এক শান্তিরক্ষীর দিনলিপি- কিস্তি-২( অশ্রুসিক্ত বিদায়)

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 10 Dec 2015, 08:00 PM
Updated : 10 Dec 2015, 08:00 PM

০৮ নভেম্বর, ২০১৫
রবিবার।

বাসা থেকে বের হলাম সকাল সাড়ে আটটার দিকে। সাথে নিলাম শুধু স্ত্রী ও দুই বাচ্চাকে। এয়ারপোর্টে রেড এলার্ট চলছে । তাই বেশি লোক যেমন নেয়া যাবে না, তেমনি ইমিগ্রেশন পর্যন্ত প্রকৃত যাত্রী ছাড়া অন্যদের প্রবেশও করা যাবে না। বিমান বন্দরের দায়িত্বে থাকা এপিবিএন এর কমান্ডিং অফিসার এসপি রাসেদুল আলমকে ফোন দিলাম। রাসেদুল তার অফিসে আমার পরিবারকে বসিয়ে রাখার প্রস্তাব দিলেন। আমি ইমিগ্রেশনের দিকে ছুটলাম। একাই। পিছনে বউ-বাচ্চারা। আশা রইল যে জেট এয়ারের বিমানটি আকাশে উড়াল দেয়ার পূর্বে তাদের সাথে আবার দেখা হবে।

ইমিগ্রেশেন সহজেই শেষ হল। আমাদের লাইনে সবাই ছিল পুলিশ অফিসার। আর যাত্রীদের চাপও ছিল তুলনামূলক কম। ইমিগ্রেশন শেষ। ল্যাপটপ আর হ্যান্ড লাগেজটা রাখলাম ইমিগ্রেশন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের অফিস কক্ষে। এরপর ছুটলাম এয়ারপোর্ট এপিবিএন এর অফিসের দিকে, নিচ তলায় চোরাই পথে । ভাগ্যিস একজন এপিবিএন সদস্য আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। নইলে নিজেই হারিয়ে যেতাম।

এপিবিএন অফিসে গিয়ে পেলাম বউ বাচ্চাদের। বিষন্নবদনে বসে আছে ওরা সবাই। আমি যাওয়াতে আবার উৎফুল্ল হয়ে উঠল ওরা। এখান থেকে অনেককে ফোন করলাম। যারা যারা বাকি ছিল, তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আবার কবে আসব জানি না।

সকালের নাস্তাটা কারুরই ভাল করে খাওয়া হয়নি। আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করেনি। সোমার অবস্থা ছিল আমার চেয়েও খারাপ। আমি জীবনকে সহজভাবে নিতে পারি। আমি রবীন্দ্রনাথের সেই বাণীতে বিশ্বাস করি,- মনেরে আজ কহ যে, ভাল মন্দ যাহাই আসুক, সত্যরে লও সহজে'। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাগুলো হল নিরেট সত্য। যা ঘটে, তা নিবারণ করা সম্ভব ছিল না; যা ঘটেনি তা কোন দিন ঘটতই না—ইমানুয়েল কান্টের এ বাণীতেও আমি আস্থাশীল। তাই সংসার জীবনের সুখ-দুঃখ আমাকে প্রভাবিত করলেও আমি সহজেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেই না। কিংবা অন্যরা তা টেরও পায় না। কারণ আমি জানি,
কীট যে ব্যর্থতা জানে পৃথিবীর ধুলোমাটি ঘাসে
তারও চেয়ে ব্যর্থতার সাথে রোজ হয় পরিচয়
যা হয়েছে, শেষ হয়
শেষ হয়, যা কোনদিন হবার নয়।
জীবনান্দ দাসের কঠিন এ সত্যকেও আমি মানি, রোজ রোজ আমলেও নেই।

আমার স্ত্রী সোমা। গত রাতে অনেক কেঁদেছে সে। একাকী হয়ে যাবার উদ্বেগের কান্নায় চোখের জলে সে আমার বুক ভাসিয়েছে। তাকে শান্তনা দেবার আসলে কিছু ছিল না। তাই কিছু উপদেশ দিলাম তাকে; দিলাম কিছু পরামর্শ। আমার অনুপস্থিতিতে কিভাবে সংসার চালাবে, কিভাবে সব কিছু ম্যানেজ করবে, তার পরামর্শ।

