হতাশা-উগ্রতা তত্ত্ব ও একজন আদর্শ পুলিশ অফিসারের কাঙ্খিত আচরণ

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 2 Oct 2014, 08:50 AM
Updated : 2 Oct 2014, 08:50 AM

গত ৪ আগস্ট, ২০১৩ মিঠাপুকুর থেকে একজন ভদ্রলোক আমার জনৈক আত্মীয়ের আত্মীয় দিয়ে ফোন করেছিলেন। তাকে আমি কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তবে আত্মীয়তার সূত্র ধরে হোক আর গ্রামবাসীর সূত্র ধরেই হোক, প্রতি দিনই অগণিত মানুষ আমার কাছে পুলিশি বিষয় নিয়ে ফোন করেন, সাহায্য সহযোগিতা চান। আমি আমার যথাসাথ্য তাদের সহযোগিতা করি। হ্যাঁ, বিরক্ত হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে এটাকে আমি আমার পবিত্র দায়িত্ব বলেও মনে করি।

ভদ্রলোকের ভাষ্য মতে, তার বোনকে স্বামী পক্ষের লোকজন হত্যা করেছে। পরে অবশ্য জানতে পারলাম তার বোন আত্মহত্যা করেছে। তবে তাদের অভিযোগ হল, ভিকটিমকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। স্বামী পক্ষের লোকজন তাদের খবর না দিয়েই আগে থানায় খবর দেয়। ভিকটিমের পক্ষের লোকজন যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছায়, ততোক্ষণে পুলিশ এসে লাশের সুরুতহালের কাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। এতে তাদের সন্দেহ আরো বেশি ঘনিভূত হয়েছে। লাশের আত্মীয়-স্বজনদের অন্ধকারে রেখে পুলিশকে ফোন করা কেন?

সুরুতহাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত অফিসারের সাথে কথা বললাম। তিনি লাশকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাননি। সেহেরির পর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঘরের বিমের সাথে ভিকটিম ফাঁস দিয়েছিল। টের পাওয়ার পরই স্বামীবাড়ির লোকজন ভিকটিমের লাশটি ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামায়। ফাঁসির ঘটনার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবশ্য এমটি হয়ে থাকে। ফাঁসির ঘটনা যখন উদ্ঘাটিত হয়, তখনো মানুষ মনে করে হয়তো ভিকটিম বেঁচে যেতে পারে। অধিকন্তু একটি রক্তমাংসের মানুষকে ঝুলন্ত অবস্থায় রাখাটা অনেকে নির্মমতাও মনে করে। তাই পুলিশ গিয়ে ভিকটিমকে বা তার লাশকে সঠিক অবস্থানে পায় না। প্রায় ক্ষেত্রেই তাই ঘটনাস্থল থেকে অপরাধের আলামত পুলিশ যাওয়ার আগেই ধ্বংস হয়ে যায়।

আমি দারোগার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, এটা নিছক আত্মহত্যা । তবে কি কারণে বা কার প্ররোচনায় ভিকটিম আত্মহত্যা করেছিল তা রীতিমত তদন্তের বিষয়। মেয়েটির বিয়ে হওয়ার মাত্র কয়েক মাস হয়েছে। এত অল্প সময়ে সাংসারিক জীবনের প্রতি কেন সে এত বেশি বিতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ল, তা অবশ্যই তদন্তকারী কর্মকর্তাকে খুঁজে বের করতে হবে।
স্বামীর বাড়িতে স্ত্রীর আত্মহত্যা হলে যদি ঘটনাটি প্রমাণিতভাবে আত্মহত্যাও হয়, ভিকটিম পক্ষ প্রায়শই স্বামী পক্ষের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ নিয়ে আসেন। তারা স্বজন হারানোর বেদনাকে নিরীহ স্বামীর উপর দোষারোপ করে ভুলতে চান। এ অবস্থায় জন ডলার্ডের 'হতাশা- উগ্রতা' প্রকল্পটির বাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়। স্বজন হারানোর বেদনায় কুপিত ভিকটিম পক্ষ এ অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য কাউকে না কাউকে দোয়ারোপ করবেই। তাই ঘটনার জন্য তারা আত্মহত্যার পরিবর্তে সরাসরি একটি হত্যা মামলা রুজুর জন্য পীড়াপীড়ি করেন। ভিকটিম পক্ষের লোকজন সুরুত হালে মারপিট করে হত্যা করা হয়েছে, এমন ধরনের চিহ্নের অস্তিত্বের কথা লিখতে দারোগাকে অনুরোধ, উপরোধ ও পীড়াপীড়ি করেন।

আমি দারোগাকে সঠিকভাবে সুরুতহাল প্রতিবেদন তৈরির অনুরেধ করলাম। দারোগা আমাকে ইঙ্গিত দিলেন যে মৃতার শরীরের পিঠের দিকে রক্ত জমাটের ফলে কালো দাগ পড়েছে। কোন মৃত দেহকে যখন মৃত্যুর পরপরই চিত করে শোয়ানো হয়, তখন তার শরীরের রক্তগুলো তরল পদার্থের ধর্মানুসারে পিঠের দিকে জমতে থাকে এবং পার্পল কালার ধারণ করে। ঝুলন্ত অবস্থায় থাকলে যেটা পায়ের দিকে বা শরীরের নিচের দিকে হওয়ার কথা, মৃত দেহ শুয়ে রাখার ফলে তা হয়েছে পিঠের দিকে। কিন্তু ভিকটিম পক্ষ এ দাগকে ঘুষির চিহ্ন বলে শনাক্ত করে দারোগাকে দিয়ে এ জাতীয় কথা সুরুত হালে লিখতে পীড়াপীড়ি শুরু করে।

