এক শান্তিরক্ষীর দিনলিপি; কিস্তি-১২( নীল নদের উৎস দর্শন-১)

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 14 Jan 2016, 02:08 AM
Updated : 14 Jan 2016, 02:08 AM

গত তিন দিন ধরে এন্টেবেতে আছি। কিন্তু এখানে আমাদের বেড়াকোড়া বলতে গেলে শুধু ইউএন বেইজ থেকে হোটেল মোটেল ফ্লাইট পর্যন্ত। প্রতিদিন সকালে শুরু হয়ে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত চলেছে প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য আনুসঙ্গিক কাজকর্ম। তবে প্রতিদিন অফিস শেষে অসেপাশের কিছু জায়গা দেখেছি। কয়েকটি মার্কেটে গিয়েছি, ভিকেটারিয়া লেইকের পারে গিয়েছি এই যা।

তাই দেখার মতো অনেক কিছু থাকলেও উগান্ডার তেমন কিছুই দেখা হয়নি। দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে প্রধানতম হল পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী নাইলের উৎসমুখ। উগান্ডায় আসা পর্যটকগণ তাই প্রথম সুযোগে নাইলের উৎসে চলে যান। এন্টেবের বাইরে তাই আমাদেরও যাবার প্রধান স্থানটিই হল নাইলের উৎস জিনজা শহর।

আমরা আজ সকালের একটা অংশ ব্যয় করলাম আমাদের বিশ কেজির পরিমাণের চেয়ে বেশি জিনিসপত্র কার্গো বিমানে, পাঠানোর জন্য বুকিং ‍দিতে। এখানে এই কর্মকে বলে সিএম আর (Cargo movement Request)। কোন শান্তিরক্ষীর সাথে বিশ কেজির বেশি বস্তু, তার পরিমাণ যাই হোক না কেন, তিনি কার্গো বিমানে তা মিশন এলাকায়, মানে জুবায় পাঠাতে পারেন। আমাদের দশ জনের মধ্যে মাত্র দুই তিন জনের বস্তুর ওজন বিশ কেজির বেশি হয়েছিল।

ইন্সপেক্টর শিমুলের কনসালটেন্সি
নাইলের উৎস মুখ দেখতে যাওয়ায় আমাদের নিজস্ব পরামর্শকের কাজ করলেন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর শিমুল দাস।তিনি ইতোপূর্বে দারফুর মিশনে থাকতে একবার এখানে এসেছিলেন।একই স্থান বারংবার দেখতে অনেকের ভাল লাগে না। কিন্তু শিমুলের আগ্রহের কোন কমতি নেই। এখানে পূর্ব পরিচিতির বাইরেও শিমুলেরর একটি বড় সুবিধা হল, তার বাল্য বন্ধু ও সহপাঠী অনুপম মজুমদার হলেন উগান্ডার ব্র্যাক কার্যক্রমের অন্যতম ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। স্কুলের গন্ডি পেরুনোর পর এই দুই দোস্তের মধ্যে আর সামনাসামনি দেখা হয়নি। শুধু ফোন, ফেইসবুক বা ইমেইলের মধ্যেই তারা নিজেদের বন্ধুত্ব জিইয়ে রেখেছিলেন। আজ তারা সুযোগ পেয়েছেন বহুদিন পর একত্রিত হওয়ার। শিমুলের আকর্ষণ তাই নাইলের উৎসের চেয়ে তার বাল্যবন্ধুর কর্মস্থল কাম্পালার দিকেই বেশি। আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি মানুষকে এমনভাবে পরষ্পরের কাছে টানছে, কোন কোন কালের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে শিমুল এই বিভুইয়ে প্রয়োজনের সময় কাছে পেয়ে গেলেন।

