পুলিশিং ও পুলিশের প্রকারভেদ

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 13 August 2014, 04:44 PM
Updated : 13 August 2014, 04:44 PM

ভূমিকাঃ সংগঠন ও ব্যক্তি বিশেষের ব্যক্তিত্বের ধরনের উপর পুলিশিং এর ধরন বা স্টাইলও নির্ভর করে। পুলিশিং এর ধরন জনগণের প্রত্যাশা, সামষ্টিক মানসিকতা ও স্থানীয় সাংস্কৃতির উপরও বহুলাংশে নির্ভশীল। বাংলাদেশের সমাজ সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বৃটিশদের থেকে আলাদা। তাই বাংলাদেশে পুলিশিং ব্রিটিশ পুলিশিং থেকে পৃথক হওয়াই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ও বৃটিশ সমাজে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, পরিবহন ও মালিকানার উপর কঠিন শর্ত আরোপ করা হয়। কিন্তু আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র নাগরিকদের নিত্য দিনে সাথী। তাই বাংলাদেশের পুলিশ অপরাধীদের মুখোমুখি হলে গোলাগোলির সম্ভাবনা তেমন থাকে না। অন্যদিকে, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ একটি সহিংস সমাজ বলেই পরিচিত। তাই অ্যামেরিকার পুলিশও সহিংস পুলিশিং এ অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ কিংবা বিক্ষোভগুলো সহসাই সহিংস হয়ে উঠে। তাই রাজনৈতিক সভা সমাবেশকে ঘিরে পুলিশকেও কঠোর পূর্ব-প্রস্তুতি নিতে হয়। এসব সামাজিক, সংস্কৃতির ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দেশের পুলিশ সংগঠনের ধরন বা স্টাইল নির্ধারণ করে।

একইভাবে ব্যক্তি হিসেবে প্রত্যেক পুলিশ অফিসারই তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সতন্ত্র। ব্যক্তিত্বের ভিন্নতার দরুন তাদের আইন প্রয়োগ তথা পুলিশিং এর ধরনও ভিন্ন হয়। কোন কোন পুলিশ অফিসার কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তিদের অধিকারী। কেউ কেউ আইনকে অধিকততর আক্ষরিক ভাবে প্রয়োগ করতে চান। কেউ আবার মনে করেন, আইন প্রয়োগের চেয়ে সমাজে শান্তি ও স্থিতি রক্ষা করাই আসল ব্যাপার। আইনকে শিথিল করে যদি শন্তি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে মন্দ কি? সমাজের শান্তির জন্যই তো আইন ও রাষ্ট্র। ব্যক্তি পুলিশ অফিসারের এ ধরনের স্টাইল আবার পুরো পুলিশ সংগঠনকেই প্রভাবিত করে। পুলিশ বিভাগের নীতি যদি ব্যক্তি অফিসারের নীতি বা স্টাইলের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হয়, তাহলে সে বিভাগে পুলিশিং ধরনও হয় ভিন্ন প্রকারের এবং প্রায় ক্ষেত্রে সে পুলিশ বিভাগ হয়ে পড়ে অকার্যকর। একজন পুলিশ অফিসার, পুলিশ ব্যবস্থাপক কিংবা পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্বদাতা কিংবা সরকারে থেকে রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে যারা পুলিশ বাহিনীকে জনগণের মঙ্গলের জন্য দিক নির্দেশনা দিতে চান তাদেরও তাই পুলিশ ও পুলিশিংএর এ ধরন, স্টাইল বা প্রকারভেদ সম্পর্কে অবগত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

এ নিবন্ধে আমরা প্রথমে পুলিশ বিভাগের সাংগঠনিক ধরন বা স্টাইলের প্রতারভেদ আলোচনা করব। অতঃপর ব্যক্তি পুলিশ অফিসারের পুলিশিং ধরন অনুসারে শ্রেণি বিন্যাসের দিকে নজর দিব। সবশেষে সাংগঠনিক ধরনের সাথে ব্যক্তি অফিসারের ধরনকে বিন্যাস্ত করার চেষ্টা করব।

