বাংলালিংকের বিকাশ জালিয়াত চক্রের পাল্লায়

শারমিন আকতার
Published : 18 Jan 2017, 03:10 AM
Updated : 18 Jan 2017, 03:10 AM

Congratulation! Apni paschen "Bkash & BRAC N.G.O" pokkho theke "STUDENT SCHOLARSHIP"(tk-10499/) your amount ID: 1515. Now select your CANDIDATE. Bistarito Jante Call Korun . Office: 01920369579 {11 am to 5 pm} othoba "Ok" likhe SMS korun.amra Apnar kase call korbo! Nijer akta Bkash account thakte hobe.17/01/2017

গতকাল সকাল বেলায় অফিস যাবার আগ মুহূর্তে মোবাইলে বাংলালিংক নম্বরে এসএমএস পায় জেসমিন মালিহা। সে এসএমএসটা প্রথমে তেমন কোন পাত্তা দেয় না। ভাবে গ্রামীণফোন থেকেও তো এই রকম ইনস্যুরেন্স কাভারেজের নানা মেসেজ প্রায় প্রতিমাসে  আসে। কিন্তু কাজের ফাঁকে হঠাৎ করে একটা ওকে লিখে পাঠিয়ে দেয় ঐ নাম্বারে। কয়েক ঘণ্টা পর লাঞ্চ বিরতিতে সে দুপুরের খাবার সেরে যখন আবার নতুন করে অফিসের কাজে যোগ দিবে সেই সময় তার মোবাইলে কল আসে।

-হ্যালো! আমরা ব্র্যাকের হেড অফিস থেকে বলছি। বাংলালিংকের একজন লাকি কাস্টমার হিসাবে আপনাকে স্বাগতম। আমরা সারা দেশ থেকে ১০০ টি বাংলালিংক নাম্বার নির্বাচন করেছি যাদেরকে স্টুডেন্ট স্কলারশিপ দেয়া হবে। ম্যাডাম আপনি কি একজন স্টুডেন্ট?

খুব সুন্দর করে ফোন অপারেটরের স্মার্ট লোকদের মত করে জিজ্ঞাসা করল একজন (জালিয়াতি ব্যক্তি)।

– না।

– কোন সমস্যা নেই ম্যাডাম। আপনার পরিবারে কি এমন কেউ আছেন যিনি স্টুডেন্ট। আপনি চাইলে অন্য আর একজন ক্যান্ডিডেট সিলেক্ট করতে পারবেন। আপনার কি এমন কেউ আছে ম্যাডাম? তাহলে আমরা তার নামটা রেজিস্ট্রেশন করে ফেলব।

– হ্যাঁ আছে। আমার ছেলে।

– কি নাম তার?

– আসিফ জাহিন

– সে কোন ক্লাসে পড়ে?

-নার্সারিতে।

– একটু ম্যাডাম আমরা তার নামটা একটু রেজিস্ট্রেশন করে নিচ্ছি। একটু প্লিজ তার স্কুলের নাম।

– এম হামিদ আদর্শ বিদ্যা নিকেতন।

– ম্যাডাম আপনাদের জেলা ও থানার নাম?

– জেলা ও থানা দুটোই ঝিনাইদহ। আমরা ঝিনাইদহ সদরেই আছি।

– ম্যাডাম আপনাদের হোম ডিসট্রিক্ট প্লিজ –

– হোম ডিসট্রিক্ট পঞ্চগড়।

-ওকে ম্যাডাম আমি এখনই আপনার ছেলের নাম রেজিস্ট্রেশন কমপ্লিট করে ফেলছি। আপনি মোবাইলে একটা টোকেন নাম্বার যাবে। ওইটা একটু বলবেন ম্যাডম প্লিজ। এই নাম্বারসহ মোট ১০০ জন রেজিস্ট্রেশনকারীর টোকেন নাম্বার কালকে প্রথম আলোতে প্রকাশিত হবে। আগামীকালের ম্যাডাম প্রথম আলো সংগ্রহ করবেন প্লিজ। আর ম্যাডাম টোকেন নাম্বার কত গেল?

