বস্ত্রলাগি বস্ত্রহীনতাঃ একটি স্মরণীয় শীতরাতের গল্প

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 13 Dec 2012, 05:16 AM
Updated : 13 Dec 2012, 05:16 AM

মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে সবে মাত্র মাঠের পুলিশিং শুরু করেছি। পোস্টিং পেয়েছি রাজশাহী রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স(আরআর এফ) এ। প্রাত্যহিক পুলিশিং কর্ম এখানে নেই। তবে প্রায়শই অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনার্থে নানা স্থানে জেলা পুলিশের সাথে কাজ করতে হয়। এমনি একটি ভিভিআইপি নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেছিলাম বগুড়া জেলায়।

তখন ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি। শীত তেমন নাই বললেই চলে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার নিজ নির্বাচনী এলাকা সফর করবেন। সফরের একটি অংশ হল, তিনি শীতার্তদের মধ্যে গরম কাপড় বিতরণ করবেন।

প্রধানমন্ত্রীর সফর ছিল দুই দিনের। একটি রাত তিনি বগুড়া সার্কিট হাউজে কাটাবেন। আমার প্রথম দিন সকালে দায়িত্ব ছিল বগুড়া শহরের অদূরে একটি মহিলা আশ্রয় কেন্দ্র উদ্বোধন স'ানে। আর রাত্রের শেষ পালায় ডিউটি পড়ল সার্কিট হাউজের নিরপত্তা দায়িত্ব তদারকীতে।

শীতের প্রকোপ বেশি না থাকায় সাধারণ মানের গরম কাপড় সাথে নিয়েছিলাম। ইউনিফর্ম হিসেবে ছিল পাতলা পশমী সুয়েটার। সারদায় প্রশিক্ষণে শিখেছিলাম ইউনিফর্ম পরলে মাথায় মাফলার পরতে নেই। কারণ বাংলাদেশে যারা উর্দি-পরা চাকরি করেন তাদের কারও মাফলার ইউনিফর্মের অংশ নয়।

কিন' সেই দিন হটাৎ করে এত বেশি শীত পড়বে তা কে জানত? আমার পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করছিলেন একজন সিনিয়র এএসপি। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথেই তিনি একটি গ্রেটকোর্ট (এক প্রকার লম্বা খসখসে কোর্ট যা সাধারণত অধীনস্ত অফিসারদের নামে সরবরাহ করা হয়) গায়ে দিলেন। তিনি সিনিয়র তাই অভিজ্ঞতা প্রচুর। হেলমেট, লেগগার্ড ইত্যাদির মতো যে ক্লোথ-স্টোর থেকে একটি গ্রেট কোর্টও ইসু করা যায়, তা তিনি জানতেন, আমি জানতাম না। তাই একেবারে দুরবস্থা। প্রচণ্ড শীতে এক রকম থর থর করছি। কিন্তু কিছু করার নেই। প্রধান মন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্ব। আমরা যৎপরোনাস্তি সতর্ক।

হটাৎ করে সার্কিট হাউজের সামনে কিছু শীতবস্ত্র প্রত্যাশীর দেখা মিলল। তারা মনে করল প্রধানমন্ত্রী সার্কিট হাউজে প্রবেশের পূর্বে তাদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করবেন। রাত গভীর হয়, শীতার্ত নারী-পুরুষ ও তাদের বস্ত্রহীন বাচ্চা-কাচ্চার সংখ্যা বাড়তে থাকে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শীতবস্ত্র বিতরণের স্থান হিসেবে শহরের বহিঃএলাকা বেছে নিয়েছেন। কারণ, তার কাছে খবর ছিল মূল শহরের শীতার্তদের বিভিন্ন সংস্তা বহুবার শীতবস্ত্র দিয়েছেন। সেই তুলনায় শহরের বাইরের লোকদের ভাগ্যে তেমন কিছু পড়ে নাই। তাই তিনি শহরের কিছুটা বাইরে চলে গেছেন।

ভিভিআইপি নিরাপত্তা দায়িত্বের ক্ষেত্রে নিজ এলাকার বাইরের খবর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নেওয়া বিড়ম্বনা বৈকি। তবে এটা বোঝা গেল প্রধানমন্ত্রী শীতবস্ত্র বিতরণ শেষে শহরের বাইরে থেকে সোজা সার্কিট হাউজে প্রবেশ করবেন। আর ভিভিআইপি একবার বিশ্রামে গেলে আমাদেরও দায়িত্বের সিংহভাগ শেষ হয়।

কিন্তু বগুড়া সার্কিট হাউজের সামনে শীতার্ত নারী-পুরুষগণ এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রবেশ পথ করে দেওয়াই মুস্কিল। আমর পুলিশ দল শীতার্তদের সরাতে হিমমিস খাচ্ছে। প্রচণ্ড শীত। মানুষকে সরতে বললে সরে না। হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেও কাজ হয় না।

এর মাঝে কিছু কিছু রিকসাওয়ালা কয়েকটি করে কম্বল নিয়ে নিজের রিকসায় বউ বাচ্চাসহ সার্কিট হাউজের রাস্তা অতিক্রম করে। তারা শহরের কিছুটা বাইরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পা গ্রহণ করেছে। এই দেখে সার্কিট হাউজের সামনের নারী-পুরুষগণ উচ্চৈঃস্বরে হই দিয়ে ওঠে। শহরের বিভন্নি স্থান থেকে শীতের কাপড় সংগ্রহ করে কিছু কিছু মানুষ এসে আবার সার্কিট হাউজের সামনে বসে পড়ে। সার্কিট হাউজের সামনের রাস্তা এখন লোকে লোকারণ্য।

