্রাণ হারাল। আর দেবে না সে সৌন্দর্যে রাঙা চির বসন্তের পাতা ও ফুল উপহার। আর দেবে না পাতায় পাতায় বর্ণমালা।
তিনি /যিনি রং সৌন্দর্য ছড়াতেন, আলোক ছিটাতেন রঙিন আলোক। ৮২ বছরের জীবনে, ৬৫ বছর ধরে বিলিয়েও তিনি তার ভেতরের সব রং সব আলো শেষ করতে পারেন নি। শেষ আলো দিতে গিয়েই বিদায় নিলেন। শেষ কথাটি তাঁর হল না বলা।
সৌন্দর্যের উৎস-মানুষটি নাকি বৃক্ষটি নাকি রঙের ফোয়ারাটি নাকি সুরের ঝর্ণাটি … ভালোবাসার মানুষটি… তিনি ছবি, বর্ণ শব্দ এঁকে গেছেন অবিরাম. অভিরাম। বইয়ের প্রচ্ছদসহ তাঁর আঁকা ও রং করা ছবি উপহার হয়ে আসত আমাদের হাতে। তার পাখি আমাদের মনকে উয়ে দিত, উড়িয়ে নিয়ে যেত ইচ্ছে ও স্বপ্নের দেশে সবুজ ভুবনে। তার বর্ণমালা আমাদের ভাষার সৌন্দর্যকে (লিখন শুধু নয় …) তুলে ধরত পরম ভালোবাসায় বিশেষ দিনে যেন আমরা বাংলার সৌন্দ
র্য ভুলে না যাই তাই বারবার ফিরে ফিরে তিনি পাঠাতেন তার উপহার।
প্রকৃতির নিয়মেই ঝরে গেলেন সৌন্দর্যের চারণ শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। রেখে গেছেন দীর্ঘ জীবনের রঙে রেখায় বর্ণমালার সম্ভার। তাঁর আঁকা বর্ণ-নক্সাগুলো হারিয়ে না যায়, সংগ্রহ করে রাকা হোক বাংলার অসামান্য সম্পদ হিসেবে।
এই মাত্র জানা গেল, আনিসুল হকের এর লেখা 'সুন্দরের রূপকার সুন্দর মানুষটি" থেকে "তিনি প্রথম আলোকে দিয়ে গেছেন পুরো বর্ণমালার ক্যালিগ্রাফি, সেটা ফন্ট হিসেবে আমরা বহু দিন ব্যবহার করতে পারব। তিনি শিল্পের শহীদ, শিল্পে সমাহিত এবং তাঁকে অনুসরণ করবে অমরত্ব।" হাহ্ বাঁচা গেল আরও বহু দিন দেখতে পাব তাঁর বর্ণমালার ক্যালিগ্রাফি।
সংক্ষিপ্ত জীবনী: শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর জন্ম ১৯৩২ সালের ৯ মার্চ ফেনীতে। বাবা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী কো-অপারেটিভ ব্যাংকের সহকারী রেজিস্ট্রার ছিলেন। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে ঘুরেছেন দেশের বহু জায়গা।
সব সময় শিল্পী বলতেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মনের মধ্যে ছবি আঁকার ইচ্ছেটা তৈরি করে দিয়েছিলেন। আমৃত্যু ইচ্ছেটাকে লালন করে গেছেন, দারুণভাবে তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ১৯৬০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ২৯ বার তিনি শিল্পকলা একাডেমী অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
বাংলাদেশের বইয়ের প্রচ্ছদের পালাবদলের অন্যতম রূপকার তিনি। ১৯৭৫ সালে ন্যাশনাল বুক সেন্টার আয়োজিত প্রচ্ছদ প্রদর্শনীতে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে প্রথম চিত্রকর্মের প্রদর্শনী করেন। এক সাক্ষাৎকারে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছেলেবেলায় নিজের লাইব্রেরির যেসব বইয়ের প্রচ্ছদ নষ্ট হয়ে যেত, সেগুলো নতুন করে করতেন তিনি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম প্রচ্ছদ করেছেন ১৯৫৩-তে। ১৯৫৪ সালে গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস থেকে তিনি ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন তিনি। সবচেয়ে ভালোবাসতেন লুঙ্গি পরনে মাথায় গামছা বাঁধা অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি আঁকতে। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে কৃষক-শ্রমিকসহ সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ তাঁকে বারবার আন্দোলিত করেছে। অবসরে গান শুনতেন, ধ্রুপদি গানের একনিষ্ঠ শ্রোতা ছিলেন। শুনতেন অতুল প্রসাদ। গুন গুন করে প্রায়ই গাইতেন কাজী নজরুল ইসলামের গান, 'হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে/ কুড়াই ঝরা ফুল একেলা আমি।'
প্রথম আলোর সঙ্গে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। পত্রিকার মাস্টহেডও তাঁর করা। প্রথম আলোর প্রথম দিন থেকে আমৃত্যু নিবিড় ছিল এই যোগাযোগ।
সারা জীবন কাজ করেছেন, একনিষ্ঠভাবে করেছেন শিল্পসাধনা। পেয়েছেন যশ, খ্যাতি আর অগুণতি মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা। কাজপাগল মানুষ ছিলেন তিনি। তাই বুঝি কাজ করতে করতেই চলে গেলেন। তবু জীবনের শেষ কথাটি আর বলা হলো না তাঁর।
সম্মাননা:শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, সুফিয়া কামাল পদক, শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও পদক পেয়েছেন।
শোক: শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রীশেখহাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামাননূর। শোকবিবৃতি পাঠিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ আরও অনেকে।
(সংক্ষিপ্ত জীবনী অংশের পুরোটাই প্রআ থেকে ধারকৃত, স্চ্ছো ঋণকৃত)