কমিউনিটি পুলিশিং এর তাত্ত্বিক ভিত্তিঃ সমস্যার সমাধানমূলক পুলিশিং

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 31 March 2014, 09:03 AM
Updated : 31 March 2014, 09:03 AM

কমিউনিটি পুলিশিং একাধারে একটি দর্শন ও একটি কর্মকৌশল। দর্শনের ক্ষেত্রে এই পুলিশিং প্রচলিত পুলিশিং কৌশলগুলোর অসারতা ও স্ববিরোধিতা তুলে ধরে এর কার্যকরিতা সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মারে। কিন্তু অপর দিকে একটি সাংগঠনিক কর্মকৌশল হিসেবে এই দর্শন বা পুলিশিং এর একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকরা জরুরী হয়ে পড়ে। কমিউনিটি পুলিশিং এর কৌশল/দর্শন যে সব তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় তাদের মধ্যে সমস্যার সমাধানমূলক পুলিশিং, ভাঙ্গা জানালা তত্ত্ব, সামষ্টিক অর্জন তত্ত্ব, আটপৌরে আচরণ তত্ত্ব, যৌক্তিক নির্বাচন তত্ত্ব, নৈতিকতার নীতিমালা তত্ত্ব, সামাজিক সম্পদ তত্ত্ব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আমার এই নিবন্ধে আমি অতি সংক্ষেপে কমিউনিটি পুলিশিং এর তাত্ত্বিক ভিত্তিগুলো ব্যাখ্যা করব। বলা বহুল্য, বাংলায় পুলিশিং পরিভাষার দারুণ অভাব হেতু আমি কিছু কিছু পরিভাষার প্রস্তাবসহ আলোচ্য তত্ত্বগুলোর জন্য বাংলা পরিভাষা প্রদানপূর্বক আলোচনা করব। এতে হয়তো পাঠককুল কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়বেন। তবে বাংলা পরিভাষার পাশে আমি যতদূর পারি মূল ইংরেজিও রেখে দিব।

সমস্যার সমাধানমূলক পুলিশিং (Problem Oriented Policing)
আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২০ এর দশক থেকে পুলিশিং জগতে পেশাদারিত্ব-আন্দোলনের সূচনা হয় এবং ৬০ এর দশকে তা চরম উৎকর্ষে পৌঁছে। তৎকালীন বার্কলি পুলিশ প্রধান অগাস্ট ভলমারসহ বেশ কিছু পুলিশ অফিসার এই আন্দোলনের সাথে ওৎপ্রতভাবে জড়িত ছিলেন। পেশাদারিত্বমূলক পুলিশিং এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পুলিশ বিভাগগুলোকে রাজনীতিবিদদের সীমাহীন দুর্নীতির কবল থেকে বের করে এনে তাদের আইন বিধি ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানরূপে প্রতিষ্ঠিত করা। পেশাদারিত্বমূলক পুলিশিং এ একলা চলার নীতি সুস্পষ্ট ছিল। পুলিশ সংগঠনকে সামরিকীকরণসহ পুশি সদস্যদের সাধারণ মানুষ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে রাখার একটি প্রবণতা সেই সময় বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পুলিশি অভিযান, তদন্ত, গ্রেফতার, উদ্ধার সবকিছুতেই যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু এর ফলে পুলিশিং এর কিছুটা উন্নতি ঘটলেও পুলিশ সংগঠনটি অতিমাত্রায় আমলাতান্ত্রিক, কেন্দ্র নির্ভর ও জন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একই সাথে জনগণের সাথে দূরত্ব বাড়ার ফলে পুলিশ জনগণের সমর্থন ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। জনগণের কাছে পুলিশের প্রাত্যহিক কর্মের অনুমোদন না থাকায় পুলিশ সংগঠন অভ্যন্তরীণ কর্মসন্তুষ্টিসহ কার্যকরিতা হারিয়ে ফেলে।
১৯৬০ এর দশকে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের আন্দোলন, ভিয়েতনাম বিরোধী আন্দোলন, সিভিল ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্দোলন ইত্যাদি দমনের ক্ষেত্রে পুলিশ অসহায় হয়ে পড়ে। পুলিশ অতিমাত্রায় কঠোর কৌশল অবলম্বন করে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। দাঙ্গার কারণ, বিস্তৃতি ও প্রতিকার অনুসন্ধানের জন্য গঠিত একাধিক 'দাঙ্গা কমিশন' জনগণকে নয়; বরং পুলিশকেই দাঙ্গার কারণ ও বিস্তৃতির জন্য দোষারোপ করে ।

