স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৃথক পুলিশ বিভাগের দাবি ও হাতুড়ে বিষেজ্ঞদের সর্বরোগহর পুলিশিং দাওয়া

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 16 Feb 2016, 08:51 PM
Updated : 16 Feb 2016, 08:51 PM

সম্প্রতি পুলিশ সপ্তাহ-২০১৬ তে পুলিশ সদস্যদের ১৮ দফার মধ্যে অন্যতম ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশ বিভাগ নামে একটি পৃথক বিভাগ গঠন করা। কেউ কেউ এটাকে ভাল বলছেন, কেউ বলছেন, এটা সঠিক হবে না; কেউ আবার এ সম্ভাবনা নিয়ে না না প্রকার আসঙ্কা প্রকাশ করছেন। আমরা এ নিবন্ধে এ প্রসঙ্গে কিছু বিষয়ের প্রাসঙ্গিক দিকগুলি বিশ্লেষণ করব।

স্বাধীন বাংলাদেশ মাত্র ৩৪ হাজার সদস্য নিয়ে তার জাতীয় পুলিশ বাহিনীকে জনগণের জানমাল ও শৃঙ্খলা রক্ষার মতো একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন শুরু করেছিল। কিন্তু কালের প্রবাহে সেই পুলিশের সদস্য সংখ্যা এখন প্রায় পৌনে দুই লাখ এবং সামনের দুই-তিন বছরে সেই সংখ্যা দুই লাখ ছুবে। একই ভাবে পুলিশের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বাহিনী কিংবা অধিদফতরগুলোর সদস্য সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

কেবল সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধিই নয়, এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিধি আয়তন নানা দিক দিয়ে নানা মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা কিংবা অপরাধ দমনের কাজটি এখন আর কোন নির্দিষ্ট একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। বিশ্বায়ন কেবল অর্থনীতি, রাজনীতি কিংবা সমাজনীতিতেই হয়নি, বিশ্বায়ন ঘটেছে অপরাধেরও তাই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ তথা ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত সকল সংগঠনকেই আধুনিক বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে ঢেলে সাজান দরকার।

বলাবাহুল্য, মাঠ পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা কিংবা বিচার ব্যবস্থার সাথে জড়িত অন্যান্য সংগঠনগুলোর যেমন কাজের চাপ বেড়েছে, সেই অনুপাতে নতুন নতুন ইউনিট তৈরি করা হয়েছে, তেমনি সরকারের কেন্দ্রেও পরিবর্তন করেছে। অনেক প্রয়োজনের তাগিদে দেশে অনেক নতুন মন্ত্রণালয়ের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক মন্ত্রালয়কে ভেঙ্গে নতুন নতুন মন্ত্রণালয় গঠন করে হয়েছে, এবং অনেক মন্ত্রণালয়কে সরাসরি সম্পূর্ণ আলাদা না করে তাদের অভ্যন্তরে বিভাগ তৈরি করা হয়েছে।

উদাহরণে বলা যায়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন রয়েছে সশস্ত্রবাহিনী বিভাগ। এই বিভাগটি বহুদিন থেকে কাজ করেছে যেখানে তিন বাহিনীর বিষয়গুলো পৃথকভাবে বিবেচনা করা হয়। মাত্র কিছু দিন আগে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে দ্বিখণ্ডিত করে সেতু ও সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং রেল মন্ত্রণালয় নামে পৃথক দুইটি মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে। এই দুই মন্ত্রণালয়ে কেবল দুজন পৃথক সচিবই নয়, দুজন পৃথক মন্ত্রীও রয়েছেন।

একইভাবে শিক্ষামন্ত্রণালয়কে পৃথক করে প্রাথমিক গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় তৈরি করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন অর্থ বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক বিভাগ, ব্যাংকিং বিভাগ কত কি না করা হয়েছে। কেন করা হয়েছে? কারণ এগুলো ছিল সময়ের দাবি। এই বিভাগ কিংবা পৃথক মন্ত্রণালয় না হলে বর্তমানের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব নয়।