পুলিশিং এর বিভাগীয় ধরনঃ বিভাগীয় পুলিশিং ধরন নিয়ে সর্বপ্রথম গবেষণা করেন জেমস কিউ উইলসন (১৯৬৮)। তিনি সাংগঠনিক স্টাইল অনুসারে পুলিশ বিভাগগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে বিন্যাস্ত করেন। এগুলো হলঃ
১. দর্শক বা পর্যবেক্ষণধর্মী (Watchman),
২. বিধিনিষ্ঠ (Legalistic) ও
৩. সেবাধর্মী (Service Style) ।

পর্যবেক্ষণধর্মী বা দর্শক স্টাইল পুলিশিং ব্যবস্থায় আইনকে শান্তি রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়। সমাজের শান্তি ও স্থিতির জন্য যতটুকু প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ ঠিক ততোটুকুই করা হয়। যদি আইন প্রয়োগ না করে কিংবা কিছুটা প্রয়োগ ও কিছুটা প্রয়োগ না করেই স্থিতিতাবস্থা রক্ষিত হয় তাহলে আইনের সম্পূর্ণ প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা নেই। এধরনের বিভাগে কোন ঘটনার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া বা ক্ষতির মাত্রার উপর নির্ভর করে আইন প্রয়োগ করা হয়। কোন পরিস্থিতিতে কোন আইন প্রয়োগ করতে হবে এবং তা কতটুকু প্রয়োগ করা হবে, তা মাঠ পর্যায়ের অফিসারগণে নির্ধারণ করেন। অর্থাৎ মাঠ পর্যায়ের পুলিশ অফিসারগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীন ক্ষমতা(discretion) ভোগ করেন।

অন্যদিকে বিধিনিষ্ঠ পুলিশ বিভাগে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ অফিসারদের স্বকীয় বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা সীমিত। এখানে কেন্দ্র থেকে প্রদত্ব নীতি ও সংসদকর্তৃক পাশ করা আইনের বাইরে যাবার সুযোগ নেই। ঊর্ধ্বতন থেকে শুরু করে নিম্নতম পদের অফিসারগণ স্থানীয় কমিউনিটির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যাবলী উপেক্ষা করে হলেও একই মানদণ্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এ ধরনের পুলিশ বিভাগে নাগরিকদের ছোট খাট আইনী বিচ্যূতিও উপেক্ষা করা হয় না। ফলে গ্রেফতার, উদ্ধার ও প্রসিকিউশনের হার বিধিনিষ্ঠ পুলিশ বিভাগে সবচেয়ে বেশি হয়। এখানে শান্তি রক্ষার চেয়ে আইন প্রয়োগেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। অনেক সময় এ ধরনের পুলিশ বিভাগে মানুষের জন্য আইন নয়, আইনের জন্য মানুষ- এ আপ্তবাক্য সত্য হয়ে ওঠে।

সেবাধর্মী পুলিশ বিভাগে পর্যবেক্ষণ বা আইন প্রয়োগের চেয়ে জনগণকে সেবা দানের বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনা করা হয়। শান্তিরক্ষা কিংবা আইন প্রয়োগের বিষয়কে গৌণ বিবেচনা করে নাগরিকদের প্রয়োজনমত সহায়তা দেওয়াই এ ধরনের পুলিশ বিভাগের চরম লক্ষ্য। এ ধরনের পুলিশ বিভাগে একান্ত চূড়ান্ত পর্যায় কিংবা বাধ্য না হলে সাধারণভাবে গ্রেফতার বা মামলা প্রদান করা হয় না। পর্যবেক্ষণধর্মী পুলিশ বিভাগের মত এখানে অফিসারদের স্বকীয় বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে।