এমনি এক সমস্যা সংকুল সময়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মেডিশন রাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হারম্যান গোল্ডস্টাইন পুলিশের জন্য একটি সম্পূর্ন নতুন দর্শন উপস্থাপন করেন। ক্রাইম এন্ড ডেলিনফুয়েন্সি জার্নালে ১৯৭৯ সালে তিনি সমস্যার সমাধানমূলক পুলিশিং বা Problem Oriented Policing এর ধারণা তুলে ধরেন। সনাতনী পুলিশিং ব্যবস্থায় অপরাধকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করে পুলিশ ঘটনাতাড়িত হয়ে সেগুলোর প্রতি বিচ্ছিন্নভাবে সাড়াদান করে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ও একক ঘটনার প্রতি পুলিশের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এবং পুলিশ একটি মাত্র ঘটনার পিছনে সহায় সম্পদ নিয়োজিত করে। এতে একটি ঘটনার সাময়িক সুরাহা হয় বা ঘটনাটি সাময়িকভাবে বিদুরিত হলেও চূড়ান্তভাবে সমস্যাটির সমাধান হয় না। প্রচলিত পুলিশিং-এ পুলিশ কর্মকর্তারা উপায়কে লক্ষ্যের উপরে স্থান দেন। কিন্তু পুলিশিং এর চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে তারা হয় উদাসীন নয়তো লক্ষ্য অর্জন করার মতো তাদের উপর কোন অনুপ্রেরণা বা সাংগঠনিক তাগিদ থাকে না।

১৯৭৯ সালে হারম্যান গোল্ডস্টাইনের সমস্যার সমাধানমূলক পুলিশিং তত্ত্বে প্রচলিত পুলিশিং ব্যবস্থায় পুলিশিং এর মৌলিক ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। গোল্ডস্টাইন বলেন, শুধু ঘটনার পিছনে অর্থ-সম্পদ বিনিয়োগ করে পুলিশকে কাঙ্খিতমাত্রায় কার্যকর করা যাবে না। পুলিশ সংগঠনকে তাদের মানসিকতা থেকে শুরু করে কর্তব্য পালনের পদ্ধতি পর্যন্ত সব স্থানেই পরিবর্তন ঘটাতে হবে । তাদের সমজাতীয় সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোকে বিশেস্নষণ করে এই সব সমস্যার পিছনের কারণগুলো দূর করতে হবে। পূর্বে পুলিশ যেখানে কোন ঘটনা ঘটার পরে তার প্রতি সাড়াদান করত। এখন পুলিশ ঘটনা ঘটার পূর্বেই ঘটনার কারণ অনুসন্ধানপূর্বক তা নিবারণে তৎপর হবে। এক্ষেত্রে ইতোপূর্বে সংঘটিত ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ পূর্বক এগুলোর কারণ দুর করার জন্য উপযুক্ত সাড়া নির্ধারণ করবে। ঘটনা বা অপরাধের পশ্চাতের কারণ অনুসন্ধান করা একটি ব্যাপক কাজ। তাই সমস্যার সমাধানমূলক পুলিশিং পুলিশের কর্মপরিধিও বিস্তৃত করবে।

