পাগলার হাটে পাবলিক পাঠাগার ও আমার কিছু পরামর্শ

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 2 Oct 2015, 08:06 AM
Updated : 2 Oct 2015, 08:06 AM

সম্প্রতি আমার এলাকা পাগলার হাট সংলগ্ন গ্রামের যুবকগণ একটি গণ-গ্রস্থাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। আমি তাদের উদ্যোগকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে তাদের প্রথম বৈঠকে উপস্থিত হয়েছিলাম। সেখানে একটি রেজুলিউশন লিখা হয়। আমি সেই রেজুলিউশনে প্রথম স্বাক্ষর করে একটি মহতী কাজের সূচনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার ইতিহাসের অংশ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছি।

পাগলার হাট আমাদের এলাকার ছোট একটি বাজার। মিঠাপুকুর সদর থেকে মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে মিঠাপুকুর-সাহেবগঞ্জ (ফুলবাড়ি) আঞ্চলিক মহাসড়কের উপর এটি অবস্থিত। এই বাজারকে কেন্দ্র করে আশে-পাশের কয়েকটি গ্রামের শিক্ষিত ছেলেরা একত্রিত হয়েছে। তারা বাজারের কোন এক স্থানে একটি বসার স্থান চায়। এখানে তারা একটি গ্রন্থাগার স্থপন করে নিজেরা যেমন বই পড়ে তাদের অবসরের বিনোদন ও জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করতে চায়, তেমনে স্থানীয় অন্যান্য ছেলে মেয়েদেরও এর সাথে সম্পৃক্ত করতে চায়।

বিষয়টি আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। কারণ এ যুবকগণ এমন এক সময় এমন একটি উদ্যোগ গ্রহণে এগিয়ে এসেছে যা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। মিঠাপুকুর বাংলাদেশের মধ্যে আয়তনে দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজেলা ও থানা। আয়তনে বৃহৎ হওয়ায় এ উপজেলার আইন-শৃঙ্খলা কাঙ্খিত স্তরে রাখতে পুলিশকে প্রায়শই হিমসিম খেতে হয়।

পাগলার হাট থেকে মাত্র তিন/চার কিমি পশ্চিম দিকে মুসলিম বাজার, তালিমগঞ্জ ইত্যাদি স্থানগুলো ইতোমধ্যেই মাদকে ভেসে যাওয়ার মতো অবস্থায় উপনিত হয়েছে। এ সব স্থানে ফেনসিডিলসহ অন্যান্য মাদক দ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয় ও মজুদ একটি সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে। এলাকার জনগণ যেমন এটাকে অপরাধ মনে করে, তেমনি এ এলাকার জনগণের মধ্যে একটি বড় অংকের মানুষ মাদক ব্যবসাকে রুটিরুজির প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছে।

এমতাবস্থায়, পাগলার হাট সংলগ্ন এলাকার যুবকরা যদি নিজেদের মাদকসহ অন্যান্য ক্ষতিকর বিনোদনের পিছনে না ঘুরে এলাকায় লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার জন্য একত্রিত হয়, এর চেয়ে ইতিবাচক ও গঠনমূলক কার আর কিছুই হতে পারে না।

যুবকদের মধ্যে দ্রুত একটা কিছু করার তাড়ণা প্রবল। তারা চায় তাদের হাটের উপর না হলেও স্থানীয় সূর্যোদ ক্লাবের একটি রুম তাদের দেয়া হোক যেখানে তারা একত্রিত হবে, বই পুস্তক রাখবে এবং পাঠাগার করবে। কিন্তু সূর্যোদয় ক্লাবটির ইতিহাস ভিন্ন। এর পরিচালনা কমিটি ও উদ্দশ্যও ভিন্ন রকম। তাই তাদের ঐ ক্লাবটিতে স্থান করে দেয়া নাও হতে পারে। তাবে তাদের হাটের কাছাকাছি কোন দোকান ধরনের কোন রুম ভাড়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি বিষয়ে যুবকদের নিম্নবর্ণিত পরামর্শ দিলাম।

১. গণ গ্রন্থাগারের একটি সুন্দর নাম দরকার। কিন্তু এ মুহূর্তে এর কোন নাম চূড়ান্ত হয়নি। বিভিন্ন নামের প্রস্তাব করা হতে পারে, তার উপর আলোচনা হতে পারে, প্রস্তাবগুলোর নানা দিক বিবেচনায় আসতে পারে। তাই নামটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরবর্তী কোন মিটিং এ চূড়ান্ত করা যেতে পারে।

২. গ্রন্থাগার পরিচালনার জন্য একটি কার্যকরী কমিটি ও একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। কার্যকরী কমিটিতে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও এলাকায় বসবাস করেন এ ধরনের ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অন্যদিকে উপদেষ্টা কমিটিতে প্রবীণ ব্যক্তিগণ এবং যারা এলাকার বাইরে বসবাস করেন ও এলাকার উন্নয়নে অবদান রাখতে চান তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।