আমি শীতার্ত মানুষগুলোর দিকে চেয়ে থাকি। এত বেশি শীতে-আর্ত মানুষ আমি জীবনে কখনো দেখি নাই। শীতার্তরা শুধু সংখ্যায় নয়, মাত্রাতেও অনেক বেশি। শীতে আমার হাত-পা কাঁপার অবস্থা। কিন' এর মাঝেও দেখি কতিপয় দম্পতি তাদের দুধের বাচ্চাগুলোর শরীর একদম উলঙ্গ করে রেখেছে। এই অবুঝ শিশুদের শরীরের কোথাও কোন কাপড় নেই। এটা অনুমান করা কষ্টকর হলেও সত্য। আমার শরীর কাঁপছে। কিন্তু এই শীতার্ত গরীব মানুষগুলোর উলঙ্গ সন্তানরা যেন নির্বকার। দাতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গ্রহীতা কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পাওে তা সেদিন দেখেছিলাম, বুঝেছিলাম। শরীরে কাপড় না থাকলেই তো শরীর ঢাকার কাপড় মিলবে!

রাত শেষের দিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সার্কিট হাউজে প্রবেশ করলেন। শীতার্তদের ধারণা ছিল তিনি তাদের শীতের কাপড় দিয়েই বিশ্রামে যাবেন। কিন্তু তিনি তাদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করবেন, এমনটি তারা ভাবতে পারেন নাই। অনেকে হতাশ হলেন। কিন্তু কেউ কেউ আশায় রইলেন। কেউ কেউ বললেন, এমনটি মাঝে মধ্যেই হয়। প্রধানমন্ত্রী আবার বের হয়ে তাদের শীতবস্ত্র দিবেন। সন্ধারাত থেকে শেষ রাত পর্যন্ত প্রচণ্ড শীতে শীতার্ত শরীর প্রদর্শন বৃথা যেতেই পারে না!

রাত প্রায় শেষ। শীত-কাতর দুএকটি ভোরের পাখি ডাকাডাকিও শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু শীত বস্ত্র বিতরণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বের হন না। লোকজন অধৈর্য হয়ে ‌ওঠে। তারা এখন পুলিশের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। আসলেই প্রধানমন্ত্রী আর বের হবেন না।

বিক্ষুব্ধ জনতা সার্কিট হাউজের গেটের দিকে আসতে থাকে। অবস্থা বেগতিক। রিজার্ভ ফোর্স পাওয়ার উপায় নেই। উপায়ান্তর না পেয়ে অন্য এলাকা থেকে পাহারা পাতলা করে সার্কিট হাউজের প্রধান ফটকে পুলিশের সংখ্যা আরো বাড়ানো হল। কিন্তু তবু জনতা বাধ মানে না। পুলিশকে পায়ের নীচে ফেলে সার্কিট হাউজে প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু সাবধান আমরা। প্রধানমন্ত্রীর নিজ এলাকায় শীতার্ত মানুষদের উপর বল প্রয়োগ করা যাবে না। তাই পুলিশের উপর পুলিশ দিয়ে মানব ঢাল বানিয়ে কোন রকম শীতার্তদের আটকে রাখলাম।

এক সময় জনতা পুরোপুরি বিশ্বাস করল, প্রধানমন্ত্রী আর বের হবেন না। তারা আর কাপড় পাবেন না। তাই জনতা ক্রমশ পাতলা হতে লাগল। বস্ত্রবঞ্চিত কিছু কিছু মহিলা প্রধানমন্ত্রীকে যাচ্ছে তাই বলতে লাগল। কেউ কেউ আল্লা-খোদার নামে তাকে অভিশাপ দিতে লাগলেন। কেউ কেউ শহরতলীর মানুষদের প্রতি ঈর্ষার অনল বর্ষণ করতে থাকলেন।

আমি অবাক হয়ে দেখলাম, পূর্বে যে শিশুগুলো সম্পূর্ণ খালি গায়ে ছিল, তাদের সবার গায়ে কম-বেশি পোষাক। কেউ খালি গায়ে নেই। কিছু কিছু রিকসাচালক দম্পতি রিকসার সীটের নীচ থেকে পোষাক বের করে নিজেরা গায়ে দিচ্ছেন ও বাচ্চাদের গায়ে পরিয়ে দিচ্ছেন।

আশ্চর্য আমাদের দারিদ্র্য-প্রদর্শন! শীতের পোষাক হিসেবে মাত্র একটি কম্বল পাওয়ার আশায় প্রচণ্ড এই শীতের রাতে এই মানুষগুলো শীতের কাপড় শরীর থেকে খুলে গোপন স্থানে রেখেছিল। নিশ্চিত নিউমোনিয়া হওয়া ঝুঁকি নিয়েও তারা অবুঝ শিশুদেও হিম-শীতল শীতের কোলে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছিল।

রাত শেয় হল। আমার দায়িত্বে পালা শেষ। বিনিদ্র একটি স্মরণীয় শীতের রাত্রের অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। এই অভিজ্ঞতা জীবনের সবেচেয়ে বেশি শীতের রাতের। এই অভিজ্ঞতা শীতার্ত মানুষদের স্বেচ্ছায় চরম শীতার্ত বানাবার প্রচেষ্টা দেখার অভিজ্ঞতা। তবে এই অভিজ্ঞাই শেষ নয়, এই দেশে সমাজের উঁচু তলার মানুষগুলোকেও সামান্য বস্তুগত লাভ নিশ্চিত করতে বাস্তবে না হলেও কাগজে-কলমে সম্পূর্ণ নিঃস্ব হওয়ার প্রাণান্ত প্রচেষ্টাকে বাস্তব বলে মেনে নিয়েছি।