একটি উদাহরণের মাধ্যমে এখন আমরা এ তিন ধরনের পুলিশ বিভাগের বৈশিষ্ট্যাবলীর পার্থক্য নির্দেশের চেষ্টা করব। ধরা যাক, সন্ধ্যারাতে কোন এলাকায় রাস্তার পাশে বা পার্কে বসে এক দল যুবক কোলাহলপূর্ণ আড্ডায় মত্ত হয়েছে। তাদের কোলাহলে আশেপাশের বাড়ির লোকজন কিছুটা বিরক্তও বটে। তবে এ ব্যাপারে কেউ পুলিশকে অভিযোগ দেয়নি। যুবকদের মধ্যে অনেকে অস্বাভাবিকভাবে ধুমপানরত। এখন এ দৃশ্য যদি পর্যবেক্ষণধর্মী পুলিশ বিভাগের কোন টহল অফিসারের সামনে পড়ে, তাহলে প্রথম পর্যায়ে অফিসার এখানে কোন হস্তক্ষেপ করবে না। কোন কারণে যদি নিতান্তই হস্তক্ষে করতে হয়, তবে যুবকদের নিজ নিজ বাড়িতে চলে যাবার নির্দেশদানে মধ্যেই তা সীমিত থাকবে।

অন্যদিকে, এ পরিস্থিতিতে বিধিনিষ্ঠ পুলিশ বিভাগের অফিসারগণ যুবকদের নামে রীতিমত মামলা করবে কিংবা গ্রেফতার করবে। অপরদিকে সেবাধর্মী পুলিশ বিভাগের অফিসারগণ এমন পরিস্থিতিতে বিবেচনা করবে যুবকদের এ আচরণ স্থানীয় কমিউনিটি সদস্যগণ কিভাবে নিচ্ছেন। যদি এটা প্রকৃতপক্ষে জন-উদ্বেগের কারণ হয়, তবে সেবাধর্মী পুলিশ সংগঠনের অফিসারগণ যুবকদের হেদায়াতমূলক বক্তব্য দিবেন এবং বেশি মাত্রায় গেলে ঘটনাস্থলে তাদের অভিবাবকদের ডাকবেন কিংবা যুবকদের তাদের স্ব-স্ব বাসায় পৌঁছে দিয়ে অভিবাবকদের শতর্ক করে দিবেন।

সাধারণত কেন্দ্রীভূত কমান্ডের পুলিশ সংগঠনগুলো, যেমন হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা বিধিনিষ্ঠ স্টাইল গ্রহণ করে। অন্যদিকে, স্থানীয় থানা পুলিশ পর্যবেক্ষণ ধর্মী কিংবা সেবাধর্মী স্টাইল গ্রহণ করে। অধিকন্তু সমজাতীয় চরিত্র কিংবা সমজাতীয় সামাজিক স্তর বিশিষ্ট সমাজে সেবাধর্মী পুলিশিং স্টাইল গ্রহণ করা যায়। অন্যদিকে, সংঘাতপূর্ণ ও বেশি মাত্রায় অপরাধ প্রবণ এলাকায় সাধারণভাবে বিধিনিষ্ঠ পুলিশিং স্টাইল গড়ে ওঠে।

পুলিশিং এর ব্যক্তিগত ধরন
সাংগঠনিক স্টাইল তথা ধরনের বাইরেও ব্যক্তি পুলিশ অফিসারদের নিজস্ব পুলিশিং ধরন রয়েছে। এ ধরন বা স্টাইল প্রত্যেক অফিসারের মনোভাব, ব্যক্তিগত বিশ্বাস, মূল্যবোধ, পেশাগত প্রত্যাশা ও পেশার প্রতি তাদের নিজস্ব মতামতের উপর নির্ভর করে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়।

পুলিশিং এর ব্যক্তিগত ধরনের উপর বেশ কিছু গবেষণা রয়েছে। প্রত্যেক গবেষকই তার নিজস্ব আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে অফিসারদের শ্রেণি বিন্যাস করেছেন। এসব শ্রেণি বিন্যাসের সবগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয় ; বরং এক গবেষকের শ্রেণি বিন্যাস অন্য গবেষকের শ্রেণি বিন্যাসের সাথে পার্থক্য ও সাদৃশ্য বা দ্বিত্বতা প্রদর্শন করে। আমরা এখন উইলিয়াম মুইর (William Muir, 1977), জন ব্রডারিক (John Broderick, 1977), মাইকেল ব্রাউন (Michael Brown, 1981) ও হোকসচেডলোর (Hochstedler, 1981) এর শেণি বিন্যাস আলোচনা করব।

