দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগের জন্য আত্মাহুতি দেয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নয়

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 16 Nov 2014, 06:29 PM
Updated : 16 Nov 2014, 06:29 PM

কয়েকদিন ধরে অফিসে যাতায়াতের পথে দেখছি, ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কিছু যুবক মাইকে কচি কণ্ঠে শ্লোগান দিচ্ছে। প্রথমে বুঝতে পারি নি যে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু। এরা প্রথমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় নি। তাই দ্বিতীয় বারের জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিতে চায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত হল, এক বারের বেশি কেউ ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না। কেননা এতে অসম প্রতিযোগীতা হয়। তারা দেখেছেন প্রথম বারের পরীক্ষা দেয়া ছাত্রছাত্রীগণ ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য যে সময় পায়, দ্বিতীয়বারের পরীক্ষার্থীগণ তার চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি সময় পায়। তাই প্রতিবারই দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেয়া ভর্তিইচ্ছুদের সংখ্যা বাড়ছে।

বিষয়টি নিয়ে নানা প্রকারের সমীরকণ রয়েছে। কেউ যদি বলে, এটা প্রথমবার ভর্তি হতে না পারা ছাত্রছাত্রীদের জন্য বড় বেকায়দার। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হটাৎ করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষা দেয়া ভর্তিইচ্ছুদের পোয়াবারো। তারা দেখবে সবাই তাদের মতোই সমান মেধার, সমান প্রস্তুতির। অধিকন্তু দ্বিতীয়বারের মতো পরীক্ষা দিতে আসাদের অযোগ্যতার জন্য তাদের মধ্যে প্রতিযোগীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে।

আমি মনে করি, বিষয়টি দুই দিক থেকেই সমান গুরুত্বপূর্ণ। ভর্তির সুযোগটি দ্বিতীয়বার রেখে  এবারের মতো বিবেচনা করা যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি আসন সংখ্যা বৃদ্ধি না করা হয়, তাহলে চূড়ান্ত বিচারে কোন লাভ হবে না। গত বারের হোক আর চলতি বছরের হোক ভর্তির সুযোগ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা সীমিতই থাকবে।

কিছু কিছু আন্দোলনের পক্ষে কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতীয় মুসলমানগণ মওলানা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে তুরস্কের খেলাফত রক্ষার আন্দোলন করেছিলেন। তাদের আন্দোলনে এক সময় মহাত্মা গান্ধিও সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু যাদের খেলাফতের জন্য সুদূর ভারতের মুসলমাগণ আন্দোলন-অনশন করছিলেন, সেই তুর্কিরাই এক সময় কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে খেলাফত বাতিল করে দিলেন। বিষয়টি এমনও হতে পারে। যাদের জন্য আন্দোলন করা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তারাই হয়তো পিছুটান দিবেন। কেননা দ্বিতীয়বার ভর্তিইচ্ছুরা সংগঠিত নয়।

যেসব ভর্তিইচ্ছু ছাত্রছাত্রী ভর্তির সুযোগ পাওয়ার জন্য অনশন করছেন, তারা বড়ই ঝুঁকির মধ্যে আছেন। তাদের আন্দোলন সফল হলে তারা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পথ নিশ্চিত করতে পারবেন তাও নয়। তারা কেবল ভর্তি পরীক্ষার সুযোগটুকু পাবেন; পরীক্ষায় পাশের নিশ্চয়তা নয়। যদি পাশ করেন, তো ভর্তি হবে; অকৃতকার্য হলে চলে যাবেন অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কলেজে কিংবা আর উচ্চতর শিক্ষা তারা নাও নিতে পারেন।

আমার অভিজ্ঞতা বলে, এ আন্দোলরত ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই ইতোমধ্যে কোন না কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ভর্তি হয়েছেন। কারণ যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা পাশের যোগ্যতা রাখেন, তারা অন্যকোথাও ভর্তির সুযোগ পাবেন। এরা যদি তাদের ইতোমধ্যে ভর্তি হওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থেকেই ভালভাবে পড়াশোনা করেন, তাহলে তাদের অনার্সের ফলাফলও ভাল হবে এবং ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠার পথও সুগম হবে। খামোখা একটি বছর নষ্ট করে দ্বিতীয়বার চেষ্টায় সময় নষ্ট করাটা কোন ক্রমেই যৌক্তিক হবে না। যদি বুঝতাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেই চাকরিটা হাতের মুঠো এসে যাবে, তাহলে অন্য কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে অগণিত ছাত্রছাত্রী বেকার রয়েছে। কেউ কেউ স্বপেশায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ গ্রামে গিয়ে বড় অংকের টাকা স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও বাটপাড়দের উৎকোচ দিয়ে বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষকতার চেষ্টা করছে। আমি মনে করি, এসব প্রতিষ্ঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা না করলেও পাওয়া যেতে পারে।

অনশনকারী ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা প্র্রথম দিকে ছিল ২০০। তা কমে গতকাল পর্যন্ত দাঁড়িযেছিল ৫০ জনে। আজ অবধি এ সংখ্যা হয়তো ১০/১২ তে নেমে আসবে। কারণ ভর্তিইচ্চুদের এ দাবি মেনে নেয়ার মতো কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। এটা কোন রাজনৈতিক দাবিও নয়, অপরিহার্য দাবিও নয়। তাছাড়া তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে কেউ যদি আত্মহত্যা করে তাহলে তার দায়ভার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিবেন কেন?  পাবলিক পরীক্ষায় পাশ করতে না পেরেও তো অনেকে আত্মহত্যা করে। তাই বলে শিক্ষা বোর্ড কি তাদের দায়দায়িত্ব নেয়?

শ্রেফ ভর্তির সুযোগ না পাওয়া যদি কেউ তার জীবন বিপন্ন করে, তাহলে সেটা সেই ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞতাপূর্ণ অধ্যবসায়কে অস্বীকার করার সামীল। যদি কেউ জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে চান, সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েও হতে পারে। ইদানীং বেসরকারী কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলোতেই ভাল শিক্ষা দেয়া হয়। বিসিএস পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের একক আধিপত্য আর নেই। আমার সময় (২০ তম বিসিএসএ) ১১০ জন এএসপির মধ্যে ৭৮ জনের মতো ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। সে সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও অনার্স কলেজগুলো থেকে পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের বিসিএস পরীক্ষায় কৃতকার্যের খবর তেমন পাওয়া যেত না। কিন্তু গত একযুগে পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই চাকরিতে পোয়াবারো হবে এমন তত্ত্ব এখন আর ধোপে টিকছে না।

অনশনরত এসব তরুণ-তরুণীদের প্রতি তাই আমার অনুরোধ, অনশন ভঙ্গ করুন। আপনার মেধায় বর্তমানে যা পেয়েছেন তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুন। যে প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই পড়ে ভাল ফলাফল করুন। জানার চেষ্টা করুন সবকিছু। সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যেমন সুযোগ পাবেন না, তেমনি যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তারাও সবাই বিশ্ব জয় করবেন না। বিশ্বজয়ের যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ আপনাদেরও আছে। কারণ সেই যুদ্ধ এখনও শুরুই হয়নি। আপনারা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েও সে সুযোগ পাবেন। অযথা আত্মাহুতি দেবেন না।