উগান্ডায় বড় ধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট তেমন দেখা গেল না। দেশের উত্তরের একটি শহর থেকে রাজধানী পার হয়ে পূর্বদক্ষিণের একটি ব্যবসায়িক শহর জিনজায় যাবো আমরা। কিন্তু এখানে মাইক্রোবাস ছাড়া ভাড়া করার মতো অন্য কোন যান পাওয়া গেল না। বিদেশে এসে পর্যটন এলাকায় ভ্রমণ করতে প্রাইভেট যান বাহন বেশি উপযোগী হলেও সেগুলো ভাড়া করতে প্রায় ঠকতে হয়। বিদেশিদের পকেট ফাঁকা করার জন্যই এখানে স্থানীয়রা হ্যাঁ করে বসে থাকেন।তাই স্থানীয়দের সাহায্যে মাইক্রোবাস ভাড়া করাটাই লাভজনক।

একাজে আমাদের সাহায্য করলেন ইন্সপেক্টর শিমুলের বন্ধু ব্র্যাক কর্মকর্তা অনুপম মজুমদারই। গোটা দিনের জন্য তিনি একটি মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করলেন। জন নামে তার অত্যন্ত পরিচিত একজন মাইক্রোবাস ড্রাইভার-কাম-মালিক রয়েছে। জনের সাথে চুক্তি হয়েছিল, তিনি আমাদের নাইলের উৎসমুখ জিনজাসহিআশেপাশের কয়েকটি স্থানে নিয়ে যাবেন। দুপুরে আমাদের সাথে খাবেন। ভাড়া হল ১৮০ ডলার। আমরা প্রত্যেকে ২০ ডলার করে চাঁদা দিলাম। ১৮০ ডলার বাংলাদেশি টাকায় মাত্র সাড়ে চৌদ্দ হাজার। এন্টেবে থেকে জিনজার দূরত্ব ১২০ কিলোমিটারের মতো। এই ভাড়ায় তারা দুইজন সকল খরচসহ প্রায় পুরো দিনটিই আমাদের সেবা দিবেন। আমি মনে করি এই ভাড়া অত্যন্ত সস্তা।

যদিও মাইক্রো ড্রাইভার জনকে দশটার দিকে যাত্রার কথা কলা হয়েছিল, তবুও আমরা সাড়ে এগারটার আগে রওয়ানা হতে পারলাম না। যাত্রার শুরুতেই আমাদের মাইক্রোবাসটি জ্বালানি সংগ্রহের জন্য একটি পেট্রোল পাম্পে থামল। কাছেই একটি দোকানে থরে থরে ফল সাজান। আমি এধরনের যাত্রাকালে সাথে কিছু ফল রাখতে অভ্যস্ত। গাড়িতে বসে বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকাতে তাকাতে ফলের গায়ে কামড় দেয়াটা আমার কাছে অপূর্ব লাগে।তাছাড়া কখন কোথায় কি খাবার পাওয়া যাবে তার কি কোন ভরসা আছে? সাথে কিছু ফল থাকলে সব দিক দিয়েই সুবিধা। চুইয়িং গাম স্টাইলে চিবানো যায় আবার ক্ষিদাও দূর হয়।

ভ্রমণকালে সাধারণ তহবিল
সাব-ইন্সপেক্টর আনোয়ার সাত্তার কে ক্যাশিয়ার বানিয়ে এই মুহূর্তে একটি কমন ফান্ড গঠন করলাম। সবাই ১০ হাজার সিলিং করে চাঁদা দিলেন। সেই কমন ফান্ড থেকেই এক ছড়ি কলা কেনা হল। দোকানে অন্যান্য ফলের মধ্যে ছিল তরমুজ, আনারস আর অ্যাভোগার্ডো। কিন্তু কলা ছাড়া অন্য ফলগুলো কেনার যোগ্য ছিল না।যাত্রা পথে কলা, আপেল, বরই, কমলা, এগুলোই খাবার যোগ্য।

কিন্তু মাইক্রোবাস চলতে শুরু করার পরপরই কলার শ্রাদ্ধ হওয়া শুরু হল। আমার সাথে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুল ইসলাম সাথের ফল দ্রুত উদরস্থ করার ফজিলত বর্ণনা করলে এক ছড়ি কলার শেষ হতে বেশি দেরি হল না। তখন প্রায় দুপুর বারটার মতো। তাই আমাদের ক্ষুধাও কম ছিল না।