উইলিয়াম মুইর এর শ্রেনী বিন্যাস
ব্যক্তি অফিসারের দুইটি বৈশিষ্ট্যকে দুইটি মাত্রা ধরে মুইর তার পুলিশের শেণি বিভাগ করেছেন। এদুটো গুণ বা বৈশিষ্ট্য হল, ভাবাবেগ (Passion) এবং দৃষ্টিভঙ্গী (Perspective) । ভাবাবেগ কোন অফিসারের পেশাগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য জবরদস্তিমূলক বল প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তার মাত্রা নির্দেশ করে। ভাবাবেগই নির্ধারণ করবে প্রয়োজনের সময় কোন পুলিশ অফিসার তার বল প্রয়োগের ক্ষমতাকে কতটুকু প্রয়োগ করবেন এবং তা কিভাবে প্রয়োগ করবেন কিংবা তিনি বল প্রয়োগে আদৌ উৎসাহী কিনা। দৃষ্টিভঙ্গী হল, কোন অফিসারের কমিউনিটি সদস্য তথা নাগরিকদের সাথে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মিথস্ক্রিয়ার মাত্রা। ভাগাবেগ ও দৃষ্টিভঙ্গির মাত্রার ভিত্তিতে মুইর পুলিশ অফিসারদের চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। এগুলো হলোঃ
১. পেশাদার (Professional),
২. আইন প্রয়োগকারী (Enforcer),
৩. প্রতিকর্মী (Reciprocator), ও
৪. উপেক্ষক (Avoider).

পেশাদার পুলিশ অফিসারঃ যে অফিসারের মধ্যে ভাবাবেগ ও দৃষ্টিভঙ্গি দুটোই সমভাবে উপস্থিত থাকে তিনি হলেন পেশাদার। মুইয়ারের মতে কিছু কিছু পুলিশ অফিসার তার পেশার অংশ হিসেবেই বল প্রয়োগের বিষয়টিকে বিবেচনা করেন। প্রয়োজনবোধে তারা বল প্রয়োগে পিছপা হন না। আবার বল প্রয়োগের পরবর্তী পরিস্থিতিকেও তারা স্বাভাবিক বলেই গ্রহণ করেন। অপরপক্ষে, কতিপয় পুলিশ অফিসার বল প্রয়োগে দ্বিধাবোধ করেন এবং পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিচলিত বোধ করেন। প্রথম অবস্থাটি হল, ভাবাবেগ (Passion) এবং দ্বিতীয় অবস্থাটি হল, দৃষ্টি ভঙ্গি Perspective)। ভাবাবেগ ও দৃষ্টিভঙ্গী সমান ভাবে যে পুলিশ অফিসারের চরিত্রে ধাতস্থ হয়, মুইয়ার তাদেরকেই পেশাদার বলে অবহিত করছেন। পেশাদার পুলিশ অফিসার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে প্রত্যেক ঘটনা বা পরিস্থিতি গভীর ভাবে মূল্যায়ন করেন এবং একান্ত প্রয়োজন না হলে বল প্রয়োগ করেন না। বল প্রয়োগে তারা যথাযথ মাত্রা অনুসরণ করেন। এ শ্রেণির পুলিশ অফিসারগণ মনে করেন, সমাজে পুলিশের ভুমিকা খুবই কঠিন ও জটিল। তারা দায়িত্ব পালনে পুলিশের সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রতি কাঙ্খিত মাত্রায় সচেতন এবং তা সাদরে গ্রহণ করেন। এ জাতীয় পুলিশ অফিসারগণ উচ্চ মাত্রায় পেশাগত সন্তুষ্টি ভোগ করেন।