এক সময় আমার কাছে ভিকটিম পক্ষ অভিযোগ করল যে দারোগা তাদের প্রতি বড়ই খারাপ আচরণ করছে। তাদের উপর রাগারাগি করছে, এমনকি মেয়ের চাচাকে চেয়ার দিয়েও মারতে দারোগা উদ্দত হয়েছিল।

আমি দারোগার আচরণ সম্পর্কি অভিযোগটির সত্যাসত্য নির্ধারণ করতে গিয়ে উপস্থিত বিভিন্ন জনের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকারের ব্যাখ্যা পেলাম। তবে ভিকটিম পক্ষের এক ইউপি সদস্যের পরামর্শে ভিকটিম পক্ষের কেউ সুরুতহালে সই করেনি বলেই দারোগা ক্ষেপে গিয়েছিলেন। এখানে দারোগার ক্ষেত্রের হতাশা-উগ্রতা নীতির প্রতিফলন ঘটেছে।এত কষ্ট করে নিজের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা দিয়ে তিনি লাশের সুরুতহাল করলেন। সাধারণ মানুষের যেখানে উচিত ও আইনী নির্দেশনা যে জনগণ পুলিশকে সহায়তা করবে, সেখানে কেউ সুরুতহাল প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করতে চাচ্ছেন না। এতে দারোগার মধ্যে হতাশার জন্ম নিয়েছে। আর সেই হতাশাই তাকে উগ্র করে তুলেছে।

লাশের সুরুতহাল করার সময় পুলিশকে যে বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় প্রায়সই পড়তে হয়, তাহল সুরুতহাল প্রতিবেদনে স্থানীয় সাক্ষীদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করা। লাশ দেখার জন্য ঘটনাস্থলে পাঁচ-সাত গ্রমের হাজার হাজার লোক আসবে। তারা ঘটনাস্থল পাড়িয়ে, মাড়িয়ে তছনছ করে আলামত সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব করে তুলবে। উৎসুক জনতাকে সরাতে তখন পুলিশকে হিমসিম খেতে হয়। কিন্তু সুরুতহাল করার পর সে সুরুতহালে সই করার মতো কোন লোককে খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে ভিকটিম পক্ষ হত্যার অভিযোগ নিয়ে এসে যদি তাদের মতো করে দারোগাকে সুরুতহাল তৈরি করতে বলেন এবং দারোগা তা না শুনে যদি নিজের মতো বা বিধিমত কাজ করেন, তাহলে তারা যে সই করবে না, তাই স্বাভাবিক। আলোচ্য ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

তবে আমাদের মাঠ পর্যায়ের পুলিশ অফিসারদের স্থানীয় অবস্থা ও ভিকটিম পক্ষের আবেগকে বুঝতে পারার যোগ্যতার যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে। যার আত্মীয় মারা যায় বা যার আত্মীয়কে হত্যা করার অভিযোগ করা হয়, সে লোকগুলোর মানসিক অবস্থা প্রায় ক্ষেত্রে থানার অফিসারগণ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন। তারা তাদের স্বভাব সুলভ কর্তৃত্ব এখানেও খাটাতে চান। সুরুতহালের ক্ষেত্রে ভিকটিম পক্ষের দ্বিমতগুলোকে তারা কৌশলে নিরসন করতে জানেন না।

আত্মহত্যা জনিত ফাঁসি আর হত্যা জনিত ফাঁসির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স বা ফরেনসিক বিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ যার আছে, সে দেখা মাত্রই হত্যা ও আত্মহত্যার মধ্যে পার্থক্য বুঝে ফেলবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা বুঝবে না। তাই পুলিশের বোঝা আর বাদীর বোঝার মধ্যের ফারাকটুকু দারোগার জন্য বাস্তবিকই বোঝা হয়ে ওঠে। এ বোঝাটুকু কাধে নিয়েই পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে হয়।

একজন পুলিশ অফিসারের গুণ, কর্মপদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে পাশ্চাত্য দেশে নিম্নলিখিত কথা চালু রয়েছে-

Police officer needs something of the experience of an arbitrator, a social worker, a lawyer and a doctor, without being trained as any of them. Being a policeman is the noblest of the profession of all because a man simultaneously plays the role of soldier, priest and artist.

মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী কোন অবস্থায় লাশের সুরুতহাল করতে গেলে পুলিশ কর্মকর্তাকে ঠিক এসব গুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে। তাকে ডাক্তারের বিজ্ঞতা নিয়ে বিষয়টিকে বুঝতে হবে, একজন ধর্মযাজকের হৃদয় নিয়ে ভিকটিম পক্ষকে শান্তনা দিতে হবে, একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর মতো সকল আইনগত দিক মাথায় রেখে সুরুতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে তাতে প্রত্যক্ষদর্শীদের স্বাক্ষর নিতে হবে।

আবার একই সাথে নিছক আত্মহত্যার বিষয়ে বাদি-বিবাদী উভয় পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করতে হবে। তবে এ বিষয়ে তাকে এমনভাবে অগ্রসর হতে হবে যেন কোন পক্ষই তাকে মনে করতে না পারে যে তিনি বিরোধী পক্ষের দ্বারা হাত হয়েছে। এক্ষেত্রে তাকে হতে হবে একজন আর্টিস্ট বা কলাবিদ তথা কূটনীতিক। লাঠি না ভেঙ্গে সাপ মারার কলাটুকু এখানে তাকে অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আলোচ্য ঘটনায় সুরুতহাল তৈরি তথা অপমৃত্যু মামলার তদন্তকারী পুলিশ অফিসার পুলিশের সকল প্রকার অত্যাবশ্যক গুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারেননি।(৫ আগস্ট, ২০১৩)