নাইট সিটি টুর কর্মসূচির শুরুতেই আমাদের গাইড এলিশিয়া সিংগাপুরের জীবনযাত্রা ও সমাজ ব্যবস্থার কিছুটা বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তার মতে সিংগাপুরের তিনটি বিলাশ বস্তুর অন্যতম হল গাড়ি। এ শহরে শুধু বড় লোক হলেই গাড়ি রাখা যায় না- হতে হয় অত্যধিক বড় লোক বা টাকার কুমির।
সিংগাপুর একটি ছোট শহর মাত্র। কিন্তু ছোট হলেও এর জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক জনবহুল দেশের চেয়েও বেশি। মাত্র ৭১৮.৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ দেশে প্রায় ৬২ লাখ লোকের বাস। অর্থাৎ প্রতি বর্গ কিলোমিটারে এদেশে বসবাস করে ৭,৬১৫ জন মানুষ। বাংলাদেশের চেয়েও এ ঘনত্ব সাত গুণেরও বেশি।
তাই এদেশের রাস্তাঘাটে যানবাহন সীমিত রাখার প্রচেষ্টা চলে। এ প্রচেষ্টা অংশ হিসেবে প্রাইভেট কারের চেয়ে পাবলিক বা গণ পরিবহণে জনগণের চলাচলের জন্য উৎসাহিত করা হয়। দেশের পরিবহণ ব্যবস্থাটির প্রায় পুরোটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ও ব্যবস্থাধীন। শহরের যে কোন স্থানে এমআরটি(মাস রেপিড ট্রান্সপোর্ট) এ যাতায়াত করা যায়। আছে বাস সার্ভিস। দুমিনিট, তিন মিনিট পরপর বাস পাওয়া যায় গন্থব্য স্থলের উদ্দেশ্যে। তারপরও আছে টেক্সিক্যাব।
তারপরও কেউ যদি প্রাইভেট কারের মালিক হতে হয়, তাকে গুণতে হয় প্রচুর ডলার। অন্যান্য যে কোন দেশের চেয়ে সিংগাপুরে প্রাইভেট কারের দাম বেশি। গাড়ির বাজার মূল্যের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি শুল্ক তাদের পরিশোধ করতে হয়। সিংগাপুরের রাস্তায় কোন পুরাতন গাড়ি চলতে পারবে না। কিনতে হবে চক চকে আনকোরা নতুন গাড়ি। কিন্তু এ গাড়ি সিংগাপুরের রাস্তায় মাত্র ১২ বছর চলতে পারবে। বার পছর পরেও কেউ যদি তার গাটিটি রাস্তায় নামাতে চায়, তবে হয় তাকে নতুন করে প্রাথিকার পত্র কিনতে হবে, নয়তো এমন বেশি কর পরিশোধ করতে হবে যা নতুন গাড়ি কেনার চেয়ে বেশি ব্যয় বহুল হবে।
প্রাধিকারবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলার প্রশ্নও উঠে না। তাই ১২ বছরের মাথায় হয় মালিক এটা দেশের বাইরে বিক্রয় করে দিবে, নয়তো ভেঙ্গে চুরে অন্যকোন কাজে লাগাবে। রাস্তায় ১২ বছরের বেশি পুরাতন গাড়ি বের করা হলে তা পুলিশ ধরে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পাঠাবে। এটা কাটাছেঁড়া করা হবে এবং মালিকের কাছ থেকে কাটা ছেঁড়ার দামসহ জরিমানা আদায় করা হবে।
নতুন গাড়ি কেনার পর রাস্তায় নামাতে হলে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি প্রাধিকারের সনদ(সার্টিফিকেট অব ইনটাইটেলমেন্ট) পত্র সংগ্রহ করতে হবে। এ সিওই সংগ্রহ করতে সরকারকে যে অংকের ফি দিতে হয় তা দিয়ে যুক্ত রাষ্ট্রের বাজারে একটি বিলাশ বহুল ব্রান্ডের গাড়ি(যেমন পোরস বক্সটার) কেনা সম্ভব।
বিষয়টি নিয়ে কথা হল আমাদের লিয়াজোঁ অফিসার রানির সাথেও। রানি মনে করেন, রাস্তায় গাড়ি সীমিত রাখার জন্য এ ধরনের নিয়ম আরোপ যথার্থ। তবে তিনি মনে করেন, প্রথম গাড়ি কেনার জন্য এক কর কমানো উচিৎ। কেউ দ্বিতীয় গাড়ি কিনতে চাইলেই তাকে গলাকাটা মূল্য পরিশোধ করা উচিৎ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল এখানে গাড়ির প্রাধিকার পত্র সংগ্রহ করতে প্রায় ৭২ হাজার ডলার পরিশোধ করতে হয়। অথচ গাড়ির দাম ৬০/৬২ হাজার ডলার। সব মিলে প্রায় ১ লাখ ২০/৩০ হাজার ডলার লাগে গাড়ি কিনতে। তার মানে বাংলাদেশি টাকায় গাড়ির মূল্য হবে পঞ্চাশ থেকে ৬০ লাখ টাকার মতো। অথচ আমাদের দেশে ৭/৮ লাখ টাকা দিয়ে কি চক চকে গাড়িই হাঁকাচ্ছেন যে কেউ।
বাংলাদেশে প্রতি দিনই মানুষের চেয়ে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। আমরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সফল হচ্ছি না। আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও তা সহজতর করা অবশ্যই দরকার। কিন্তু প্রত্যেকটি শহরে ও মহাসড়কে অত্যধিক গাড়ির চাপে যে যানজট হচ্ছে এবং এ জানজটের ফলে আমাদের যে কর্মগণ্টা নষ্ট হচ্ছে তার যোগবিয়োগ কষলে গাড়ি নিয়ন্ত্রণের বিকল্প পাওয়া যাবে না। তাই প্রাইভেট কার ক্রয় ও পরিচালনার জন্য অবশ্যই কড়াকড়ি আরোপ করা উচিৎ। বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার ঘনত্ব সম্বলিত শহরে সিংগাপুর যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা যে কোন দেশের পরিকল্পনাবিদ ও আইন প্রয়োগকারীদের জন্য অনসরণীয় ও অনুরকরণীয় হতে পারে।
(১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫)