আর্থিক মূল্যে মাপা যায় না যে কৃতজ্ঞতা

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 12 June 2014, 10:54 AM
Updated : 12 June 2014, 10:54 AM

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে মাগুরা জেলার চাকরি শেষ করেছিলাম ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে। পুলিশ হেডকোয়ার্টাসের জরুরী নোটিসে হুট করে চলে এসেছিলাম ঝালকাঠিতে। সময় হিসেবে তা আজ থেকে সাত বছর আগের ঘটনা। কিন্তু মাগুরার মাত্র পনের মাসের চাকরিতে বেশ কিছু লোক আমাকে ভীষণভাবে ভালবেশেছিলেন। এ ভালবাসার পিছনে তেমন কোন যাদু মন্ত্র ছিল না। ছিল না কোন অসারণত্ব। আমি শুধু তাদের সামান্য কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করেছি। তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তরিকতা দেখিয়েছি। তাদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করেছি—এই যা।

কিন্তু এতটুকুই অনেকের মনে আমাকে একটা অপেক্ষাকৃত স্থায়ী আসন দিয়েছে। মাগুরার মানুষ এখনও আমাকে স্মরণ করেন। আমিও তাদের স্মরণ করি। এ পারস্পরিক ভালবাসা আর স্মরণ করার মধ্যে আইনজীবী থেকে শুরু করে ক্ষেতের কৃষক পর্যন্ত রয়েছে। রয়েছে দিন মজুরও।

মানুষকে আন্তরিকতার সাথে সেবা দেয়া, বিশেষ করে আম-আদমীদের সমস্যা সমাধানের পথ দেখানো একজন পুলিশ অফিসারে মনেও প্রশান্তি এনে দেয়। ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট দুঃখ-কষ্টগুলোকে একটু সহানুভূতির সাথে দেখলেই ছোট ছোট মানুষগুলোর বড় বড় উপকার হয়।

সে সময় এক দরিদ্র বিধবার মেয়ের প্রায়-ভেঙ্গে-যাওয়া সংসারখানা জোড়া লাগাতে সামান্য সহযোগিতা করেছিলাম। এ পরিবারটি ছিল দিন মজুর। আমার সহযোগিতার ফলে মেয়ের জামাই তাকে বাড়িতে নিয়ে যায়।

একদিন সেই মা ও তার সেই মেয়ে আমার অফিসে আসেন আমার প্রতি কৃতজ্ঞ জানানোর জন্য। আমার কাছে এসে মলিনবসনা বিধবা আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করতে চায়। কিন্তু পুলিশের পোশাক পরা অফিসারের চেয়ারে বসা একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার গায়ে হাত রাখতে তার সাহস হয়নি। আস্তে আস্তে কাছে এসে তিনি আমার টেবিলের উপর ৫০টি টাকা রেখে আমার হাতটি চেপে ধরে কাঁদতে থাকেন।

আমি বিব্রত হই। আমাকে টাকা দেয়ার কারণ জানতে চাই। বিধবা মহিলা বলেন, 'আমার মনির সংসার ঠিক করে দেয়ার জন্য আমি তোমাকে, বাবা, চা-বিস্কুট খাওয়ার জন্য এ টাকা দিলাম। নাও বাবা, আমি গরীব মানুষ। জানতে পারলাম, মা ও মেয়ে সারাদিন পচা পাট থেকে আঁশ ছড়িয়ে রোজগার করেছিলেন মাত্র ১০০ টাকা। তাদের এক দিনের রোজগারের অর্ধেক অংশ তারা আমাকে কৃতজ্ঞতার উপহার দিয়েছেন।

বিব্রত হলেও মনে মনে বড় প্রসস্তি বোধ করলাম। পুলিশের চাকরিতে এসে অনেক মানুষের অনেক উপকার করেছি। অনেক বিত্তবান লোকের উপকারেও এসেছি। কিন্তু কোন কোটিপতি তার গোটা পরিবারের একদিনের রোজগারের অর্ধেকটুকু আমাকে চা-বিস্কুট খাওয়ার জন্য দেয়ার মতো মহানুভবতা দেখাননি। কিন্তু নির্ধন এ বিধবা তা করেছেন।

ছোট ছোট মানুষের এই সব উপকার এবং তার প্রেক্ষিতে তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অতি সরল কায়দা অনেকের কাছে উদ্ভট ঠেকলেও আমার কাছে তা অত্যন্ত আনন্দের। কারণ, আমি জানি, ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাব খাটিয়ে সরকারি সেবা ক্রয় করেন। তাই হয়তো সরকারি কর্মচারিদের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা দেখাতে হয় না।

কিন্তু যারা ক্ষমতাহীন, যারা কারো তদবির বা অঙ্গুলি হেলানে সরকারি সেবা ‍পান না তাদের যদি সরকারি কর্মচারিগণ আইনানুসারে একটু সেবা দিয়ে থাকেন, তবে তারা সর্বান্তকরণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ক্ষমতাহীন আমজনতার এই কৃতজ্ঞতা এক কালীন নয়, চিরকালীন। ওরা আপনাকে স্মরণ রাখবে চিরকাল। আপনার সুনাম করবে সর্বত্র।

আজ মাগুরা থেকে এমনি একজন সাধারণ মানুষ আমার বাসায় লিচুর উপঢৌকন পাঠিয়েছেন। পরিমাণে বা আর্থিক মূল্যে এই উপঢৌকন অতি সমান্য। কিন্তু এই উপঢৌকনের সাথে যে আন্তরিকতা, কৃতজ্ঞতা ও একজন সরকারি কর্মকর্তাকে মনে রাখার আকুলতা জড়িয়ে আছে তার মূল্য অসীম, অগণ্য।(
১০/০৬/২০১৪)