৩. পরিচালনা ও উপদেষ্টা কমিটির বাইরে পাঠাগারের জন্য সাধারণ ও বিশেষ সদস্য গ্রহণ করা যেতে পারে। উভয় প্রকার সদস্যদের জন্য নির্ধারিত হারে মাসিক/বাৎসরিক বা এক কালীন চাঁদা নির্ধারণ করা যেতে পারে। সদস্য সংগ্রহের জন্য জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচার চালান যেতে পারে।

৪. আপাতত অস্থায়ীভাবে কোন একটি দোকান ঘরকে পাঠাগার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ দোকান ঘরটি হতে পারে সদস্য কর্তৃক ব্যক্তিগতভাবে ভাড়া করা ঘরের একটি অংশ কিংবা ভাড়া করা কোন ঘর।

৫. অস্থায়ী পাঠাগার ঘরের জন্য পরিশোধযোগ্য ভাড়া উদ্যেগী ব্যক্তি ও সদস্যদের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।

৬. আমাদের এলাকায় এখনও কোন উল্লেখযোগ্য পাঠক শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। তাই এ পাঠাগারের পরিচালকদের একটি পাঠক শ্রেণি তৈরির প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। এজন্য পাড়ায়-মহল্লায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যপক প্রচার চালাতে হবে।

৭. প্রচারের জন্য বিভিন্ন মাধ্যম ও কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলোর মধ্যে প্রত্যেক পাড়ায়/মহল্লায় রেলি করা, উঠান বৈঠক করা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রচার চালান যেতে পারে।

৮. একটি সাইকেল র‌্যালির আয়োজন করা যেতে পারে। পাঠাগারের পরিচালনা পর্যদসহ সদস্যগণ ও সাধারণ মানুষের সমন্বয়ে ৩০/৪০টি মোটর সাইকেল/বাই সাইকেলে করে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে বই পড়া ও গ্রন্থাগারের সদস্য হওয়ার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।

৯. প্রতি মাসে কিংবা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে পাঠাগারের পক্ষ থেকে বই পড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে। নির্ধারিত সংখ্যক বই নির্দিষ্ট শ্রেণির পাঠকদের মাঝে পড়তে দিয়ে এ বইগুলো থেকে প্রশ্ন বানিয়ে কুইজের আয়োজন করা যেতে পারে। কুইজে বিজয়ীদের সুবিধামত অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত করা যেতে পারে।

১০. বই সংগ্রহ পাঠাগার পরিচালনা কমিটির জন্য একটি বড় কাজ হবে। আপাতত উৎসাহী সদস্যদের কাছ থেকে পুরাতন বই পাঠাগারের জন্য গ্রহণ করা যেতে পারে। অনেক মানুষ আছেন যাদের বাসায় অনেক বই পড়ে আছে। এগুলো অযত্নে অপড়া থেকে যাচ্ছে। পাঠাগারের জন্য এসব বই দান করা যেতে পারে। এলাকার অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি এ ধরনের বই পাঠাগারে দান করতে উৎসাহী হতে পারে। তাদের সাথে মোবাইলে, মেইলে বা ফেইসবুকে যোগাযোগ করা যেতে পারে।

১১. বই কেনার জন্য কিছু অর্থ অনুদান হিসেবে পাওয়া গেলে তা দিয়ে পুরাতন বইয়ের দোকান থেকে পুরাতন বই কমমূল্যে সংগ্রহ করা যেতে পারে। রংপুর শহরেও এখন এ ধরনের বইয়ের দোকান রয়েছে। তাছাড়া ঢাকার নীলক্ষেত মার্কেটেও আসা যেতে পারে।

১২. পাঠাগারটি সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন রেজিস্ট্রি করা যেতে পারে। এর ফলে এটি সরকারি অনুদান পেতে পারে। এ কাজে আমাদের অন্যতম উপদেষ্টা মোশারফ হোসেন সহযোগিতা করতে পারে।

ক্ষুদ্র থেকেই বৃহতের জন্ম হয়। পৃথিবীর সকল মহৎকর্ম সামান্য চিন্তারই সম্প্রসারিত রূপ। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নামে যে বিশাল গ্রন্থাগারটি ঢাকার বাংলামোটরে আকাশচুম্বী অট্রালিকায় মধ্যে স্থান পেয়েছে, যার ভ্রাম্যমাণ শাখাগুলো সারা দেশের বড় বড় শহরগুলোতে পাড়ায় মহল্লায় বই বিতরণ করে আবালবৃদ্ধবণিতাদের জ্ঞানের খোরাক দিয়ে সমাজে আলো ছড়াচ্ছে তারও সূচনা হয়েছিল ক্ষুদ্রতর পরিসরেই। তাই পাগলার হাট বাজারের তরুণদের এ উদ্যোগকে আমি ভবিষ্যতের বড় কোন অর্জনের সূচনা বলেই আমি মনে করব। ( ২ অক্টোবর, ২০১৫)