ব্রিটিশ রানীর মেহমান ও বাংলাদেশ পুলিশের আসামীগণ

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 10 August 2012, 02:22 PM
Updated : 10 August 2012, 02:22 PM

ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থায় আইনের হেফাজতে আসা আদম সন্তানদের বলা হয় রানীর মেহমান (Queen's Guest)| কারণ, রাষ্ট্রের হেফাজতে আসা সকল নাগরিককে ভাত-কাপড় দেওয়ার দায় খোদ রাষ্ট্রের। তাই, ব্রিটিশ পুলিশের হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের খাওন-পরনের ভার পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তিগতভাবে নিতে হয় না। কিন্তু, বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যরা প্রতিনিয়তই ব্যক্তিগত খরচে আসামীদের ক্ষুন্নিবৃত্তি করে।

সরকারি দায়িত্ব পালন করতে পুলিশ অফিসারদের পকেট থেকে প্রতিনিয়তই অর্থ ব্যয় করতে হয়। আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে প্রেরণ, ক্ষেত্রমতে হাসপাতালের সিটভাড়া, ডাক্তার বা ঔষধের দোকানের বিল পরিশোধ, হেফাজতে আসা নারী ও শিশুদের থাকা খাওয়া, এমনকি আশুপ্রয়োজনীয় ন্যূনতম পোষাক-পরিচ্ছদ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে পুলিশকে কিনে দিতে হয়।

২০০৭ সালে মাগুরা জেলায় একটি বেওয়ারিশ শিশুর পরিচয় উদ্ঘাটন হলে তাকে নিলফামারী জেলার জলঢাকা থানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তৎকালীন মাগুরা সদর থানার অফিসার-ইন-চার্জ জনাব মোশারফ হোসেন। বিআরটিসি গাড়িতে কোন প্রকারে তাকে একজন কনস্টেবলসহ উঠিয়ে দেওয়া হলেও গাড়ির কনডাকটর সেই শিশু ও সঙ্গীয় কনস্টেবলকে সম্পূর্ণ বিনা খরচে পরিবহণ করতে রাজি হননি।

উত্তরা মডেল থানায় গত মাসে গ্রাম থেকে সদ্য শহরে আসা এক মহিলা তার স্বামীসহ অন্য কয়েক জনের বিরুদ্ধে গণধর্ষণের অভিযোগ করে। অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে মহিলাকে থানায় রাখা জরুরী হয়ে পড়ে। কিন্তু মহিলার পরিধেয় বস্ত্র নোংরা হওয়ায় এবং তা ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়ে। তথন সেই অভিভাবকহীন মহিলাকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এক সেট নতুন পোষাক কিনে দেন।

অবশ্য এই সব কারণে থানা-পুলিশের অর্থ খরচ কিছুটা অনিয়মিত। নিয়মিতভাবে যে খচরটি থানা পুলিশকে নিজের পকেট থেকে করতে হয়, তাহল, গ্রেফতার, রিমান্ড বা অন্য কোন কারণে পুলিশের হেফাজতে আসা আদম সন্তানগুলোর দৈনন্দিন খাবরের আয়োজন করা।

প্রতিদিন থানা বা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে বিপুল সংখ্যক মানুষ গ্রেফতার হয়ে বা অন্য কোন কারণে অবস্থান করে। পিআরবি এবং অন্যান্য আইনের নির্দেশনা মতে এই সব ব্যক্তির দৈনিক খোরাকী নগণ্য পরিমাণে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের তহবিলে আসত।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারা শাখা-২ থেকে একই মন্ত্রণালয়ের জন্য নির্ধারিত প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তাকে লেখা পত্র স্বঃমঃ (কারা-২)/১-বি-৪/২০০৫/১২০ তারিখ ০১/১০/২০০৬ মোতাবেক বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক (মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার) পাঠানো পত্র মোতাবেক বরাদ্ধকৃত পত্রে বলা হয়েছে 'খোরাকী বাবদ প্রতিদিন মাথাপিচু ১০/- টাকার বেশি খরচ করা যাইবে না'।

এই নির্দেশনা ছিল ২০০৬ সালের। তবে অর্থের পরিমাণ যাই হোক কেন, এই অর্থ থানা বা পুলিশ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল না। প্রথমে এই অর্থ থানার পুলিশ অফিসারদের নিজ পকেট থেকে ব্যয় করতে হতো। পরে অবশ্য অফিসার-ইন-চার্জ উপযুক্ত বিল ভাউচার উপস্থাপন করে তা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের তহবিল থেকে উত্তোলন করতে পারতেন।

