আদালতের হাতে বিকল্প শাস্তি আইনের মানবিকতা

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 30 July 2012, 07:26 AM
Updated : 30 July 2012, 07:26 AM

আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হচ্ছে দণ্ড বিধি। এটা বহু আগে রচিত। সেই ১৮৬০ সালে। এখানে অপরাধের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে ও কোন অপরাধের কি শাস্তি তা নির্ধারণ করা হয়েছে। অবশ্য দণ্ড বিধির পরেও হাজারো আইন হয়েছে। সেগুলোতে কিছু কিছু নতুন অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং সেগুলোর শাস্তিও নির্ধারিত হয়েছে। তবে, অপরাধের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু এখনও দণ্ডবিধির উপরই নির্ভরশীল। কেননা, দণ্ডবিধিতে আমাদের সমাজে সংঘটিত চিরায়ত অপরাধগুলো নিখুঁতভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

দণ্ডবিধিতে কোন অপরাধের জন্য একটিমাত্র শাস্তির বিধান স্বাভাবিকভাবেই নেই। কারণ, মানুষের অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকারের কারণ থাকে। মানুষ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পড়ে বিভিন্ন প্রকারের অপরাধ করতে পারে। যে অপরাধের জন্য কোন আদম সন্তানকে অভিযুক্ত করা হয়, অপরাধ সংঘটনের সময় সকল পরিস্থিতি তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নাও থাকতে পারে। তাই তো ভাষায় প্রকাশের সময় সাধারণ মানুষও বলেন ঠাণ্ডা মাথায় খুন, পরিকল্পিত, পূর্ব পরিকল্পিত, দুর্ঘটনা বসত, রাগের বশবর্তীতে হয়ে, বাধ্য হয়ে, অন্য কোন উপায় না পেয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি।

এমতাবস্থায়, আইন বিজ্ঞান দণ্ড প্রদানের ব্যাপারে আদালতের হাতে কিছু কিছু বিকল্প তুলে দেওয়া হয়েছে। যেমন, হত্যার ক্ষেত্রে আমাদের দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় বলা হয়েছে-

"Whoever commits murder shall be punished with death, or 2[imprisonment] for life, and shall also be liable to fine".

অর্থাৎ হত্যার অপরাধের শাস্তি শুধু মৃত্যুদণ্ড নয়। আদালত হত্যার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও দিতে পারেন। এখানে একটা বিকল্প রয়েছে। বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় দণ্ডবিধির ৩০২ হল একটি নীতিনির্ধারণী ধারা।

চুরির অপরাধের শাস্তির ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৩৭৯ ধারায় বলা হয়েছে,
"Whoever commits theft shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to three years, or with fine, or with both".

অর্থাৎ চুরির অপরাধের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া যায় যার মেয়াদ সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে। চোরকে কারাদণ্ড না দিয়ে শুধু জরিমানাও করা যায় ( যার সীমা দেওয়া নাই) কিংবা কারাদণ্ড বা জরিমানা দুই শাস্তি এক সাথেও দেওয়া যায়।

আরো একটি জঘন্য অপরাধের সংজ্ঞা দেওয়া আছে দণ্ড বিধিতে। তা হল খুন সহ ডাকাতি। খুনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যু দণ্ড। ডাকাতির সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু খুনসহ ডাকাতির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

"death, or 2[imprisonment] for life, or rigorous imprisonment for a term which may extend to ten years, and shall also be liable to fine."
কিন্তু এই সব অপরাধের শাস্তির ক্ষেত্রে সব স্থানেই বিকল্প চিন্তার সুযোগ আইন বিচারককে দিয়েছে।

তবে দণ্ডবিধিতে দুইটি ধারায় শাস্তির বিধানে বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয় নাই। এটা হলা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কোন অপরাধী কর্তৃক হত্যা বা হত্যা প্রচেষ্টার শাস্তি।

হত্যা প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে সাধারণভাবে সশ্রম বা বিনাশ্রমে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। কিন্তু অভিযুক্ত যদি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হয়, তাহলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। তবে এক্ষেত্রেও ধারায় Shall শব্দটি ব্যবহার না করে May শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

"When any person offending under this section is under sentence of 3[imprisonment] for life, he may, if hurt is caused, be punished with death".

