দারোগা সা’দত আলি আখন্দের ইন্সপেক্টর গিন্নি ও পুলিশ-কর্তাদের উৎকোচ অপারেন্ডি

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 16 April 2014, 01:45 PM
Updated : 16 April 2014, 01:45 PM

জনাব সা'দত আলি আখন্দ বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে পুলিশের দারোগা ছিলেন। দারোগা মানে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর। যদিও দারোগা পদটি বৃটিশ আমলের গোড়ার দিকের এবং বিধিবদ্ধ পুলিশ সৃষ্টি হওয়ার পরে বৃটিশ পুলিশতো বটেই, বাংলাদেশ পুলিশের কোন আইন, বিধি বা আদেশ বইতে দারোগা বলতে কোন শব্দের স্থান হয়নি, তবুও ঐতিহ্যগতভাবে আমরা এখনো দারোগা শব্দটি কথ্য ভাষা থেকে বিদায় করতে পারিনি। সম্প্রতি আমি সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে জাহাজে করে টেকনাফ ফিরছিলাম। এক ভদ্রলোকের সাথে জাহাজে পরিচয় হল। আমি তার পেশা জানতে চাইলাম। তিনি গর্বভরে উত্তর দিলেন, 'আমি টঙ্গি থানার দারোগা'। অর্থাৎ পুলিশ-অপুলিশ নির্বিশেষে এখনো দারোগা শব্দটি দেদারচে ব্যবহার করেন।

জনাব সা'দত আলি আখন্দ পেশায় একজন পুলিশ অফিসার হলেও তার স্থায়ী পরিচিত একজন সুলেখক হিসেবে। তার রচনা সমগ্র ২০০৯ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই রচনা সমগ্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, সুখপাঠ্য, পুলিশ জীবনের ইতিহাস মূলক বই হল, 'যখন দারোগা ছিলাম'।

'যখন দারোগা ছিলাম' বইয়ের বিভিন্ন স্থানে লেখক পুলিশের দুর্নীতির কথা তুলে ধরেছেন। কিছু কিছু ঘটনা বিচ্ছিন্ন হলেও অধিকাংশই বিধিবদ্ধ, মানে সিস্টেমিক। তিনি যা দেখেছেন, যা করেছেন এবং যা তাকে করতে হয়েছে ইত্যাকার ঘটনার মাধ্যমে তিনি পুলিশের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেছেন। তার চাকরি শুরু ঔপনিবেশিক বাংলায় এবং চাকরি জীবনের সমাপ্তি পাক-বাংলায়। তাই তার বইয়ের দুর্নীতির ঘটনাসমূহ বর্তমানের নয়, অতীতের। তিনি তার বইতে পুলিশের জুনিয়র, সিনিয়র, মিনিস্ট্রিয়াল, দেশি-বিদেশী সব ধরনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দুর্নীতির কথা তুলে ধরেছেন।

এই নিবন্ধে আমরা এমন এক ঘটনার কথা জানব যেখানে সিনিয়র অফিসার ও তাদের পরিবারবর্গ কিভাবে সেকালে থানার দারোগাদের কাছ থেকে উৎকোচ-উপঢৌকন নিতেন এবং প্রত্যাশিত উপঢৌকন না পেলে তারা কেমন আচরণ করতেন। সার্কেল ইন্সপেক্টর ও তার স্ত্রীর উৎকোচ বাণিজ্যের একটি উজ্জ্বল ও নির্মোহ চিত্র এঁকেছেন তার 'যখন দারোগা ছিলাম' বইতে এই দারোগা সাহেব।

