অতঃপর মফিজের সিএনজিতে আকাশ পথে চুরি

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 21 Dec 2014, 12:45 PM
Updated : 21 Dec 2014, 12:45 PM

একটা সময় ছিল যখন ঢাকায় বৃহত্তর রংপুর- দিনাজপুর এলাকার অধিবাসীদের সামান্য কজন পাওয়া যেত। চাকরির সুবাদে ঢাকায় আসার বাইরে গায়েগতরে খেটে জীবিকা উপার্নের জন্য আসা উত্তরাঞ্চলের মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা যেত। ১৯৯০ সালের আগে ঢাকায় রিকসায় চড়ে কেউ যদি রিকসাওয়ালার বাড়ির কথা জানতে চাইতেন, তাহলে অর্রেরক বেশি রিকসাওয়ালা বলতেন, তাদের বাড়ি বৃহত্তর ফরিদপুর কিংবা তার কাছাকাছি এলাকায়। তখন হয়তো একশতে চার/পাঁচজন রিকসাওলার বাড়ি রংপুর বা দিনাজপুরে হত। এমনিভাবে ঢাকার ফুটপাতের দোকানী বা রাস্তার ফেরিওয়ালাদের মধ্যে রংপুরের কাউকে খুঁজে বের করা ছিল দুষ্কর ।

কিন্তু মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে পরিস্থিতির আকাশ পাতাল পরিবর্তন ঘটে। এখন ঢাকার রিকসা চালকদের বেশির ভাগই রংপুর-দিনাজপুরের। ঢাকার ফুটপাতের দোকান, গলির ফেরিওয়ালা, নির্ণ এলাকার মিস্ত্রি-শ্রমিক, সিএনজি অটোরিকসার চালক এমনকি টেক্সি বা বাস চালকদের মধ্যেও আপনি উল্লেখ্যযোগ সংখ্যায় রংপুর-দিনাজপুরের মানুষদের দেখতে পাবেন।

উত্তরাঞ্চলের মানুষগুলো অতি সহজ সরল। এ সরলতার জন্য তাদের দক্ষিণাঞ্চলের কুটিল লোকজন নাম দিযেছেন, 'মফিজ'। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু চালু হওয়ার পর থেকেই ঢাকার রাস্তায় মফিজদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। বর্মানে ঢাকায় মফিজের অভাব নেই।

আমাদের এলাকার মফিজদের বড় অংশ আমার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর সংগ্রহে রাখেন। কারণ আমিও প্রকারান্তরে মফিজ। তাদের সুখ-দুঃখের সময় তারা আমাকে ফোন দেন। কেউ কেউ মহামান্য রাষ্ট্রপতির মোটর কেইডের মধ্যে সিএনজি অটোরিকসা ঢুকিয়ে দিয়ে পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করে। নিতান্তই বোকামীর জন্য তারা গ্রেফতার হয়; তাদের সিএনজি অটোরিকসা আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। মফিজ তখন আমার ফোন দিয়ে পায়ে পড়ে। অনেক সময় রিকসা চালক মফিজরা রাস্তা সংক্ষিপ্ত করতে গিয়ে ভিআইপি রোডে রিকসা ঢুকিয়ে দিয়ে রিকসাটাই খোয়ান। তাদের রিকসা নিয়ে যাওয়া হয় কাঁচপুরের ডাম্পিং গ্রাউন্ডে। আমি এসব রিকসা চালক মফিজদের জন্য লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে তাদের রিকসা ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য তদবির করি। আমার ব্যাচ মেইট ট্রাফিকের ডিসিগণ বলে, ছি! ছি! তুমি একটা রিকসার জন্য তদিবির করছ? আমি বলি, পাজেরা বা টয়োটার জন্য তদিবির করছি না। কারণ গাড়ির মালিকগণ বড় লোক। ওদের একটা গাড়ি খোয়া গেলে, আর একটা গাড়ির কেনার সামর্থ্যরয়েছে। কিন্তু মফিজের রিকসা খোয়া গেলে, তাকে মহাজনের বাড়ি অন্তত ছয়টি মাস দাশগিরি করে রিকসার দাম পরিশো করতে হবে। মফিজদের প্রতি এহেন দরদে অনেকের কাছে আমি তদবিরবাজ হয়ে পড়ি। তারপরও তদরিবর করি। কারণ, এই বিভূঁই-বিদেশে (মফিজদের জন্য ঢাকা এমনি) মফিজই তো মফিজদের দেখবে, তাই না?