কিন্তু ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে নিম্ন আদালত নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হলে এই অর্থ এখন আর ডিসি সাহেবদের তহবিলে আসে না। আমি জুডিশিয়াল আদালতেও খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের অনুকূলে পুলিশ হেফাজতে থাকা আসামীর খোরাকীর জন্য কোন অর্থ বরাদ্ধ নেই। এর মানে হল, আসামীকে হেফাজতে নিয়ে এলে পুলিশ অফিসারদের ব্যক্তিগতভাবে তাকে খাওন-দাওন দিতে হয়।

সাধারণত তিনটি কারণে নাগরিকগণ পুলিশের হেফাজতে আসতে পারে। যথা- বিনা পরোয়ানায় বা পরোয়ানা বলে গ্রেফতার হয়ে, নিয়মিত মামলার আসামী হয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজনে রিমান্ডের ক্ষেত্রে এবং নিরাপত্তা হেফাজতে যেমন, মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী কিংবা কোন মামলার ভিকটিম, যারা প্রায় ক্ষেত্রে নারী বা শিশু হয়ে থাকে। অবশ্য অনেক সময় জেলখানা থেকেও বিচারাধীন মামলার আসামীগণ পুলিশ হেফাজতে, বিশেষ করে, কোর্ট পুলিশের হেফাজতে আসে। কিন্তু এইসব ব্যক্তির দুপুরের খাবার জেলখানা থেকে সরবরাহ করা হয় না।

অনেক সময় বিচারাধীন মামলার আসামীদের আদালতে হাজিরা শেষ করে জেল খানায় ফেরত নিতে পুরো দিন গড়িয়ে রাত হয়ে যায়। তখন জেলখানা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এরা দুপুর ও রাতের বেলা প্রায় অনাহারে থেকে। তাই অনেক সময় তারা কোর্ট পুলিশকে অবৈধভাবে ম্যানেজ করে তার আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে খাবার আদায় করে। কিন্তু বিষয়টির সাথে একদিকে যেমন হাজতিদের নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত থাকে, অন্য দিকে আত্মীয় স্বজনরা অবৈধভাবে পুলিশকে ম্যানেজ করার প্রচেষ্টায় পুলিশের বদনাম হয়।

থানার অফিসারদের মধ্যে পুলিশ হেফাজতে আসা ব্যক্তিদের খাবার দেওয়া সম্পর্কে একটি অলিখিত সমঝোতা নিয়ম চালু হয়েছে। সাধারণত রিমান্ডের আসামী হলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তাকেই তার খাবারের খরচ বহন করতে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে আসামীর আত্মীয়গণ থানার সমনে ভীড় করে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে কোন ব্যক্তির সাথে তার আত্মীয়-স্বজনগণ দেখা সাক্ষাত বা খাবার প্রদানের ফলে তদন্তকারী কর্মকর্তার তদন্ত সংক্রান্ত উদ্দেশ্য হাসিল হয় না। কিন্তু যাতে নিজের পকেট থেকে আসামীদের খাবারের খরচটি দিতে না হয়, সেই জন্য অনেক তদন্তকারী কর্মকর্তা এই নিয়মকে উপেক্ষা করে। অনেক সময় অবস্থাশালী আসামী হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারগণ, বিশেষ করে সেস্ট্রি কনস্টেবলগণ, এই সুযোগে আসামীর স্বজনদের কাছ থেকে নানা ছলনায় অবৈধভাবে কিছু অর্থও দাবী করে।

রিমান্ডের আসামীদের বাইরে অন্যান্য আসামীদের খাবার সরবরাহের দায়িত্ব পড়ে থানার ডিউটি অফিসারের উপর। যে অফিসার যত বেশিবার ডিউটি অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন, আসামীদের খাওয়ানোর জন্য তার পকেট থেকে ততো বেশি অর্থ খরচ হবে। অনেক ক্ষেত্রে আসামীদের খাওয়ানো বাবদ অর্থ গচ্ছার ভয়ে অনেক অফিসার ডিউটি অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে চান না।