-৪৩৯৬

(Banglalink  থেকে এস এম এস আসে "Thank you, Your itoken  number is 4396)

– ওকে ম্যাডাম ৪৩৯৬, আপনার এই টোকেন নাম্বার দিয়ে আপনার ছেলের রেজিস্ট্রেশন আমরা একটিভেট করে দিলাম। ম্যাডাম প্লিজ কালকে প্রথম আলো নিতে ভুলবেন না।

– ওকে।

– রেজিস্ট্রেশনের পর যে টোকেন নাম্বার আপনাকে দেয়া হল ম্যাডাম এটা দিয়ে আপনি আপনার এলাকার বাসার কাছের ব্র্যাক অফিস থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর ১০৪৯৯ টাকা করে স্টুডেন্ট স্কলারশিপ হিসাবে সংগ্রহ করতে পারবেন। তবে সাবধান ম্যাডাম আপনার এই টোকেন নাম্বার যেন আজকে কেউ না জানে। জানলে এই নম্বর ব্যবহার করে যে কেউ সে স্কলারশিপের বেনিফিট পেতে পারে।

– ওকে জানবে না।

– আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ম্যাডাম।

– ধন্যবাদ আপনাকেও।

কল কেটে দেয় হ্যাকার। একটু পরে আবার কল আসে ওই ব্যক্তির (জালিয়াতের) কাছ থেকে।

-হ্যাঁ ম্যাডাম আমাদের ব্র্যাক অফিসে বাংলা লিংকের মাধ্যমে বন্টিত এই স্কলারশিপের নিয়ম হল ম্যাডাম আমাদের অফিস থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর যে স্কলারশিপ দেয়া হবে তার আগে আপনার বিকাশ অ্যাকাউন্টে ১৫০০ টাকা থাকতে হবে ম্যাডাম। বাচ্চার খাতা কলম, বই, স্কুলে যাতায়াত খরচ সব কিছু মিলিয়ে অবিভাবক সঞ্চয় করছে কি না এটা যাচাই করার পর দেয়া হয় ম্যাডাম। আপনার কি এই মোবাইল টা বিকাশ নাম্বার ম্যাডাম?

– না।

– আপনার বা আপনার পরিবারের অন্য কারও কি বিকাশ নাম্বার আছে ম্যাডাম? যেটাতে আমরা প্রতি তিন মাস অন্তর টাকা পাঠাবো।

– হ্যাঁ, আমার নিজেরই আছে। গ্রামীণ নাম্বার সেটা।

– একটু বিকাশ নাম্বারটা কি দিবেন ম্যাডাম? আমরা রেজিস্ট্রেশনের তালিকায় ইনক্লুড করতাম। তবে ম্যাডাম খুব সাবধান আপনার বিকাশ পিন নাম্বার কাউকে বলবেন না। ম্যাডাম আপনি জানেন তো ব্রাকেরই বিকাশ।

– হ্যাঁ, জানি। কিন্তু আমি একটু কনফিউজড। এভাবে কেন আমাকে স্কলারশিপ দেয়া হচ্ছে?

– ম্যাডাম কালকে প্রথম আলো নিবেন। সব কনফিউশন ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আসলে আপনার কনফিউজড হবারি কথা। এভাবে বিকাশের অনেক ফ্রড জালিয়াতি করছে তো ম্যাডাম তাই আপনি আস্থা রাখতে পারছেন না। নো প্রোব্লেম ম্যাডাম। এখনই আমরা বাংলা লিংকের সহায়তায় আপনার কনফিউশন দূর করার চেষ্টা করছি। ম্যাডাম আপনার মোবাইলে এই মুহূর্তে আছে আট টাকা পঁচিস পয়সা, আপনার মোবাইলে এই মাসের নয় তারিখে ফ্লেক্সি করেছেন ২৯ টাকা। গত মাসের ১৫ তারিখে ফ্লেক্সি করেছেন ৭৯ টাকা, গত মাসের আগের মাসে ফ্লেক্সি করেছেন ৭৯ টাকা। ঠিক না ম্যাডাম?