সে সময় থানার অফিসার-ইন-চার্জের দায়িত্ব পালন করতেন দারোগারা। একটি থানায় একাধিক দারোগা থাকলে সবচেয়ে সিনিয়র দারোগাই হতেন থানার ওসি। তাকে বলা হতো 'বড় দারোগা' । তারপরই থাকতেন ছোট দারোগা বা ছোট বাবু। পিআরবিতে এখনো দ্বিতীয় অফিসার বলে একটি পদের কথা আছে। অন্যদিকে দারোগা থেকে পদোন্নতি পেয়ে হতেন ইন্সপেক্টর। ইন্সপেক্টর থাকতেন সার্কেলের দায়িত্বে। কয়েকটি থানা একটি সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত।সার্কেল ইন্সপেক্টর বা সিআই তার অধীক্ষেত্রের অপরাধ ব্যবস্থাপনা ও তদন্ত তদারকের দায়িদত্ব পালন করতেন। যদিও এই পদটি বর্তমানে আপগ্রেড করে এএসপি পদমর্যাদার করা হয়েছে, তবুও অনেক বয়স্ক মানুষকে আমি সার্কেল এএসপিকে 'সিআই' বলতে শুনেছি। অনেকে আবার ইন্সপেক্টর পদ মর্যাদা করায় ওসিকেও 'সিআই' বলতে পছন্দ করেন।

যাহোক, থানার অফিসার-ইন-চার্জ বা ওসিগণ ঐতিহ্যগতভাবেই সার্কেল ইন্সপেক্টরকে আর্থিক উৎকোচসহ নানা প্রকারের উপঢৌকন দিতেন। এটা ব্রিটশ-বাংলা ও পাকবাংলা পুলিশের সাংগাঠনিক সংস্কৃতির অবিচ্ছদ্য অংশ ছিল। এই উপঢৌকন বা উৎকোচ প্রদানের ও গ্রহণের মধ্যে নানাবিধ সমীকরণও ক্রীয়াশীল ছিল। সার্কেল অফিসার তার অধীক্ষেত্রের সকল মামলার তদন্তের তদারক করেন। আর তার অধীনস্থগণ মানুষের কাছ থেকে ঘুষ সংগ্রহ করতেন। তাই তার একটি অংশতো ঊর্ধ্বতনকে দিতেই হত।আমার অধীনে থেকে মাল কামাবেন, আর আমি তার ভাগ পাবনা,তা কি করে হয়?

সা'দত আলি আখন্দ সে সময় আসামের ফালাকাটা থানার ওসির দায়িত্ব পেয়ে প্রথম দিন তার সার্কেল ইন্সপেক্টরের অফিসে দেখা করতে গিয়ে যে বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন তার বিস্তারিত বিবরণ তিনি দিয়েছেন তার 'যখন দারোগা ছিলাম' বইতে। থানা থেকে প্রায় ২৬ মাইল দূরে সার্কেল ইন্সপেক্টরের অফিস। এই ২৬ মাইল মহিসের গাড়িতে করে প্রথম সাক্ষাৎ করতে গেলেন দারোগা আখন্দ সাহেব। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ক্লান্ত। তার মহিসের গাড়ি ইন্সপেক্টর বাবুর অফিস ও তার বাসার মাঝখানে থামালেন।

গাড়ী থামতেই ইন্সপেক্টর বাবুর স্ত্রী তার ভৃত্যকে নির্দেশ দিলেনঃ
ঃ দেখতো রে কান্ত, কোন থানার গাড়ি আসল,
ঃ ফালাকাটা থানার বড় বাবুর গাড়ি মা-ঠাকুরুন, কান্ত বলল।
ঃ জিনিসপত্রগুলো তাড়াতাড়ি নামিয়ে নিয়ে আয়না রে, হাদারাম। গিন্নী নির্দেশ দিলেন।

যদিও দারোগা সাহেবের মাথায় আসছিল না যে কি জিনিসপত্র গাড়ি থেকে নামাতে বলছেন ইন্সপেক্টর গিন্নি। কেননা, তার গাড়িতে নিজের ব্যবহৃত কাপড়চোপড় আর বোচকা-পেটরা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তবে কি তার নিজস্ব জিনিসপত্র ইন্সপেক্টর গিন্নি নিয়ে নিবেন?