কয়েকদির আগে এক মফিজের কাছ থেকে এক কাকুতির ফোন পেলাম। এ মফিজ একটি সিএনজি অটোরিকসার মালিক (মফিজদের কত উন্নতী!)। ইনি আরবার অন্য এক মফিজকে তার সিএনজি অটোরিকসা চালাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু মফিজ তো মফিজই। শুধু অটোরিকসা চালক নয়, কোন মফিজ যদি বিমান চালানোর সুযোগ বা যোগ্যতালাভ করে, সেও চূড়ান্ত বিচারে মফিজই থাকবে। যেমন আমি সিনিয়র পুলিশ অফিসার হয়েও একজন নিখাঁদ মফিজ। অপারেশনাল ইউনিটে চাকরি না করলেও প্রায়শই লুঙ্গিপরা মফিজরা আমার অফিসে এসে ভিড় জমায়। আমি আবার কেন্টিন থেকে এসব মফিজদের ডালভাত খাওয়াই।

কয়েক দিন আগে আমার এই আলোচ্য সিএনজি চালক মফিজ মোহাম্মদপুর থেকে এক মহিলাকে তার সিএনজিতে ওঠায়। ঢাকার রাস্তায় যে যানজট, তাতে বিএমডব্লিউ গাড়িতে ভ্রমণ আর রিকসায় ভ্রমণের মধ্যে তেমন কোন তফাৎ নেই। দ্রুতগামী গাড়িও এখানে পথচারীদের চেয়ে শ্লথ গতিতে চলে। আমাদের মফিজ ড্রাইভারের সিএনজিও তাই শ্লথ গতিতে চলছিল। কোথাও তার সিএনজি জামে পড়ে, কোথাও আবার ট্রাফিক সিগন্যালে আটকা থাকে।

এই সুযোগে এক চোর মফিজ ড্রাইভারের সিএনজির পিছনের বাম্পারে উঠে পড়ে। ধীরে ধীরে সে কৌশলী হাতে সিএনজির ছাদের প্লাস্টিকে ফুটো করে হাত ঢুকিয়ে সঙ্গোপনে মহিলা যাত্রীর হাতে থাকা ব্যাগটি টান দিয়ে উপরে তোলে। মহিলা বুঝতেই পারলেন না, সব দিক বন্ধ থাকার পরও তার ভ্যানিটি ব্যাগটি আকাশে উঠল ক্যামনে। কোন কিছু বোঝার আগেই চোর তার সব কিছু নিয়ে চম্পট দেয়। মহিলা চোর! চোর!! বলে চিৎকার দিবারও সুযোগ পেলেন না।

সবাই জানেন যে ঢাকার সিএজি অটোরিকসাগুলোর দরোজাগুলো লোহার সরু রডের জালি দিয়ে এমনভাবে সুরক্ষিত থাকে যে সামনে থেকে কোন যাত্রীর জিনিসপত্র কেউ ছিনতাই করার সুযোগ পায়না। চালকের দুই পাশের ফাঁকা স্থানগুলোও একইভাবে সুরক্ষিত থাকে যাতে ছিনতাইকারীগণ চালকে পরাস্ত করে ছিএনজি ছিনতাই করতে না পারে।

কিন্তু অভিনব চিন্তার চোরগণ যে সিএনজির ছাদের প্লাস্টিক বা রেক্সিন কেটে আকাশ পথে যাত্রীদের ছিনতাই করবে, এটা কে কল্পনা করত? ঘটনাটি জানার আগে আমি নিজেও এটা জানতাম না; বিশ্বাসও করতাম না। কিন্তু অপরাধ জগতে ক্রমাগত নিত্যনতুন আইডিয়া তৈরি হচ্ছে। অপরাধের এক পথ বন্ধ হলে পথ খুলে যাচ্ছে অন্যপথ। জলপথ, স্থলপথ, জানালপথ, বাথরুমের ভেন্টিলেটর পথ এবং সবশেষে সিএনজি অটোরিকসার আকাশপথ।

