ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিটি পুলিশিং:কোবান মডেল অনুসরণ সঠিক পদক্ষেপ

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 8 Sept 2015, 06:29 PM
Updated : 8 Sept 2015, 06:29 PM

কমিউনিটি পুলিশিং জগতে জাপানের কোবান সিস্টেম একটি অনন্য নাম।১৮৭৪ সালে টোকিও মেট্রোপলিটন পুলিশের জন্ম থেকেই তারা কোবান সিস্টেম অনুসরণ করছে।১৮৮৮ সালে মেট্রোপলিটনের কোবানকে তারা গ্রাম এলাকা পর্যন্ত প্রসারিত করে। শহরের কোবান গ্রামে গিয়ে সুজাইৎসু নাম ধারণ করে।

কমিউনিটি পুলিশিং এর যে শ্লোগান আমরা বাংলাদেশে ব্যবহার করি সেই পুলিশিং চালু হয়েছিল ব্রিটেনে ১৮২৯ সালে। এর প্রায় ৪৫ বছর পরে জাপানে চালু হওয়া কোবান মডেল রবার্ট পিলের কন্সেপ্ট ছাড়াই বেড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশদের সাথে আমেরিকার আদিকাল থেকেই যোগাযোগ। তাই পিলের পুলিশিং আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছিল।

কিন্তু জাপানের সাথে আমেরিকা বা অন্যান্য দেশগুলোর ঔপনিবশিক যোগাযোগ না থাকায় জাপানের কোবান সিস্টেমের কমিউনিটি পুলিশিং শুধ জাপানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা বহির্বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

আমার মতে পৃথিবীতে আধুনিক ধরনের কমিউনিটি পুলিশিং এর তিনটি মডেল আছে, যেগুলো হল:
১. পাশ্চাত্যের কমিউনিটি পুলিশিং ফোরাম বা সিপিএফ মডেল,
২. উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডিস্ট্রিক পুলিশিং পার্টনারসিপ বা ডিপিপি মডেল এবং
৩. জাপানের কোবান মডেল।

প্রাক্তন ব্রিটিশ কলোনিগুলো সাধারণভাবে সিপিএফ মডেল অনুসরণ করে। কিন্তু জাপানের কোবান মডেল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার লাভ করেছে। আরও একটি মজার ব্যাপার হল জাপান তাদের মডেল রপ্তানী করছে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলোতে। কারণ এসব দেশের দূরত্ব সাগর পথে জাপানের বেশ কাছাকাছি। ব্রাজিল, পেরু, হন্ডুরাস প্রভৃতি দেশে জাপানের কোবান সিস্টেম কাজ করছে।

সম্ভবত জাপানের কোবান মডেল সর্ব প্রথম গ্রহণ করে সিংগাপুর পুলিশ। ১৯৮৪ সালে জাপানের কোবান মডেলে সিংগাপুর নেইবারহুড পুলিশ পোস্ট এনপিপি চালু করে। পরে ১৯৯৭ সালে তারা সেটাকে পর্যালোচনা করে নেইবারহুল পুলিশ সেন্টার বা এনপিসি চালু করে।

কিন্তু ইন্দোনেশিয়ায় কোবান পুলিশিং এর যাত্রা শুরু হয় ২০০২ সাল থেকে। তারা কোবানের স্টাইলে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু স্থাপনা তৈরি করেছে। আর জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি বা জাইকা বহির্বিশ্বে কোবান পুলিশিং চালুর জন্য সহায়তা দিয়ে থাকে।

আজ আমাদের সেসনের প্রথমেই ইন্দোনেশিয়ায় কোবান পুলিশিং এর যাত্রা নিয়ে লেকচার দিলেন জনাব নাওকি মারুইয়ামা। জনাব মারুইয়ামা জাপানের জাতীয় পুলিশ বাহিনীর একজন এসিস্টেন্ট কমিশনার। জাপান পুলিশের সিনিয়র পদে প্রবেশ-দ্বার হল সহকারী ইন্সপেক্টর। অনেক পদ পাড়ি দিয়ে তাকে এসিস্টেন্ট কমিশনার হতে হয়েছে। আর পেশাগত জীবনের উৎকর্ষের জন্য তিনি জাইকার উপদেষ্টা হয়ে ইন্দোনেশিয়ায় কোবান সিস্টেম চালুর জন্য প্রেরিত কমিটিতে স্থান করে নিয়েছেন।
গতকালই আমরা ইশিতোবীর কাছ থেকে জাপানের কোবান মডেল সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলাম। যদিও জনাব ইশিতোবির উপস্থাপনা হৃদয়গ্রাহী ছিল না, তবুও তার লেকচার অনেকের জন্যই কোবান বিষয়ে প্রথম ধারণা দিয়েছিল।

