সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মার্কিনযুদ্ধ ও ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসি কার্যক্রম

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 28 June 2015, 06:54 PM
Updated : 28 June 2015, 06:54 PM

২৭ জুন,২০১৫ তারিখ শুক্রবার প্রায় একই সময়ে মধ্য প্রাচ্য ও ভূমধ্য সাগরের উপকুলের তিনটি দেশে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এদের মধ্যে মধ্য প্রাচ্যের কুয়েত সিটিতে একটি সিয়া সমজিদে আত্মঘাতি হামলায় মারা গেছে ২৭ জন। তিউনিশিয়ায় একটি পর্যটন হোটেলে সন্ত্রাসী হামলায় মারা গেছে ৩৮জন। ফ্রান্সে একটি মার্কিন মালিকানাধীন রাসায়নিক কারখানার ফটকের কাছেই সন্ত্রাসীগণ একটি বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে কারখানার কেউ হতাহত না হলেও ঘটনাস্থলে একটি গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়[]।

টিউনিশিয়া ও কুয়েত সিটির বোমা বিস্ফোরণের দায়দায়িত্ব ইতোমধ্যেই আইএস নামে জঙ্গিগোষ্ঠী দাবি করেছে। তবে ফ্রান্সের ঘটনায় এখনও কেউ দায় স্বীকার করেনি। তবে ঘটনাগুলো একই দিনে পরপর বা একই সময়ে সংঘটিত হওয়ায় ধারণা করা যায়, এগুলো মূলত একই গোষ্ঠীর কিংবা একই মতাদর্শের সহযোগী গোষ্ঠীর নাশকতামূলক কাজ।

সারা বিশ্বে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বা বিখ্যাত ৯/১১ ঘটনার পরপরই আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের একটি অস্পষ্ট যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। এ যুদ্ধ অস্পষ্ট এ জন্য যে তারা কোন ব্যক্তি, রাষ্ট্র কিংবা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়, তারা যুদ্ধ করছে একটি বহ্যিক অবয়বহীন ধারণা বা প্রত্যয়ের বিরুদ্ধে। সাদামাটায় বললে এ যু্দ্ধ হচ্ছে একটি আদর্শের বিরুদ্ধে। তাই ব্যক্তি, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান গোষ্ঠী নয়, বরং একটি আদর্শকে নির্মূল করাই হবে তাদের চূড়ান্ত বিজয়।
বলাবাহুল্য, গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ শুরু করেছিল মাদক দ্রব্যের চোরাচালানের বিরুদ্ধে । তথাকথিত প্রহিবিশনকালে যুক্তরাষ্ট্রে সংঘবদ্ধ অপরাধী তথা মাফিয়াদের দ্রুত বিকাশ ঘটে। তবে  ১৯৫৭ সালের পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই স্বীকারই করত না যে সেদেশে মাফিয়া চক্রের তৎপরতা রয়েছে। ১৯৫৭ সালে নিউইয়র্কের আপানানিনে মাফিয়াদের একটি সম্মেলনে মাফিয়া বসরা ধরা পড়লে এফবিআইএর নড়ে চড়ে বসে। এফবিআইয়ের নিবিড় অভিযান, নীতি নির্ধারকদের কিছু কঠোর আইন তৈরি ও তা প্রয়োগের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে মাফিয়াদের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে আসে। একই সময় যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া, বলিভিয়া পেররু ও মেক্সিকো থেকে আসা মাদকের বিরুদ্ধে ব্যয়বহুল অভিযান পরিচালনা করে। তবে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রনে এলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল কালো বাজারে মাদক দ্রব্যের অনুপ্রবেশ এখনও বন্ধ হয়নি।

গত শতাব্দীর ষাট থেকে এর দশকর শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ছিল মূলত সেভিয়েত বা কমিউনিমের বিরুদ্ধে। জার্মানির বার্লিন প্রাচীর ভাঙ্গনের মাধ্যমে স্নায়ূ যুদ্ধের অবসান শুরু হয়। বার্লিন ওয়ালের হাত ধরে খণ্ড বিখণ্ড হয় মহাপরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়ানো রাসিয়া আর হোক পরাশক্তির জৌলুস আর ধরে রাখতে পারেনি। তাই স্নায়ূ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিতভাবেই বিজয়ী হয়।

চলতি শতাব্দীতে আমেরিকা যুদ্ধ শুরু করেছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। এ সন্ত্রাসবাদ যে ইসলামী সন্ত্রাসবাদকে বোঝান হয়। এটা বলার অপেক্ষা রােেখ না। কমিউনিজমের বিরুদ্ধে আলকায়েদা পুষতে গিয়ে  মার্কিন প্রশাসন শেষ পর্যন্ত আলকায়দার খপ্পরে পড়ে যায়। মনে করা হয়েছিল, আলকায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করলে হয়ত বিশ্বব্যপী ইসলামী সন্ত্রাসী তৎপরতা দূর হবে। কিন্তু সেটা আর হল কই ?