বলা বাহুল্য, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনে পুলিশ হেফাজতে আসা ব্যক্তিদের খোরাকী পরিশোধের জন্য তেমন কোন নির্দেশনা নেই। কিন্তু পৃথিবীর সব দেশের পুলিশের জন্যই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। যেখানে গ্রেফতারের নির্দেশনা রয়েছে, সেখানে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের বিষয়টি নিশ্চিত করারও নির্দেশনা রয়েছে। আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় এই বিষয়টির নির্দেশনা যে নেই, তা বলা যাবে না। কিন্তু, এই নির্দেশনাটি আধুনিক সমাজের সাথে পুরোপুরি অঙ্গতিপূর্ণ।

পুলিশ সংস্কারে যে সব পদক্ষেপ অনুসৃত হয় সেগুলোর মধ্যে আসামীর মানবিক বিষয়টিরও সুরাহা করার কথা বলা হয়। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে সমপ্রতি দক্ষিণ ভারতের কেরালা অংগ রাজ্যের আইনসভা একটি আধুনিক পুলিশ আইন পাশ করেছেন। ২০১১ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার ৬১ তম বর্ষ পূর্তির দিন থেকে কার্যকর হয়েছে এই পুলিশ আইন।

কেরালা পুলিশ আইনের ৯ নং ধারায় পুলিশ কাস্টডিতে থাকা ব্যক্তিদের খাদ্যদান তথা দৈনিক খোরাকী বিষয়ে যুগোপযোগী নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ধারায় বলা হয়েছে, রাজ্য সরকার প্রতি মাসে পুলিশ বা থানা হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের সংখ্যা ও হেফাজতকাল বিবেচনা করে থানায় অর্থ অর্থ প্রদান করবে। আইনে এর একটি স্থায়ী হারও নির্ধারণ করা হয়েছে। একজন মনুষের দৈনন্দিন ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানীয় ও অন্যান্য প্রাথমিক চাহিদাসমূহ পুরণের জন্য একজন অদক্ষ শ্রমিকের দৈনিক মজুরির অর্ধেকের সমপরিমাণ হারে অর্থ থানার অফিসার-ইন-চার্জের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

বাংলাদেশ পুলিশ ১৮৬১ সালের ঔপনিবেশিক আইন অনুসারে চলে। এই আইনের যেখানে সাধারণ নাগরিকদের অধিকারগুলোকেই সঠিকভাবে স্বীকার করা হয় নাই, সেখানে আসামী বা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকার সম্পর্কে সঠিক নির্দেশনা থাকার কথা নয়। তবে একথাও সত্য যে বাংলাদেশ সরকার তাদের হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্কে কাগজে-কলমে সম্পূর্ণ উদাসিনও নয়।(যদিও বর্তমানে আইনী জটিলতায় স্থগিত রয়েছে)। কিন্তু একজন মানুষের দুই বেলা খাওয়ার জন্য যে হার নির্ধারিত রয়েছে তা বর্তমান বাজার দরের সাথে শুধু অসামঞ্জস্যপূর্ণই নয়; হাস্যকরও বটে।

ঢাকার ফুটপাতে ভ্রাম্যমাণ হোটেলগুলো থেকে, কৌতুহল বসত, আমি একজন রিকসা চালকের এক বেলা খাবারের খবচের হিসেব নিয়েছি। এখানে এক টুকরা পাঙ্গাস মাছের সাথে ডাল ও ভর্তাসহ একজন রিকসা চালকের পেট ভরাতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা খরচ হয়। একে দিগুণ করলে হবে ১০০ থেকে ১২০ টাকা। তাই পুলিশ কাস্টডিতে থাকা একজন আদম সন্তানের জন্য বর্তমানের বাজারে অন্তত দৈনিক ১০০ টাকার খোরাকী নির্ধারণ করা দরকার।

পরিমাণ বা হার যাই হোক না কেন, যে বরাদ্ধটুকু রয়েছে তাও তো সঠিক স্থানে ন্যাস্ত করা হয় না। এটা পুলিশের কাছে আসে না, আসে জেলা প্রশাসক তথা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। এমতাবস্থায়, পুলিশ সংস্কার প্রোগ্রামের আওয়তায় পুলিশ আইন সংশোধন করা হলে বা নতুন আইন পাশ করা হলে সেই আইনে আসামীদের খোরাকী অর্থ সম্পর্কে সু-ষ্পষ্ট নির্দেশনা থাকা দরকার। তাছাড়াও সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশ বলেও বিষয়টির সুরাহা করতে পারে।