আইনপ্রয়োগকারীঃ এ জাতীয় পুলিশ অফিসারের মধ্যে উচ্চমাত্রার ভাবাবেগ (Passion) থাকলেও এদের মধ্যে যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি (Perspective) এর ঘাটতি রয়েছে। তারা বল প্রয়োগে অধীক মাত্রায় সময় উৎসাহী। তাদের কাছে সামাজিক বা বাস্তব পরিস্থিতির চেয়ে আইন প্রয়োগই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারা সমাজের প্রতি একটি তাচ্ছিল্যপূর্ণ (Cynical) দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন যার ফলে তারা পুলিশ ও জনগণের মধ্যে 'আমরা-তোমরা' /'ওরা কিংবা 'ভাল মানুষ' ও 'খারাপ মানুষ' ধরনের মনোভাব পোষণ করেন। এ জাতীয় পুলিশ অফিসার আইনকে আক্ষরিক অর্থে অবিকৃতরূপে প্রয়োগে উৎসাহী। আইন প্রয়োগকালীন তারা এতটাই চরমপন্থা অবলম্বন করেন যে কোন মানুষের অপরাধ করা কিংবা আইনভঙ্গের পিছনে নিয়ন্ত্রণহীন কোন বিষয় বা অবস্থাকে তারা আমলেই নিতে চান না। এরা কিছু সময়ের জন্য হলেও নিজেদের শ্রেফ অপরাধ যোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু যেহেতু সকল আইন সবসময় আক্ষরিক অর্থে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে জনগণের বাস্তব অবস্থাকে বিবেচনায় নেন না, তাই এ শ্রেণির পুলিশ অফিসারগণ দ্রুত তাদের পেশার প্রতি হতাশা হয়ে পড়েন।

প্রতিকর্মীঃ এ জাতীয় পুলিশ অফিসারদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি (Perspective) পুরো মাত্রায় থাকলেও তাদের মধ্যে ভাবাবেগের ঘাটতি থাকে। তারা প্রায় ক্ষেত্রে বিয়োগাত্মক জীবন দৃষ্টির অধিকারী হন। এ জাতীয় পুলিশ অফিসার পেশাদার অফিসারদের অনুরূপ বল প্রয়োগকে পেশার অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করেন। এ জাতীয় অফিসার মনে করেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একটি শুভ দিক রয়েছে। তাই কোন মানুষ আইন ভঙ্গ তথা অপরাধকর্মে জড়িত হলে, তাকে ভাল হবার বা সংশোধনের সুযোগ দেয়া উচিৎ। এরা জনগণকে সকল পরিস্থিতিতে সাহায্য করার মানসিকতা পোষণ করেন। তবে সাংগঠনিক নীতি ও সমাজের বাস্তবতা এদের হতাশ করে তোলে। তাই এরা ও দ্রুত কর্মসন্তুষ্টিহীনতায় ভোগেন।

উপেক্ষকঃ এ শ্রেণির পুলিশ অফিসারগণ পেশাদার শ্রেণির সম্পূর্ণ বিপরীত। এদের মধ্যে না আছে ভাবাবেগ, না আছে কাঙ্খিত দৃষ্টিভঙ্গী । তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পুর্ণ বিয়োগাত্মক এবং বল প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা নৈতিকতার সংকটে ভোগেন। তারা মনে করেন, সমাজের অধিকাংশ সামাজিক ও অপরাধ সমস্যাই পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই কোন বিষয়েই তারা কাঙ্খিত মাত্রার উৎসাহ দেখান না। তারা মূলত ছা-পোষা টাইপের। কোন রকম দিন পার করে মাস শেষে বেতনটুকু নিয়ে পরিবারের ভরণপোষণই তাদের চরম লক্ষ্য । তাই যতটুকু না করলে চাকরী বাঁচবে না, তারা তার বাইরে কোন দায়িত্ব পালন করতে চান না। পেশার প্রতি এধরনের পুলিশ অফিসারদের তেমন কোন মোহই নেই। তাই তারা উচ্চ মাত্রায় পেশাগত অসন্তুষ্টিতে ভোগেন।

জন ব্রোডারিকের প্রকারভেদ

জন ব্রোডারিক দুইটি মাত্রার উপর ভিত্তি করে পুলিশ অফিসারদের চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। তার মাত্রা দুটো হল, আইনের যথাযথ পদ্ধতি (Due Process of Law) এবং সামাজিক শৃঙ্খলার উপর গুরুত্ব (Emphasis on Need for Social Order)। ব্রডারিকের মতে উপরিউক্ত দুই মাত্রার ভিত্তিতে পুলিশ অফিসারদের চারটি শ্রেণিতে বিন্যাস্ত করা যায়:
১. আইনপ্রয়োগকারী (Enforcer)
২. আদর্শবাদী (Idealist)
৩. আশাবাদী (Optimist) ও
৪. বাস্তবাদী (Realist)