– জ্বি, ঠিক আছে কিন্তু…

– বুঝতে পারছি ম্যাডাম আপনার কনফিউশন যাচ্ছে না এখনও। দেখুন ম্যাডাম আপনার মোবাইলের এফএনএফ নাম্বার এখনই আমরা পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমরা ফ্রড হলে তো এতো তথ্য দিতে পারতাম না। এসএমএস দেখুন তো ম্যাডাম তিনটা এফ এন এফ নাম্বার কি না?

হ্যাঁ সত্যি সত্যি সঠিক এফএনএফ নাম্বার চলে আসে বাংলা লিংকের ১২৩১২৩ এসএমএস আসলো। যেখান থেকে মাঝে মাঝেই এসেমেস আসতো।

Your current FnF numbers are 1: 01913…. You are allowed to change this number …2:  01924… 3: 019370….

এবার তো মালিহা জেসমিন কে বিশ্বাস করতেই হল যে তারা কোন বিকাশ ফ্রড না।

– হ্যাঁ, আসছে এফএনএফ নাম্বার।

-এবার বিশ্বাস হচ্ছে তো ম্যাডাম। আপনি চাইলে আমরা আরও তথ্য আপনাকে দিতে পারব। আপনি কার সাথে কোন নাম্বারে কবে? কতক্ষণ? কি বলেছেন? ডিটেইলস। আর কি কিছু জানবেন ম্যাডাম?

-না থাক।

-ম্যাডাম তাহলে আপনার মোবাইলের বিকাশ আকাউন্টে ১৫০০ টাকা জমা করে আমাদের এই অফিসিয়াল নাম্বারে 'ok' লিখে এসএমএস দিলেই আমরা আপনাকে ১০৪৯৯ টাকা পাঠিয়ে দেব।

-আজ না কালকে। আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি।

এই ফাঁকে সে একটু সময় নিতে চাচ্ছে। আগামীকালের প্রথম আলোতে আদৌ এই ব্যাপারে কিছু আসে কিনা নিউজ। কিন্তু জালিয়াত চক্র কি আর তাকে সময় দিবে!

-কিন্তু ম্যাডাম আমরা যে আপনার এটা রেজিস্ট্রেশন করে ফেলেছি। ১০০ জন গ্রাহকের থেকেই এই তথ্য নেয়ার পর তাদের বিকাশ আকাউন্টে ১৫০০ টাকা জমা রাখতে বলা হচ্ছে। আপানার বেবির জন্য নিজের মোবাইলেই তো সঞ্চয় করবেন ম্যাডাম। এতে প্রোব্লেম কি?

মালিহা ভাবলো ঠিকই তো। নিজের মোবাইলেই তো সঞ্চয়।

-আচ্ছা ঠিক আছে।

-তাহলে ঠিক আছে ম্যাডাম। আপনার মোবাইলে ১৫০০ টাকা বিকাশ করার পর আমাদের এই অফিসিয়াল নাম্বার ০১৯২০৩৬৯৫৭৯ এ " ok" লিখে পাঠিয়ে দিলেই হবে।

-ওকে।

কথা শেষ হয় হ্যাকারের সাথে। অফিসের অন্য এক কলিগের সাথে সে এই বিষয়টা একটু শেয়ার করে যে ব্র্যাকের স্টুডেন্ট স্কলারশিপ পাচ্ছে বাংলালিংকের  নির্বাচিত ১০০ জন কাস্টমারের মধ্যে একজন হিসাবে। কলিগ তাকে জানায় হা ব্রাক থেকে তো এমন স্কলারশিপ দেয়। এইটুকু শুনে সে কিছুটা আস্বস্থ হয়। কিন্তু বিকাশ করার ব্যাপারে তেমন কিছু আর বলে না।

