কোন পাগলে বলে খুনের হার আশঙ্কাজনক?

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 25 May 2015, 05:36 PM
Updated : 25 May 2015, 05:36 PM

আমাদের দেশের আমজনতার সাথে পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টারদের তেমন কোন পার্থক্য আমি দেখিনা। একই তো সাংবাদিকতা করার জন্য বিদ্যা লাগেনা, তারপর আবার ক্রাইম রিপোর্টার হতে গেলে রিপোটিংএর ব্যাকরণও হয়তো মানতে হয়না। মিথ্যা না হলেও অর্ধসত্য বা আমসত্য দিয়ে একটি গোয়েবলীয় রচনা তৈরি করতে পারলেই এদেশে যে কেউ হয়তো ক্রাইম রিপোর্টার হতে পারেন। তবে মানসম্মত ক্রাইম রিপোর্টার যে নেই তা আমি বলবনা। কারণ, সম্পূর্ণ মেধাহীন হলে কোন পত্রিকাই বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনা। তবে মেধার সংখ্যা অত্যল্প।

আমাদের ক্রাইম রিপোর্টারগণ আমজনতার মতো অপরাধ ও সাধারণ ঘটনার মধ্যে তেমন পার্থক্য করতে পারেননা। তাদের যেমন দ-বিধির জ্ঞান নেই, তেমনি জ্ঞান নেই সাধারণ অপরাধ বিজ্ঞানেরও। কোনটা অপরাধ আর কোনটা অপরাধ নয়, তার ফায়সালা করতেই হয়তো তারা কলম ভেঙ্গে ফেলেন। এ যখন অবস্থা তখন অপরাধের হ্রাস-বৃদ্ধি সম্পর্কে তাদের বিশ্লেষণ আর কতটুকু হবে?

সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকায় খুন-জখম নিয়ে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল, 'অনেক মৃত্যুর ঘটনাই পুলিশের হিসাবে স্থান পায়নি'। প্রতিবেদক বাংলাদেশে খুনের অপরাধ বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে মন্তব্য করেছেন, 'রাজনৈতিক দ্বন্দ্বই হোক বা ব্যক্তিগত ক্রোধ গত পাঁচ বছরে দেশে খুনের হার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে'।

লেখক  কেবল ২০১৫ সালের প্রথম  চার মাসের একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরেই গত পাঁচ বছরের অপরাধ প্রবণতা নিয়ে একটা চূড়ান্ত মন্তব্য করেছেন। তিনি যদি গত পাঁচ বছরের অপরাধ পরিসংখ্যানও তুলে ধরতেন, তাহালে হয়তো এমন সিন্ধান্ত টানতে পারতেন না। বলাবাহুল্য, গত পাঁচ বছরের অপরাধ পরিসংখ্যান পুলিশের ওয়েব সাইটেই দেয়া আছে।

এবার আসুন আমরা প্রকৃত সত্য তুলে ধরি। আমরা যদি ২০০৫-২০১৪ পর্যন্ত মোট ১০ বছরের খুনের মামলাগুলোর পরিসংখ্যান গ্রহণ করি তবে দেখব এ দশ বছরে গড় খুনের মামলা ছিল প্রতি বছর ৪,০৯২। এ গুলো অবশ্য মামলার হিসেব; খুনের সংখ্যার নয়। একটি মামলায় একাধীক ব্যক্তি নিহত হতে পারে। তাই মোট খুন এর চেয়ে বেশি। যেহেতু বাংলাদেশ পুলিশ খুনের সংখ্যার কোন পরিসংখ্যান নিয়মিতভাবে সংরক্ষণ করে না, তাই আমরা খুনের মামলাকেই  মানদণ্ড হিসেবে ধরছি।

হত্যা মামলার পরিসংখ্যান(২০০৫-২০১৪)

বছরমোট হত্যা মামলা
20053592
20064166
20073863
20084099
20094219
20103988
20113966
20124114
20134393
20144514

দশ বছরের হিসেবে দেখব খুনের মামলার সংখ্যা ২০০৫ সালে সর্বনিম্ন ৩,৫৯২টি ও সর্বোচ্চ ২০১৪ সালে ছিল ৪,৫১৪টি। ২০১২-২০১৪ সাল পর্যন্ত খুনের মামলার সংখ্যা চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজারের মধ্যেই উঠা নামা করছে।  এ সময় রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য অনেক বেশি খুনের মামলা রুজু হয়েছিল বলে যে কেউ স্বীকার করবেন। অন্যদিকে ২০০৬ সালেও কিন্তু দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। তাই সে বছরেও খুনের মামলার সংখ্যা ছিল ৪,১৬৬টি।

প্রতিবেদন মতে, গত পাঁচ বছরে দেশে খুনের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যা পরিসংখ্যান অনুসারে একেবারেই অসত্য। আর যদি ধরেও নেই যে খুনের হার বেড়েছে। তবে এ হার এত বেশি নয় যে তা ২০০৬, ২০০৮ ও ২০০৯ সালের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। আমি যদি ২০০৯ সালের সাথে ২০১৪ সালের তুলনা করি, তাহলে দেখব গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ২৯৫টি খুনের মামলা বৃদ্ধি পেয়েছে।

যদি বাংলাদেশে পনের কোটি মানুষের বাস ধরে নেই এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হিসেবে প্রতি এক লাখ লোকের মধ্যে খুনের মামলার হিসেব করি, তাহলে দেখব বাংলাদেশে প্রতি লাখে এখানে খুনের হার ২.৭ জনের কিছু বেশি। ২০০৬ সালের জনসংখ্যা যদি ১৪ কোট ধরি, তাহলে প্রতি এক লাখে হত্যা মামলার সংখ্যা ছিল ২.৯৭। আর ২০১৪ সালের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ধরলে প্রতি এক লাখে হত্যা মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩.০। অর্থাৎ ২০০৬ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে প্রতি লাখে খুনের মামলা বেড়েছে ০.০৩।

একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই খুনের সংখ্যা এবং এ বৃদ্ধির হার যে আশঙ্কাজনক বলা যায়না বিষয়টিকে বৈশ্বিক পেক্ষাপটে বিবেচনা করলে আরো স্পষ্ট হবে। বিশ্বে মোট খুনের হার প্রতি একলাখ জনসংখ্যার বিপরীতে ৬.২ জন। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে  এ হার হল ৪.৭। এশিয়ার গড় ২.৯। ভারতে ৩.৫। বাংলাদেশে গড় হার হল ২.৭। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশে খুনের হার যেমন আসঙ্কাজনক নয়, তেমনি তা আশঙ্কা জনক হারে বাড়ছেও না। পত্র-পত্রিকায় যে প্রতিবেদনগুলো দেখি সেগুলো মূলত পূর্সংস্কারজাত; গবেষণা বা পরিংখ্যানজাত নয়। তাই আমাদের ক্রাইম রিপোর্ারগণ আতঙ্ক ছড়াতে সাফল্যলাভ করলেও ক্রাইম রিপোর্ারের মানদণ্ডে অত্যন্ত অনাড়ি বৈকি?