আইনপ্রয়োগকারীঃ ব্রোডারিকের আইন প্রয়োগকারী পুলিশ অফিসারগণ মুইয়ারের আইনপ্রয়োগকারীদের মতোই সমাজকে রক্ষার জন্য আইনের আক্ষরিক ও আপোসহীন প্রয়োগে উৎসাহী হন। এ ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে সামাজিক শৃঙ্খলাকে কম গুরুত্ব দেন যার ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা তাদের কাছে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব বহন করে। আইন প্রয়োগকারীগণ আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু বাস্তবে যখন দেখেন, পুলিশিং শুধু অপরাধের বিরুদ্ধে যুদ্ধই নয়, তাদের অন্যান্য কাজেও ব্যস্ত থাকতে হয়, তখন তারা কর্মঅসন্তুষ্টিতে ভোগেন।

আদর্শবাদীঃ এ ধরনের পুলিশ অফিসারগণ যথাযথ আইনী পদ্ধতি ও সামাজিক শৃঙ্খলা – এ উভয় মাত্রায় সমান গুরুত্ব দেন। এরা মুইয়ারের প্রতিকর্মী (Reciprocator) দের মতো মানুষের ভাল মন্দ উভয় দিকই আমলে নেন এবং আইন প্রয়োগকালীন খারাপ দিকের বিপরীতে ভাল দিকটি বিকশিত করতে সহায়তা করেন।

আশাবাদীঃ ব্রোডারিকোর আশাবাদী শ্রেণির পুলিশ অফিসারগণ মুইয়ারে পেশাদার শ্রেণির অফিসারদের মতো আইন প্রয়োগে শাস্তিদান বা সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার চেয়ে মানুষকে সাহায্য করতেই বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে। এরা যথাযথ আইনী পদ্ধতিকে অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এরা মনে করে, পুলিশ অধিকাংশ সময় আইন প্রয়োগের বা অপরাধ যুদ্ধের চেয়ে অন্য কাজে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকে।

বাস্তববাদীঃ ব্রোড়ারের চতুর্থ শ্রেণির পুলিশ অফিসারগণ হলেন বাস্তববাদী (Realist) । যথাযথ আইনী পদ্ধতি ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা এ উভয় মাত্রাতেই সর্ব নিম্নে অবস্থান করেন এরা। মুইয়ারের উপেক্ষক শ্রেণির অফিসারদের মতো বাস্তবাদীগণ পুলিশের সামনে সমাধানের অযোগ্য হাজারো সমস্যা দেখতে পান। তাই তারা তাদের সামনে উপস্থাপিত সমস্যাগুলোকে গড় পড়তায় পুলিশি সমস্যা নয়, কিংবা এক্ষেত্রে পুলিশের তেমন কিছুই করার নেই এ ধরনের মন্তব্য করে থাকেন।

মাইকেল ব্রাউনের শ্রেনিবিন্যাস
ব্রাউন পুলিশ অফিসারদের শ্রেনি বিন্যাসের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে সুনির্দিষ্টতা (Selectivity of Enforcement) এবং জনপথের উগ্রতা (Progressiveness on the Street) – এ দুই মাত্রার ভিত্তিতে পুলিশ অফিসারদের চারটি শ্রেণিতে বিন্যাস্ত করেছেন। এগুলো হল:
১. সনাতনী অপরাধযোদ্ধা (Old Crime Fighter),
২. স্বচ্ছ বিট অপরাধ যোদ্ধা (Clean Beat Crime Fighter),
৩. সেবাধমী-১, সেবাধর্মী-২ (Service Style-1 and 2) ও
৪. পেশাদার (Professional)