অফিস থেকে একটু ফাঁকে সে বের হয় ৪.৩০ এর দিকে। ১৫০০ টাকা মোবাইলে বিকাশ কর নেয় এবং ওকে লিখে এসএমএস দেয়। সাথে সাথে জালিয়াত চক্র কল করে-

– ম্যাডাম তাহলে এখন আমি যা যা বলছি করুন আপনার মোবাইলে ১০৪৯৯ টাকা যোগ হয়ে যাবে আপানার মোবাইলে মোট বিকাশ অ্যামাউন্টের ব্যাল্যান্স দেখে নিবেন।

– ওকে।

– ম্যাডাম, আমি আপনার সাথে যে মোবাইলে কথা বলছি এটাতেই কি আপানার বিকাশ নাম্বারটা আছে?

– জ্বি।

– তাহলে তো আমাদের পাঠানো টাকাটা আপনি দেখতে পারবেন না ম্যাডাম। মোবাইল অফ থাকবে।

হ্যাঁ কথা সত্য। একই মোবাইলে দুইটা সিম তোলা থাকলে একটা দিয়ে কথা বললে আর একটা বন্ধ থাকে। হ্যাকার আবার বলল ম্যাডাম আর একটা কারও মোবাইল নাম্বার আমাদের দিন ওইটা তে কথা বলে আমরা আপনাকে ইন্সট্রাকশন যা দিব তা করলে আপানার মোবাইলে টাকা চলে যাবে। হ্যাকারের কথা মত সে বিভিন্ন রেফারেন্স নাম্বার, সফট টোকেন নাম্বার ও বিকাশ পিন নাম্বার চাপে তার মোবাইলে ১০৪৯৯ টাকা আসে এবং এবং তার ১৫০০ সহ সব টাকা আবার চলে যায় জালিয়াত চক্রের অন্য একটা নাম্বারে।

এখন কি করবে সে! পরে নিজের মোবাইলে বিকাশ আকাউন্টে দেখে আর কোন টাকা নেই। অফিস শেষে পরে মালিহা জেসমিন বাংলালিংকের কাস্টমার কেয়ারে যায় সব খুলে বলে। তাদের অপারেটরের তথ্য কিভাবে একজন বিকাশ জালিয়াত চক্রের সদস্য জানতে পারে। তাদের সব তথ্য সঠিকভাবে জানে বলেই তো সে সেই ফ্রডকে বিশ্বাস করেছে। বাংলালিংকের কাস্টমার কেয়ার থেকে জানায় তাদের বাংলালিংকের কিছু এক্স-এমপ্লয়ি এমন কাজ করছে। বেশ কিছু স্মার্ট, আইটি এক্সপার্ট এগুলো করছে। যারা বিভিন্ন হ্যাকিং ও জালিয়াত এর কারণে চাকুরিচ্যুত হয়েছে। মালিহা ঐ জালিয়াত সদস্যের তথ্য জানতে চায়। জবাবে কাস্টমার কেয়ার থেকে জানতে পারে যে তারা এতো এক্সপার্ট যে তাদের সব তথ্য বংলা লিংকের সার্ভার থেকে ডিলিট করে দিয়েছে।

বিঃ দ্রঃ ০১৯২০৩৬৯৫৭৯, এটা ওই হ্যাকার জালিয়াত সদস্যের সত্যিকারের নাম্বার। আর ৪৩৯৬ টোকেন নাম্বার দিয়ে সে মোবাইলে সকল তথ্য হ্যাক করেছিল।

***

গতকালের সত্য ঘটনা অবলম্বনে, জনসচেতনতার জন্য এই লেখার অবতারণা।