কিন্তু জনাব মুরাইয়ামার উপস্থাপনায় আজ অনেক কিছুই পরিষ্কার হল। তবে এটা ঠিক যে জাপানিরা ভাল ইংরেজি বলতে পারেন না। তাই অনেক কিছুই ঠিকভাবে বোঝাতে পারেন না। কিন্তু জনাব মুরাইয়ামার উপস্থাপানয় সংযোজিত স্থির ও ভিডিও চিত্র এবং তথ্যগুলো থেকে আমরা তার ভাষার দুর্বলতা অনেকটাই পুষিয়ে নিয়েছি।

ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ ২০০২ সালের পূর্বে সেনাবাহিনীর অংশ ছিল। আর সেনাবাহিনী যদি পুলিশিং ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে তাহলে পরিস্থিতি হয়তো দ্রুত উন্নত হয়। কিন্তু সেটা কোনক্রমেই স্থায়ী হয় না। আর সেনাবাহিনীর পুলিশিং সাধারণত কঠিন, জটিল ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির পুলিশিং হয়ে থাকে যা আধুনিক সভ্য জগত মেনে নিতে পারে না। স্বাভাবিকভাবে এটা মেনে নিতে পারেনি ইন্দোনেশিয়ার জনগণও। তাই প্রেসিডেন্ট সুহার্তোর মৃত্যুর পর পুলিশকে সেনাবাহিনী থেকে পৃথক করা হয়।

কিন্তু একটি পুলিশ ফোর্স সেনাবাহিনীর অংশ হয়ে কাজ করলে তার ভিতরে সেনাবাহিনীর আচরণ তথা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি স্বাভাবিক কারণেই আত্মীকৃত হয়। তারা জনগণের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে তো দূরের কথা, জনগণের স্বাভাবিক আচরণও সহ্য করতে অপারগ হয়।

এই প্রেক্ষাপটে জাপান ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিটি পুলিশিং বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে। কমিউনিটি পুলিশিং এর প্রথম পদক্ষেপই ছিল জনগণের আস্থা অর্জন করা। জনাব মারুইয়ামা ও ইন্দোনেশিয়ান পুলিশ অফিসার রিজালসহ আরো প্রায় তিনজন পুলিশ অফিসারদের সাথে কথা বলে, তাদের কাছে প্রশ্ন করে এ সম্পর্কে যে ধারণা পেলাম, তাতে মনে হল ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ বাহিনী সেনাবাহিনী থেকে আলাদা হয়ে যে জনগণের কাছে তিষ্টিতে পেরেছে সেটা এই কমিউনিটি পুলিশিং বা কোবান পুলিশিং এর জন্যই। তারা মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে তাদের সাথে ব্যক্তিগত ও দলগত আলোচনা ও অনেকগুলো দৃশ্যমান মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে জনগনের সকল স্তরেই প্রবেশের চেষ্টা করেছে।

প্রত্যেক সমাজেরই একটি নিজস্ব প্রেক্ষাপট রয়েছে। আমাদের বাংলাদেশের সমাজ ইন্দোনেশিয়ার সমাজের মতো নয়। আবার ইন্দোনেশিয়াও জাপান কিংবা সিংগাপুরের মতো নয়। তবে পুলিশিং এর মৌল বিষয়গুলো সকল স্থানেই মূলত একই রকম। আর যেহেতু কমিউনিটি পুলিশিং ও একটিই মাত্র দর্শন থেকে উদ্ভূত হয়েছে তাই এর মৌলিক বিষয়গুলোও একই।

কমিউনিটির মধ্যে গিয়ে, কমিউনিটির সদস্যদের সক্রিয় সাহায্য, সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে কমিউনিটির সমস্যা সমাধান করাই হল কমিউনিটি পুলিশিং দর্শনের মূল কথা। ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ ঠিক এ কাজটিই করছে। তবে তারা পাশ্চাত্যের সিপিএফ মডেল নয়, কিংবা উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডিপিপি মডেল নয়, বেছে নিয়েছে জাপানের কোবান মডেল।

জাপান সমুদ্র পথে ইন্দোনেশিয়ার নিকটতম প্রতিবেশী উভয় দেশই সমুদ্রের ভিতর শত শত দ্বীপ নিয়ে গঠিত। তাদের মধ্যে নানা দিক দিয়ে ভিন্নতা থাকলেও মিলও রয়েছে অনেক দিক দিয়ে। তাই ইন্দোনেশিয়ানগণ জাপানের কোবান মডেলের পুলিশিং ধারণা গ্রহণ করে উত্তম কাজটিই করেছে বলে আমি মনে করি।  (৮ সেপ্টেম্বর,২০১৫/ সিংগাপুর সিটি)