উগান্ডায় ফলমূল বেশ সস্তা এবং সুস্বাদু। এখানে কলার যত জাত-পাত আছে তার সবগুলোই মিষ্টি। আমাদের দেশের কোনটির মতো টক, কোনটির মতো নোনতা কিংবা কষ্টা কলা নেই। কলা নিঃশেষ হলে সামনের কোন দোকান থেকে আবার কেনার সিদ্ধান্ত হল।

এন্টেবে থেকে আমরা যাচ্ছি প্রথমে ক্যম্পালা শহরে শিমুলেরর বাল্যবন্ধু অনুপম মজুমদারের ব্র্যাক অফিসে। রাস্তায় দুই ধারে অনুচ্চ পাহাড় ও বাড়ি ঘর। বসতি অনেক কম ।মাইক্রোবাসে এসি না থাকার জন্য সবাই মন খারাপ করেছিলেন। প্রায় সারাদিন এসিবিহীন একটা মাইক্রোবাসে ড্রাইভার ছাড়াও আরো এগারজন মানুষ থাকব কি করে। সিনিয়র হওয়ায় আমার সুবিধা ছিল। আমি সামনে ড্রাইভারের পাশেই বসেছিলাম। এতে প্রকৃতির সোভা যেমন ভালভাবে উপরভোগ করা যায়, তেমনি বাতাসও লাগে গায়ে।

কিন্তু উগান্ডার নাতিশীতোঞ্চ আবহাওয়া আমাদের শীতাত্তাপ নিয়ন্ত্রণহীনতা একদম অনুভব করতেই দিল না।খুব উর্বর ভূমির দেশ নয় উগান্ডা। যেখানে দেখি সেখানকার মাটিই লালচে রঙের। ধুলোবালি অবশ্যই আছে। কিন্তু এ মুহূর্তে আবহাওয়া চবমৎকার! আমরা ক্যাম্পালা শহর অতিক্রম করার সময় এক পশলা বৃষ্টি্ও হল। এখানে নাকি ডিসেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। একণ নভেম্বরের প্রথমার্ধ।

ব্রাক অফিস কাম্পালা
এক ঘন্টারও কম সময়ে আমরা ক্যম্পালা এসে পৌঁছিলাম। ব্র্যাক অফিস আমাদের ড্রাইভার জনের বহুল পরিচিত। তাই সরাসরি আমাদের গাড়ি ব্র্যাক অফিস কম্পাউন্ডের ভিতর ঢুকে পড়ল।

চার চালার টাইলসের ছাদ দেয়া ৫/৬ টি ছোট ছোট বাংলো টাইপের বিল্ডিং এর সমন্বয়ে এই ব্র্যাকের উগান্ডার সদর দফতর অবস্থিত। আমরা যখন অফিসে পৌঁছিলাম তখন ক্যম্পালায় প্রচন্ড রোদ। কিন্তু বের হওয়ার সময় আকাশে ছিল কালো কালো মেঘ। কম্পাউন্ডের লাল বাংলোগুলোর চূড়ায় কালো মেঘ বেশ মোহনীয় লাগছিল।

আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন অনুপম বিশ্বাস। আমাদের পরসিই হবেন তিনি এখানে কাজ করছেন। প্রতি তিন মাস পর পর অফিসের খরচে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পান। তিনি ছাড়াও এই অফিসে নাকি ২৫/২৬ জন বাঙালি কর্মচারী কর্মকর্তা আছেন। কিন্তু তাদের অনেকেই অফিসের বাইরে। আমরা স্থানীয় কর্মচারীদের সাথে আলাপ করলাম। জানলাম এখানে ব্র্যাকের শিক্ষা, কৃষি, ইত্যাদির উপর প্রকল্প আছে। তবে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে তাদের ক্ষুদ্র ঋণের প্রকল্পটি অবশ্যম্ভাবীরূপে রয়েছে।

অনুপম মজুমদারের অফিসেই দেখা হল একজন কৃষিবিদের সাথে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়ে ব্রাকের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। অনুপম তার স্থানীয় বসের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অফিসের বাহিরে। তাই তার সাথে দেখা হল না। নাইলের উৎসে যাবার জন্য আমাদের খুব তাড়া। তাই আমাদের দ্রুত বিদায় নিতে হল। তবে ফেরার পথে অনুপমের বাসায় রাতের খাবার খেতে হবে বলে প্রুতিশ্রুতি দিতে হল। হ্যাঁ, এ বিদেশে দেশি মানুষের অতিথ্য একটি বড় উপাদেয় ঘটনা। তাই এটা কি আর পরিহার করা যায়?

সময়ের সদ্ব্যবহারের জন্য আমরা কামপালা শহরের কেন্দ্রস্থল পরিবার করে একটি বাইপাস ধরে চললাম। যেহেতু বাইপাসগুলো সাধারণত শহরের বাইরে হয়, তাই রাস্তার দুই ধারের পরিবেশ অনুন্নতই মনে হল। শহর ছাড়তে না ছাড়তেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। আমরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে চলছি। এক সময় রাস্তার দুই ধারে গভীর বন পড়ল। চালক উগান্ডিয়ান বন্ধু নামব্রে বেনসন বলল, এটা মাবারিয়া বিজার্ভ ফরেস্ট। বনের গাছগুলো সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে উঠেছে। মনে হল, এখানে গামারী জাতের গাছও রয়েছে।

সাথের কলাগুলো মুহূর্তেই নিঃশেষ হওয়ায় আমরা কোন দোকান থেকে কলা কিনতে চাইলাম। তাই পথে পথে বাজারগুলোতে গাড়ির মন্থর করা হচ্ছিল। মেয়োলোজ্জোলো নামের একটি বাজারে গাড়ির গতি মন্থর করার সাথে সাথে গাড়ির দুই পাশে প্রায় ডজন খানেক ফেরিওয়ালা ছেলে মেয়ে আমাদের গাড়িতে হামলে পড়ল।কারো হাতে কলা, কারো হাতে সিদ্ধ কিংবা ভাজি করা মিষ্টি আল। অনেকে মুরগীর রান বাঁশ বা কাঠের কাঠিতে ফুঁড়ে আমাদের সামনে মেলে ধরল। কিন্তু কিছুই কেনা হল না। তবে ফেরার পথে এই বাজার থেকে ঐ মুরগীর একটা রান কিনে খেয়েছিলাম। ভালই লেগেছে।

যাত্রাপথে রাস্তায় কোন বাস বা কোস্টার চোখে পড়ল না। এখানে হাইওয়েতে এগুলোর বালাই নেই। গোটা রাস্তায় জন পরিবহন বলতে মাইক্রোবাস আর মোটর সাইকেলে যাদের বলে ভোডা ভোডা। গ্রামের ভুমি উর্বর হলেও মাটি লাল। আমাদের দেশের মতো পলি মাটি এখানে নেই।রাস্তার দুইধারে নানাবিধ ফলের গাছ লক্ষ করলাম। আম, কাঁঠাল আর অ্যাভোকাডোর অধিক্য আছে। কইইয়াকা নামক স্থানে রাস্তার দুই ধারে বড় সড় চা বাগান চোখে পড়ল। কেনিয়া, উগান্ডা, রুয়ান্ডসহ বৃহৎ লেইক অঞ্চলের দেশগুলোতে চা ও কফির চাষ হল।

লুগাজি টাউন পার হয়ে চোখে পড়ল আখক্ষেত।কিন্তু এ আখ আমাদের দেশের আখের মতো শক্ত-সামর্থ্য নয়। শহরের গেন্ডারির মতো কিছু আখ আছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে চিনি তৈরির আখগুলো সরুসরু। আমাদের দেশের মতো তাই পাতলা পাতলা কাদি তৈরি না করে ঘনঘন ভাবে রোপন করা হয়েছে। তাই প্রথম দর্শনে আখ ক্ষেত নয়, কাশবন বলে ভুল হতে পারে।

Daily Account of a Peacekeper, Eisode-12