অর্থাৎ এখানে আদালতের স্বাধীন মতামতের সুযোগ রাখা হয়েছে।

দণ্ডবিধিতে একটি মাত্র ধারা আছে যেখানে অভিযুক্তের একমাত্র শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড। এটা হল ৩০৩ ধারা।

"Whoever, being under sentence of 2[imprisonment] for life, commits murder, shall be punished with death".

অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইতোমধ্যেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি পেয়েছেন, তিনি যদি খুন করে বসেন তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ছাড়া আদালতের অন্য কোন উপায় নেই।

কোন অপরাধের একমাত্র শাস্তি হিসেবে মৃত্যু দণ্ড প্রদানের বিষয়টি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টেও উত্থাপিত হয়েছিল। অধুনা বিলুপ্ত নারী ‌ও শিশু নির্যাতন দমন(বিশেষ বিধান)- ১৯৯৫, আইনের ৬(২) ধারার অধীন ১৯৯৯ সালে রুজুকৃত একটি মামলায় ২০০১ সালে প্রদত্ত রায়ে মানিকগঞ্জ জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন বিশেষ আদালতে একই জেলার শিবালয় থানার শিবরামপুর তেপরা গ্রামের মৃত হাসেম মণ্ডলের পুত্র মোঃ সুকুর আলীকে ধর্ষণ ও হত্যার অপরাধে মৃত্যু দণ্ড প্রদান করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে সুকুর আলী হাইকোর্টে আপীল করেন। কিন্তু ২০০৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী দেওয়া রায়ে হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায়কে বহাল রাখেন। এর পর আসামী পক্ষ আপিলেট ডিভিশনে দরখাস্ত করেন। আপিলেট ডিভিশনও ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারীর রায়ে হাইকোর্ট ডিভিশনের রায়কে বহাল রাখেন। এর পর আপিলেট ডিভিশনে রিভিও পিটিশন করা হলে ৪/৫/২০০৫ তারিখের রায়ে তাও খারিজ হয়ে যায়।

এর পর বাংলাদেশ লিগাল এইডস এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (BLAST) ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে হাইকোর্টে এই ধারায় বর্ণিত অপরাধের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধানের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্চ করে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন।( রিট পিটিশন নং-৮২৮৩/ ২০০৫)। দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে ২০১০ সালের ২ মার্চ তারিখে হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ ঈমান আলী ও বিচারপতি শেখ আব্দুল আউয়ালের দ্বৈত বেঞ্চ অধুনালুপ্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (বিশেষ বিধান) আইনের ৬(২) ধারাকে বাতিল ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন। রায়ে বলা হয়, অপরাধের প্রকৃতি যাই হোক না কেন সেই অপরাধের একমাত্র শাস্তি হিসেবে মৃত্যু দণ্ড গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬(২) অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। অধিকন্তু কোন অপরাধের একমাত্র শাস্তি মৃত্যু দণ্ড আদালতের অধীক্ষেত্রকে সংকুচিত করে।

মানুষ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন প্রকার অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। তাই আইনে আদালতকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে যাতে আদালত সব দিক বিবেচনা করে বিচ্যূত চরিত্রের অধিকারী মানুষগুলোর অপরাধের জন্য যন্ত্রের মতো নয়, মানুষের মতো রায় দিতে পারে।

সূত্রঃ
১.দণ্ড বিধি; http://bdlaws.minlaw.gov.bd/print_sections_all.php?id=11
২. http://www.blast.org.bd/content/judgement/wp8283-2005shukurali.pdf as on 28/07/2012 at 14:00 and also at Staff Reporter, Thd Daily Star,Wednesday, March 3, 2010; available at http://www.thedailystar.net/newDesign/news-details.php?nid=128499; as on 28/07/2012 at 11:00 hours