মাত্র ৫৭ বছর বয়সে ছেড়ে গেলেন পৃথিবীকে তিনি। তার সাথে দেখা হয়নি কোন দিন আমার। তিনি আমাকেও চিনতেন না। কিন্তু আমি তাকে চিনতাম। শুধু আমিই না, তাকে চিনতেন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। হ্যাঁ, তিনি প্রায়াত সংসদ সদস্য ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব শওকত হোসেন হিরন। কিন্তু কেন আমি তাকে চিনতাম? তিনি একটি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন বলে, কিংবা নির্বাচিত হয়েছিলেন সংসদ সদস্য হিসেবে বলে? না, আমি তাকে চিনতাম যে শহরের মেয়র তিনি ছিলেন, সেই বরিশাল শহরটিকে একদিন সকাল বেলা দেখে।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি পিআরপি এর একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য নৌপথে বরিশাল যাই। লঞ্চের কেবিনে ঘুমিয়ে ছিলাম শেষ রাতে। কখন যে বরিশাল এসেছে টেরই পাইনি। যখন একজন কেবিন বয় গিয়ে দজায় ঠোক ঠোক করল, তখন বুঝলাম বরিশাল এসে গেছি। সম্ভবত আমি ছাড়া অন্যরা সবাই ততোক্ষণে তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে লঞ্চ ত্যাগ করেছে।
একটি রিকসা নিয়ে লঞ্চ ঘাট থেকে রওয়ানা দিলাম মূল শহরের দিকে। আমার উদ্দেশ্য হল পুলিশ অফিসার্স মেসটি খুঁজে বের করা। কিন্তু রিকসাওয়ালা ওটা চিনেন না। আর লঞ্চ ঘাট থেকে আমি এই প্রথম শহরে ঢুকছি। রিকসাওয়ালা আমাকে নিয়ে ঘুরিয়ে বেড়াল অনেক রাসত্মা; ছোটখাট অলিগলি। আমি লক্ষ্য করলাম এত ভোরেও রাস্তায় ঝাড়ুদার নেই। অথচ রাস্তাগুলো ঝকঝক করছে। সূর্য ওঠার আগেই ঝাড়ু দেয়া হয়েছে সব রাস্তা। একটি পরিচ্ছন্ন শহরে রিকসা করে ঘুরে বেড়াতে আমার ভালই লাগল।
রিকসা ওয়ালার কাছ থেকে জানতে চাইলাম, এত পরিষ্কার হল কি করে এই শহর? রিকসাওয়ালা জানালেন, মেয়রের পরিচ্ছন্নতা অভিযানের কথা। শহরের রাস্তাঘাট থেকে শুরম্ন করে সব স্থানেই মেয়রের উন্নয়নের ছোঁয়া। শহরের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতি সৌধ, নির্মাণ করা হয়েছে স্থানীয় ইতিহাস আর সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যসূচক কিছু শিল্পকর্মও।
এর পরেও ২০১৩ সালের প্রথম দিকেও গিয়েছিলাম বরিশালে। তখনও রাস্তাগুলোর উন্নয়ন আর পরিচ্ছন্নতা দেখেছি। এক সন্ধ্যায় ভ্রমণ করেছি ভিতরের রাস্তাগুলো দিয়ে। এক সকালে ভ্রমণ করেছি ডিসি-এসপিসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের সরকারি ভবনগুলো হয়ে আনসার অফিসের সামনে মনোরম পার্কটিতে। প্রতিবারই আমি মানুষের কাছ থেকে মেয়র শওকত হোসেন হিরনের প্রশংসা শুনেছি।
আমার কয়েকজন স্থানীয় বন্ধু বরিশালেই থাকেন। তাদের কাছে হিরন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। তারা হিরনের দলনিরপেক্ষতার কথা বলেছিলেন। তারা বলেছিলেন, বরিশালের উন্নয়নে আহব্বান করা টেন্ডারগুলো পেত যোগ্য ঠিকাদারগণ। এখানে তথাকথিত 'নেগো' করার সুযোগ তিনি দিতেন না। তাই যা করতে চেয়েছেন, তিনি তা পেরেছিলেন। এই কাজটি ছিল প্রচলিত ধারার রাজনীতি থেকে অনেকাংশেই পৃথক। সাধারণত To the Victors go the Spoils' দলের বখাটে পোলাপানগণ বিজয়ীদের কাছে ভীড় জমায়।বিজয়ীরাও তাদের বৈধ-অবৈধ বখরা দিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করার পিছনে বখাটেদের অবদানের প্রতিদান দেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর ৩০ এর দশক পর্যন্ত এটাই ছিল আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্রের রাজনীতি ও স্থানীয় প্রশাসনের মূল কথা। এটাই ছিল বহুল আলোচিত 'স্পইলস সিস্টেমের' সার বস্তু।
আমাদের সমাজ এমনই একটি 'স্পইলস সিস্টেম' বা ভ্রষ্টনীতির যুগ অতিক্রম করছে বলে অনেকেই মনে করেন। এই সিস্টেমে টেন্ডারকর্মে নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে উন্নয়নকর্ম শুরুর আগেই তার লাভ্যাংশ ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যায়। যিনি প্রকৃত কাজটি করবেন, তিনি কাজ শুরুর আগেই অন্যদের বখরা দিয়ে দেন। এতে কাজের মান শুধু নিম্নই হয় না, অগ্রহণযোগ্যও হয়। কিন্তু রাজনৈতিক শক্তির কাছে সব কিছুই জায়েজ হয়ে যায়। এখানে
'আরম্ভ হয়না কিছুই সমস্তের তবু শেষ হয়
কীট যে ব্যর্থতা জানে পৃথিবীর ধূলো-মাটি-ঘাসে
তারও চেয়ে ব্যর্থতার সাথে রোজ হয় পরিচয়'।
কিন্তু প্রয়ায় মেয়র হিরন বরিশালের উন্নয়ন আরম্ভ করতে পেরেছিলেন, শেষ করতে পেরেছিলেন ও সাফল্য পেয়েছিলেন।
আমি যতটুকু শুনেছি মরহুম শওকত হোসেন হিরন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন কাজের দরপত্রে ভ্রষ্টনীতিকে প্রশ্রয় দিতেন না। এর ফলে যোগ্য প্রতিষ্ঠান কাজ পেত। ঠিকাদারদের ব্যয় কম করতে হতো বলে কাজের মান ঠিক রেখেও তারা আশানুরূপ লাভ পেত। বলাবাহুল্য, জনাব হিরনের এই পক্ষপাতহীনতায় তার নিজ দলের অনেক নেতাসমর্থকও ক্ষিপ্ত ছিল । আর যার প্রভাব পড়েছিল পরবর্তী মেয়র নির্বাচনে। আকাশচুম্বি ভাল কাজ করার পরেও তিনি দ্বিতীয়বারের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থক প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।কিন্তু ভোটের হিসেবে পরাজিত হলেও জনাব হিরন মানুষের কাছে পরাজিত হননি। বরিশালের মানুষের কাছে তো বটেই, যারা তার সময়কালে বরিশাল ভ্রমণ করেছেন, যাদের মধ্যে স্বাভাবিক সৌন্দর্যবোধ ও নিরপেক্ষ্ মানসিকতা রয়েছে, তাদের মাঝে জনাব হিরন স্থায়ীভাবে বেঁচে থাকবেন।(১১/০৪/২০১৪)