ছলে বলে কৌশলে মারাত্বক বিধ্বংসী অস্ত্রের মজুদের অযুহাদ দেখিয়ে তারা মধ্য প্রাচ্যের ছাদ্দামকে সরিয়ে দিল। লিবিয়া থেকে গাদ্দাফীকেও নিপাত্ত করে দিল। কিন্তু এত কিছু পরেও মধ্য প্রাচ্যে শান্তি আসছে না। বরং মধ্য প্রাচ্যে নতুন করে আবার আই এস নামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। আইএস এর বিরুদ্ধে শত অভিযান পরিচালনা করেও তাদের দমন তো দূরের কথা তাদের বিস্তৃতি রোধ করা যাচ্ছে না। এই আই এস এর যোদ্ধাদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের জঙ্গিরাও নানা ভাবে ফন্দিফিকির করছে। এমন কি ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যেও কেউ কেউ নাকি আই এস জঙ্গিদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য ঘর ছাড়া হচ্ছে।

স্নায়ূ যুদ্ধের অবসানের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিহ্নিত শত্রুর ঘাটতিতে ভুগছে। তাই তারা এখন অজানা শত্রুর খোঁজে বিশ্বব্যাপী একের পর এাক অভিযান চালিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় লাভ করা গেলেও অনির্দিষ্ট বা আদর্শিক শত্রুর বিরুদ্ধে জয় লাভ করা সম্ভব হয় না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্য প্রাচ্যে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি, ইসলারইলকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পারমানবিক অস্ত্রে সজ্জিত করা, ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যূত করা এবং হাল আমলে আলকায়েদা গোষ্ঠীকে গোটা মুসলিম ধর্মের প্রতিনিধি মনে করে আকারে ঈঙ্গিতে ও পরোক্ষ কর্মের মাধ্যমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট গড় পড়তা সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও অনেকটাই অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছে।  আর এই সুযোগ নিয়েছে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো। ইসলাম আর সন্ত্রাসবাদ যে এক নয় এ বিষয়টি জানলেও মার্কিন মদদপুষ্ট বুদ্ধিজীবিগণ যেন আমলেই নেন না। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে কিংবা তার বাইরে এখন পর্যন্ত  যত সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই অমুসলিম চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো  দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও ইসলাম বিদ্বেষী পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমগুলো মুসলিম চরমপন্থীদের হামলাগুলোকেই প্রচারের শীর্ষে নিয়ে এসেছে। আর মার্কিন নীতি নির্ধারকগণ সেই প্রচারে বেশি গুরুত্ব দিয়ে গোটা মুসলিম বিশ্বকে তাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।

২৭ জুনের তিন মহাদেশের তিনটি দেশে বোমা হামলার ঘটনাগুলো যদিও আপাতত দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হবে, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, এগুলো মূলত একই সূত্রে গাঁথা। আবার এগুলোকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের হামলা বলেও মনে হবে। কিন্তু এ মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের হামলার মূলও নিহিত আছে মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মার্কিন নীতিতে।

এখানে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উল্লেখ না করেই পারছি না। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করার সময় মার্কিন নেতৃত্বোধীন বহুজাতিক বাহিনীর অংশ হয়ে ইরাক যুদ্ধে অংশ নেয়া এক প্যারা মিলিটারি  সহকর্মীর সাথে মধ্য প্রাচ্য নিয়ে ঘরোয়া আড্ডায় অংশ নিয়েছিলাম। সেই সময় আমার সেই ইউএন সহকর্মী প্রশ্ন করেছিলেন, তোমরা তো বল ইরাকে হাজার হাজার মানুষ নিহত হওয়ার জন্য আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী দায়ি। কিন্তু বহুজাতিক বাহিনী চলে আসার পরে সেখানে তো সহিংসতার মাত্রা বেড়েছে। আমার ইউএন সহকর্মী বোঝাতে চেয়েছিলেন যে ইরাক বা মধ্যপ্রাচ্যের  সহিংসতার জন্য মার্কিনিরা দায়ি নয়। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনকে তছনছ করে দিয়ে, বিরুদ্ধ শক্তিগুলোকে পরিকল্পিতভাবে উসকানী দিয়ে মার্কিনিরা যে সহিংসতার বীজ মধ্যপ্রাচ্যে বপন করেছে, তার ডালপালাগুলো যে ইরাক থেকে মার্কিনিরা চলে যাওয়ার পর বিস্তার করা শুরু করেছে, এ কথা তাকে বোঝাবে কে?

যাহোক, আমেরিকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যে সন্ত্রাস ঠেকাতে পারেনি এবং এ সন্ত্রাস দ্রুত ডালপালা বৃদ্ধি করছে তা চলতি ঘটনাগুলোর সাধারণ দর্শকগণই বুঝতে পারবেন। গত শতাব্দীর নব্বই এর দশকে ইরাকি জুজু আমেরিকান স্বার্থের জন্য যতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, বর্তমানে সেই ঝুঁকি যে কোন অংশে কমেছে তা বিশ্বব্যাপী ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে। হয়তো নিরাপত্তার ব্যাপারে অধিক সচেতনতা ও অধিক পরিমাণ ব্যয়ের জন্য মার্কিনিদের হতাহতের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম, কিন্তু এ সংখ্যা কতদিন আর কম থাকবে তাই দেখার বিষয়। (২৮ জুন, ২০১৫)