ইতোপূর্বের মিশনে যাওয়ার সময় সে এতটা কাঁদেনি। এতটা অসহায় বোধও করেনি। সেসময় তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল তার বাবা-মায়ের কাছে। আমার বড় সন্তান সাত্তিক তখন রংপুরেই পড়ত। মেনথার তখন স্কুলে যাবার বয়স হয়নি । তাই তার জীবনটা তখন ছিল বেশ সহজ। এ সহজতা কন্যাদের পিতৃগৃহে বসবাসের সহজাত সহজতা।

কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। এবার দু্ বাচ্চাই স্কুলে যায় তার। বাসা থেকে মেনথার স্কুল কাছে হলেও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে যন্ত্রচালিত গাড়ি ছাড়া উপায় সীমিত। রিকসা যেতে দেয় না ঐ রাস্তায়। সাত্ত্বিকের স্কুল অনেক দূর। সেখানে গাড়ি বা অটোরিকসা ছাড়া মানবচালিত রিকসার যোগাযোগ ঝামেলাপূর্ণ। এসব বিবেচনায় একটি গাড়ি কেনার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা হয়ে ওঠেনি।

কনস্টেবল মঞ্জু বাসায় অর্ডালি হিসেবে থাকবে। তাকে একটি মোটর সাইকেল কেনার জন্য এক লাখ টাকা ধার দিব। এ ধার সে এক বছর পরে শোধ দিবে। ঐ মোটর সাইকেলেই মঞ্জু বাচ্চাদের স্কুলে যাতায়াত করাতে পারবে। এজন অবশ্য প্রতি মাসে হাজার তিনেক টাকা জ্বালানী খরচ যাবে। তবে মোটর সাইকেলে চড়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এটা আমার কাছে নিরাপদ যান বলে মনে হয়না। তারপরও এ ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই। পূর্ব সতর্কতা হিসেবে গত কালই বাংলা মোটরে গিয়ে সাত্ত্বিকের জন্য একটা হেলমেট দেখে এসেছি। ওটা যতদূর তাড়াতাড়ি ওকে কিনে দিতে হবে। ওকে বার বার বলেছি, হেলমেট ছাড়া যেন মোটর সাইকেলে না ওঠে। সংসারের ঝক্কিঝামেলার জন্য সোমা আরো বেশি উদ্বেগাকুল হয়ে পড়েছে।

এয়ারপোর্ট এপিবিএন এর অফিসে সবাই পুনর্বার নাস্তা করলাম, চা খেলাম। তারপর বিমান উড়াল দেয়ার শেষ মুহূর্তের দিকে পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বিদায়ের বেলাটি অবশ্যম্ভাবিরূপে ছিল হৃদয়বিদারক। আমার স্ত্রী কেঁদে ফেলল। তবে আমার সহকর্মী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহিউদ্দিনের স্ত্রী সারাক্ষণ কাঁদতেই থাকল। ওদের বয়স আমাদের চেয়ে অনেক কম। ওদের আবেগ তাই আমাদের আবেগের চেয়ে অনেক বেশি।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করতে যাওয়া প্রত্যেক পুলিশ অফিসারের জন্য একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন। এখানে কাজ করলে বিদেশ সফর হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের পুলিশ অফিসারদের সাথে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয় যা একজন পুলিশ অফিসারকে বিশ্বপ্রেক্ষিতে নিজের ও তার পুলিশ সংগঠনের অবস্থানকে তুলনা করার সুযোগ তৈরি করে। এর ফলে পুলিশ অফিসারগণ নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার করে; পুলিশ সংগঠনকে আধুনিকতা ও বিশ্বমানের পুলিশিং এর দিকে ধাবিত করার চেষ্টা করে। আর একই সাথে একটি বড় অংকের অর্থ উপার্জিত হয় এ থেকে। তাই জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যাত্রা একটি আনন্দের ও সুখের যাত্রা। কিন্তু এখানে একাকীত্ব রয়েছে। রয়েছে বিপুল বিস্তৃতির বিরহ। এই একাকীত্ব ও বিরহের জন্যই মিশনে যাত্রা কষ্টকর, অশ্রুবর্ষক।
1. Daily Account of a Peacekeeper, episode-2