অবশ্য দারোগা পরে বুঝেছেন, সার্কেল ইন্সপেক্টরের অফিসে এলে দারোগারা সাধারণত গাড়ি ভর্তি করে উপঢৌকন নিয়ে আসতেন। আর এই উপঢৌকন গ্রহণ করতে করতে তাদের অন্তরে এমন একটা ভাবের উদয় হতো যে তারা ধরেই নিতেন, এটা হল তাদের প্রাপ্য। থানার অফিসারগণ যাই করুক, তারা ঊর্ধ্বতনদের লালন পালন করবেন। কিন্তু বড় ভুল করেছিলেন দারোগা সা'দত আলি আখন্দ। তিনি কিছুই নিয়ে আসেননি- না নগদ টাকা, না ইন্সপেক্টর গিন্নির জন্য উপঢৌকন।

যখন তার গাড়িতে কোন উপঢৌকনই পেলেন না ইন্সপেক্টর পত্নী, তখন তার ঝাল ঝাড়লেন ইন্সপেক্টর স্বামীর উপর। আর একই সাথে বুঝিয়ে দিলেন দারোগাকে যে, তিনি কত বড় ভুল করেছিলেন।

ঃ ওগো, কেমন লোককে ওসি করে ফালাকাটায় বসালে তুমি? বেশি দিন রাখলে শুধু থানাই ডুবিয়ে দিবে না, তোমায় আমায়ও ডুবিয়ে দিবে। কাজী সাহেব, অনীল বাবুরা, কেউতো কোন দিন খালি হাতে আসেনি দেখা করতে (পৃষ্ঠা-৬৫)।

অর্থাৎ কোন ওসিই কোন দিন খালি হাতে ইন্সপেক্টরের সাথে দেখা করতে আসত না। তারা সাথে যেমন নিয়ে আসতেন নগদ টাকা, তেমনি নিয়ে আসতেন বস্তুগত উপঢৌকনও। তাই ফালাকাটা থানার ওসির গাড়িতে ইন্সপেক্টর গিন্নীর জন্য কোন বস্তুগত উপঢৌকন না থাকায় তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

থানার ওসিকে জব্দ করার মতো অনেক কিছুই সার্কেল ইন্সপেক্টরের হাতে আছে। তিনি ইচ্ছা করলে তার অধীনস্থ দারোগাদের জীবনকে পার্থিব নরকে পরিণত করে দিতে পারেন। তাই, সেকালের দারোগাগণ সার্কেল ইন্সপেক্টর ও তার পত্নীদের মন যুগিয়ে চলতেন। তাদের নগদ অর্থ থেকে শুরু করে ফলমূল শাড়ি-গয়না দিয়ে তুষ্ট করতেন। আর যারা এটা করতে পারতেন না, তারা সা'দত আলি আখন্দের মতো গালাগালি শুনতেন। তারা খুব বেশি দিন নয়, সামান্য সময়ের জন্য থানার ওসিগিরি করতে পারতেন। কারণ সার্কেল ইন্সপেক্টরকে বখরা দিবেন না, তার স্ত্রীর জন্য উপঢৌকন আনবেন না, আর থানার অসিগির করবেন, এটা তো পুলিশ সংস্কৃতির সাথ যায় না।

বর্তমানে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ হয়েছেন ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার। ২০১০/১১ সালের দিকে প্রত্যেক থানার দুইজন করে ইন্সপেক্টরের পদ তৈরি করা হয়েছে। একজন ইন্সপেক্টর তদন্তের কাজের জন্য, অন্যজন সার্বিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত।

অন্যদিকে সার্কেল ইন্সপেক্টরের পদটি ১৯৮৫ সালের দিকে সহকারী পুলিশ সুপারের পদমর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। এখন ইন্সপেক্টরের পরিবর্তে এখানে বসেন একজন এএসপি। প্রথম দিকে বিভাগীয় পদোন্নতিপ্রাপ্ত অফিসারগণই এসব পদ দখল করতেন। কিন্তু বর্তমানে বিসিএস ক্যাডারভুক্ত অফিসারগণ এসব পদে দায়িত্ব পালন করছেন। আমাদের সা'দত আলি আখন্দের ওসি/দারোগা আর তার সার্কেল ইন্সপেক্টরের পদোন্নতি হলেও ঘুষ আদান-প্রদান ও এর সাথে সংশ্লিষ্টদের আচরণ কতটুকু পরিবর্তিত হয়েছে তা মূল্যায়নের দাবী রাখে।