অপরাধ যোদ্ধাঃ ব্রাউনের সনাতনী অপরাধ যোদ্ধা ও স্বচ্ছ বিট অপরাধ যোদ্ধা শ্রেণির অফিসারগণ মুইয়ারের আইন প্রয়োগকারী শ্রেণির অনুরূপ। তারা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশি মাত্রায় উগ্র এবং আইন প্রয়োগকালীন বাছ-বিচারের ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়ভাবে খুঁতখুঁতে। সনাতনী অপরাধ যোদ্ধা আর স্বচ্ছ বিট যোদ্ধাদের মধ্যে পার্থক্য এটুকুই যে সনাতনী যোদ্ধারা আইনী-বেআইনী যে কোন প্রকারে অপরাধ সমস্যাটির সমাধানে আত্মনিয়োগ করে। কিন্তু স্বচ্ছ বিট যোদ্ধারা সব সময়ই আইনের পদ্ধতি অনুসরণ করেই তা করতে উদ্দোগী হন। উভয় শ্রেণির অফিসারই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট যাচাই বাছাই করেন এবং সাধারণ বা নগণ্য প্রকৃতির সমস্যাগুলো উল্লেখ করে শুধু গুরুতর বা চটকদার বিষয়গুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। এ উভয় শ্রেণির অফিসারই মুইয়ারের আইন প্রয়োগকারীদের মতো কর্মঅসন্তুষ্টিতে ভোগেন।

সেবাধর্মী-১: ব্রাউনের সেবাধমী-১ শ্রেণির অফিসারগণ মুইয়ারের প্রতিকর্মীদের অনুরূপে অপরাধ দমনের চেয়ে কমিউনিটি সদস্যদের মূল্যবোধের প্রতি বেশি মাত্রায় সহানুভুতিশীল। এ শ্রেণির অফিসারগণ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ যাচাই বাছাই করলেও তেমন বাড়াবাড়ি বা উগ্রতা প্রদর্শন করেন না। কমিউনিটির সদস্যদের কাছে উদ্বেগ সৃষ্টি করে এমন ধরনের সমস্যাগুলোই তারা বেছে নেন।

সেবাধর্মী-২: অন্যদিকে সেবাধর্মী-২ টাইপের অফিসারগণ এক নম্বর টাইপের মতোই কম উগ্রতা প্রদর্শন করে। তবে তারা সমস্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরো বেশি সতর্ক ও সীমিত তারা ঠিক মুইয়ারের উপেক্ষকদের (Avoider) মতোই দায়িত্ব বা সমস্যা পরিহারের প্রবণতা প্রদর্শন করে। এদের কাছে পুলিশের চাকরী তেমন আকর্ষণীয় নয়। তারা এটাকে বেকারত্ব ঘুচাবার উপায় হিসেবে বিবেচনা করে যত কম কাজ করে দিন পার করা যায় তার প্রতীক্ষায় থাকেন।

পেশাদারঃ ব্রাউনের পেশাদার শ্রেনির পুলিশ অফিসারগণ মুইয়ার পেশাদার শ্রেনি ও ব্রোডারিকের আদর্শবাদীদের অনুরূপ। এরা পুলিশের চাকরিকে গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল মনে করেন। তাছাড়া আইন প্রয়োগ, সমস্যা নির্বাচন ও তা সমাধানের ক্ষেত্রে এরা যথেষ্ঠ স্ববিবেচনার ক্ষমতা ভোগ করে।

হোসটেডলারের শ্রেনিবিভাগ
পুলিশি কাজের বিভিন্ন ধরন বা (ধঢ়ঢ়ৎড়ধপয) এর ভিত্তিতে হোসটেডলার অফিসারদের পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেছেনঃ
১. অতিপুলিশ (Supercop),
২. পেশাদার (Professional),
৩. সেবাধমী (Service Oriented) ও
৪. উপক্ষেক (Avoider)

অতিপুলিশ মানসিকতার পুলিশ অফিসারগণ মূলত অপরাধ যোদ্ধা। তারা সমাজকে গুরম্নতর অপরাধ থেকে যে কোন মূল্যে মুক্ত করতে চাই অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে তার যে কোন মাত্রার বল প্রয়োগে বদ্ধ পরিসর। তবে তারা হত্যার, গুরুতর আহত কর, ডাকাতি, দস্যুতা বা সন্ত্রাসী -বোমাবাজী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর হলেও মানুষের দৈনন্দিন জীবণের উপর প্রভাব বিস্তারকারী সাধারণ প্রকৃতির অপরাধ গুলোকে প্রয়োগ করে। এই শ্রেণীর অফিসারগণ নাটক, সিনেমা, হলিউড-বলিউড মারদাঙ্গা পুলিশ নায়কদের নিজেদের আদর্শ বলে মনে করে।