সিএনজির যাত্রী মহিলা চুরির কবলে পড়ার পর যার পর নেই বিরক্ত হলেন। বাস থেকে ছিনতাই হলে বাসের ড্রাইভার-কন্ট্রাকটরদের কেউ ছিনতাইকারী বলেন না। ভাড়ার বাসায় চুরি বা ডাকাতির ঘটনা ঘটলে বাসার মালিককে কেউ ডাকাতের সহযোগী বলেন না । কিন্তু রিকসা বা সিএনজিতে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে যাত্রীগণ নিরীহ-নিঃস্ব গায়েগতরে খাটা চালকদের অবলিলায় চোর/ছিনতাইকারী বা তাদের সহযোগী বলে ধরে নেন; তাদের অকথ্য ভাষা গালি দেন, ডানবাম দুই হাতেই গালেমুখে চড়থাপ্পড় মারতে থাকেন।

এক্ষেত্রেও তাই হল। সিএনজির যাত্রী মফিজ ড্রাইভারকে চোরের সহযোগী ভাবলেন। তার যুক্তি ছিল, এ মফিজ সিএনজি ধীরে ধীরে চালিয়েছেন যাতে চোরগণ বাম্পারে উঠে ছাদ ফুটো করে তার জিনিসপত্র ছিনতাই বা চুরি করতে পারে। তাই সে হয় চোর, নয়তো চোরের সহযোগী। মহিলা শুধু অভিযোগেই সীমাবদ্ধ থাকলেন না, তিনি রীতিমত চেঁচামেচি করে পুলিশ ডাকলেন। পুলিশ দিয়ে মফিজ ড্রাইভারকে গ্রেফতার করালেন, মামলা করে মফিজ ড্রাইভারকে হাজতে পাঠালেন। আর পুলিশ মফিজের সাথে সাথে তার সিএনজি অটোরিকসাটিও জব্দ করল। কারণ, সিএনজি দিয়েই তো চুরিটি সংঘটিত হয়েছিল।

আমি এ মামলার তদন্তকারী অফিসারের সাথে কথা বললাম। ছাদ ফুটো করে চলন্ত সিএনজিতে চুরির ঘটনা তদন্তকারী অফিসারের কাছেও একটি নতুন ঘটনা। তিনিও তদন্ত নিয়ে বিপদে আছেন। আমি পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করলাম, সিএনজির ভিতর যাত্রী মহিলা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন সিএনজির ড্রাইভারও। কারণ সিএনজি যখন চলে, তখন এটা বাস-মিনি-মাইক্রোর মতো সব দিক থেকে বন্ধই থাকে। কেউ যদি পিছন দিক থেকে সঙ্গোপনে বাম্পারে উঠে ছাদ ফুটো করে, সেটা যাত্রী মহিলা যেমন দেখেননি, তেমনি মফিজ ড্রাইভারও দেখেননি। তাই দেখতে না পাওয়াটা যদি দোষের হয়, তাহলে সেই দোষ তো যাত্রী মহিলারও। তাই শুধু মফিজ ড্রাইভারতে দোষারোপ করা হবে কেন?

আমার বিশ্বাস হল, উত্তরাঞ্চলের মফিজগণ ঢাকায় এসে গায়েগতরে খাটার ঐতিহ্য তৈরি করলেও এখনও তারা চুরি, ছিনতাই বা প্রতারণার ঐতিহ্য তৈরি করতে পারেননি। এখনও ঢাকার রাজপথে সংঘটিত অপরাধগুলোর সিংহভাগের জন্য দায়ী দেশের অন্য অঞ্চলের চালাক-চতুর-বুদ্ধিমান-জ্ঞানী ব্যক্তিরা; মফিজরা নন। তাই, এ মফিজের মামলাটা তিনি যেন একটু সহানুভূতির সাথে তদন্ত করেন। তিনি যেন আমার উত্তরাঞ্চলের মফিজটিকে ন্যায় বিচার পাওয়ার পথটা খোলা রাখেন। দারোগা আমাকে কথা দিয়েছেন, তিনি বিষয়টা মানবিকগুণ দিয়েই বিবেচনা করবেন। সাধ্যমত চেষ্টা করবেন আসল চোরকে খুঁজে বের করার জন্য। আর গোপনে গেপানে বলি, এই পুলিশের দারোগাও কিন্তু মফিজ। বিদেশ-বিভূঁইয়ে মফিজই তো মফিজকে দেখবে, তাই না?(১৭ ডিসেম্বর,২০১৪)