তাই সমস্যার সমাধানমূলক পুলিশিং অপরাধমূলক পরিস্থিতি তৈরিতে অবদান রাখে বা সহায়ক যে কোন ঘটনাই বিশ্লেষণ করে। আরো বাড়তি কাজ হিসেবে শুধু অপরাধ বা বিশৃঙ্খলাই নয়, অপরাধ ভীতিও পুলিশের বিবেচনার মধ্যে আসবে। অর্থাৎ পুলিশ অপরাধ ও তৎসংশ্লিষ্ট যাবতীয় মনুষ্য আচরণের উপরই কাজ করবে। পেশাদার পুলিশিং শুধু ফৌজদারি আইনের প্রয়োগ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। কিন্তু অপরাধ সমস্যা সমাধানের জন্য ফৌজদারি আইনের বাইরেও অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বহু প্রকারের আইন বাস্তবায়নের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু এই সব আইনের সবগুলো বাস্তবায়ন পুলিশ করে না। তাই সমস্যার সমাধান করতে গেলে পুলিশকে অন্যান্য সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে একত্রে কাজ করতে হবে। শুধু কমিউনিটির সদস্যদের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করেই পুলিশ সমস্যার সমাধান করতে পারে। হারম্যান গোল্ডস্টাইনের সমস্যার সমাধানমূলক পুলিশিং ধারণাকে কৌশলগত পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ১৯৮৭ সালে জন.ই এ্যাক ও উইলিয়ামস স্পেলম্যান সমস্যা সমাধানের জন্য একটি মডেল উপস্থাপন করেন। চারটি পর্যায়ে বিবেচ্য এই মডেলকে SARA মডেল বলে অভিহিত করা হয়। এখানে S- Scanning, A-Analysis, R- Response , A-Assessment|

২০১০ সালে প্রকাশিত আমার 'কমিউনিটি পুলিশিং " দর্শন-নীতি ও বাস্তবায়ন " বইতে আমি এই মডেলের একটি বাংলা পরিভাষায় দিয়ে একে 'চিবিসামূল' বলে অভিহিত করেছি যেখানে চি- চিহ্নিতকরণ; এই পর্যায়ে কোন সমস্যাকে সমাধানের জন্য চিহ্নিত করা হয়। সমজাতীয় সমস্যাগুলো আলাদা করে এক বা একাধিক সম্পর্কে সমাধানের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। বি-বিশ্লেষণ; বিশ্লেষণ পর্যায়ে সমস্যার কারণগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করা হয়। কারণগুলোর সাথে কি কি বিষয় জড়িত রয়েছে এবং সেগুলো সমাধান সম্ভব কিনা এবং সম্ভব হলে কি জাতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব তা নিয়ে বিশ্লেষণ চলে। সা- সাড়াদান; সমস্যা চিহ্নিত করে তাকে বিশ্লেষণ পূর্বক এর জন্য একটি করণীয় নির্ধারণ করতে হয়। এই করণীয় বিষয়টি মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করাই হল সাড়া দান। মূল- মূল্যায়ন; কোন সমস্যা সমাধানের জন্য নির্দিষ্ট কৌশল বা সাড়াটি আসলে কাজ দিল কি না এবং কাজ দিলে তা কতটুকু কাজ দিয়েছে। কাজ না দিলে কেন কাজ দেয়নি। ভবিষ্যতে একই ধরনের সাড়া বা কৌশল অবলম্বন করা হবে কিনা ইত্যাদি বিষয় পর্যালোচনার জন্য মূল্যায়ন প্রয়োজন।

সমস্যার সমাধান মূলক পুলিশিং তত্ত্ব কমিউনিটি পুলিশিং এর অন্যতম মূল তত্ত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেউ কেউ বলেন সমস্যার সমাধান মূলক পুলিশিং তত্ত্বের প্রয়োগ ভিন্ন স্বাধীনভাবে কমিউনিটি পুলিশিং বাস্তবায়ন সম্ভব। কিন্তু যেখানে কমিউনিটি পুলিশিং সেখানেই সমস্যা সমাধানের প্রশ্ন আসে। আর সমস্যার সমাধানমূলক দৃষ্টি ভঙ্গি গ্রহণ করতে হলে আমাদের Problem Oriented Policing তত্ত্বের কাছেই ফিরে আসতে হবে। সমস্যার সমাধানমূলক পুলিশিং তাই বলা চলে, কমিউনিটি পুলিশিং এর অবিচ্ছেদ্য উপাঙ্গ। সমস্যার সমাধান ছাড়া কমিউনিটি পুলিশিং অকল্পনীয়। অর্থাৎ হারম্যান গোল্ডস্টেইনের সমস্যার সমাধানমূলক পুলিশিং তত্ত্ব কমিউনিটি পুলিশিং এর অন্যতম ও প্রধানতম তাত্ত্বিক ভিত্তি।

রচনাসূত্রঃ

1. Herman Goldstein; Problem-Oriented Policing; McGraw-Hill, Inc
2. Victor E. Kappeler(2006); The Police and Society;Waveland Press,Inc