পেশাদার পুলিশ অফিসারগণ তাদের কাজকে সব দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। তাই পেশাকে উন্নত করার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনের জন্য সদা সচেষ্ট থাকেন। এসব অফিসার অপরাধ প্রতিরোধ, জনসংযোগ গুরুতর থেকে সাধারণ শ্রেণীর অপরাধ সবগুলোকেই সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। যে কোন সমস্যাকে আবেগত পেশাগত জ্ঞানের সমন্ধে যে কোন মোকাবেলার চেষ্টা করেন। সেবাধর্র্মী পুলিশ অফিসারগণ পুলিশকে সমাজ সেবা বা জনসেবার নামান্তর মনে করেন। তারা অপরাধ যোদ্ধা নন সমাজ সেবক। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তি দানের পরিবর্তে তাদের পূর্ন বাসনের পক্ষে মত দেন এরা। নাগরিকদের উপর বল প্রয়োগের চেয়ে তারা অপরাধীদের সমাজে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মানসে তাদের পূর্ণ বাসনে আত্মনিয়োগ করেন। হোস্টেডলারের মতে এসব পুলিশ অফিসার দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হন যা মূলত অর্জন করা সম্ভব হয় না এবং তারা দ্রুত কর্ম অসন্তুষ্টিতে ভোগেন। হোস্টেডলারের চতুর্থ শ্রেণীটি হল উপেক্ষক স্টাইলের। এরা মনে করে অপরাধ সমস্যা সমাধানে পুলিশের তেমন কিছু করার নেই। তারা যত পারা যায় ততো কম কাজ করার সুযোগ খোঁজেন। নানা অজুহাতে দায়িত্ব এড়িয়ে যান। শুধু যে অলস্য থেকে তারা দায়িত্ব এড়ান তা নয়, তারা বরং অনেকটাই বিভ্রান্ত ও বীতশ্রদ্ধ এবং ভীতিগ্রস্ত। অপরাধ পরিসংখ্যান কতটা সত্য বলে?

উপসংহারঃ পুলিশ ও পুলিশিং এর শ্রেণিবিভাগ অনেকটাই একাডেমিক বা আদর্শিক। প্রকৃতপক্ষে কোন একটি পুলিশ বিভাগকে আমরা আদর্শিকভাবে কোন একটি স্টাইলের প্রতিনিধি বলে ধরে নিতে পারি না। তেমনি কোন ব্যক্তি পুলিশ অফিসারকেও আমরা একটি সুনির্দিষ্ট শ্রেণিবিন্যাসে সার্বক্ষণিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি না। পুলিশি এমন একটি রাষ্ট্রীয় সংগঠন যা পরিবর্তনশীল সমাজের চাহিদা পূরণের জন্য কাজ করে, জনগণকে তাদের চাহিদামত সেবা দিয়ে থাকে। জনগণের চাহিদা যেমন সীমীত নয়, তেমনি তাদের জন্য সেবাদানকর্ম ব্যাকরণের নিয়মে আবদ্ধ নয়। সাধারণভাবে আমরা একই পুলিশ বিভাগে বিভিন্ন ধরনের স্টাইল লক্ষ করি। তেমনি একই পুলিশ অফিসার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন স্টাইল অনুসরণ করে থাকেন। তবে যে বিভাগে যে ধরনের স্টাইল অধিক সময়ের জন্য অনুসরণ করা হয় কিংবা যে অফিসার তার পেশাগত জীবনে যে ধরনের স্টাইল সবচেয়ে বেশি সময় ধরে বা বেশি বার প্রয়োগ করে স্বাচ্ছন্নবোধ করেন আমরা সেই বিভাগকে বা সেই অফিসারকে সেই ধরনের পুলিশ বিভাগ বা অফিসার বলে সাধারণভাবে বিন্যাস্ত করতে পারি।