কিন্তু আধুনিকতা ও বিম্বায়নের আবহে আবর্তিত পুলিশিংসহ আইন-শৃঙ্খলা তথা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী মন্ত্রণালয়টির কার্যক্রম ও পরিধি সমভাবে বৃদ্ধি পেলেও এটার কোন বিভাজন তো হয়নি, এমনকি এর কাজকর্মে অধিকতর গতিশীলতা আনার জন্য এখানে কোন আলাদা বিভাগও করা হয়নি। এখানে মান্ধাতার আমলের শাখাই রয়েছে। যেমন, পুলিশ শাখা, আনসার শাখা, বিজিবি শাখা কিংবা কারা শাখা।

বলতেই বাধে আর শুনতেই খারাপ লাগে যে ৩৪ হাজার পুলিশ সদস্য নিয়ে ১৯৭১ শালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশ শাখা ছিল। এখন প্রায় অর্ধশত বছর পরে প্রায় ছয়গুণ বেশি লোকবল নিয়ে মন্ত্রণালয়ে পুলিশ এখন্ও একটি শাখাই রয়ে গেছে। যদিও শাখার সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু শাখা তো শাখাই। এটা তো আর গাছের গোড়া কিংবা কাণ্ড নয় যে ছয়গুণ বেশি ভার বহনে সক্ষম হবে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের তথা পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশনের অনেক দিনের দাবি তাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আলাদা পুলিশ বিভাগ কিংবা কয়েকটি অধিতফতর নিয়ে আলাদা বিভাগ গঠন করার। এতে পুলিশের নীতিগত বা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কাজের গতি দ্রুত হবে।

বিষয়টিকে কেউ কেউ ভিন্ন চোখে, বাঁকা চোখে কিংবা বিদ্বেষের চোখেও দেখছেন। এর সপক্ষে সরকার প্রথম থেকেই একটি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আসছেন। কারণ সরকার তো দেশ পরিচালনার জন্য সঠিক পথটিই বেছে নিবে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কাজের পরিধি ও আয়তনকে পাত্তা দিয়ে সরকার তো প্রতিনিয়তই তার প্রশাসনিক সংস্কার চালিয়ে যাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতাই তারা যেমন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে পৃথক বিভাগ করেছে, যোগাযোগ কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ভেঙ্গে পৃথক পৃথক মন্ত্রণায় করেছে তেমনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণায়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলোতেও একাধিক বিভাগ করার চিন্তাভাবনা করছে বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে।

কিন্তু এতে বাধ সাধছেন কতিপয় বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি বা সংগঠন। তারা বলার চেষ্টা করছেন যে পুলিশের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় হলে কিংবা আলাদা বিভাগ হলে পুলিশ স্বাধীন হয়ে যাবে কিংবা পুলিশ অধিকতর ক্ষমতাশালী হবে। কিন্তু পুলিশের স্বাধীন হওয়ার ভয়টি না হয়, বুঝতে পারলাম, কিন্তু পুলিশকে শক্তিশালী করতে তাদের এত ভয় কেন?

তাহলে তারা কি কামনা করেন যে, তাদের জান-মাল রক্ষা, দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রাথমিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ও প্রধানতম বাহিনী বা সংগঠনটি দুর্বল হয়ে থাকুক? তাহলে কিসের জন্য আমি একটি দুর্বল বা কম শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী কামনা করব? আমার নিরাপত্তার জন্য, না আমার নিরাপত্তা হানির জন্য। দুর্বল পুলিশ মানে দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার প্রবেশ পথটিই এলোমেলো হওয়া, দুর্বল পুলিশ মানেই তাদের সমাজ-সংগঠন-প্রতিষ্ঠান এমনকি গোটা সমাজের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাই দুর্বল হওয়া, সেটা কি তারা বোঝেন?

ধরুন, আপনি একজন বিশেষ ব্যক্তি। আপনাকে সরকার একজন দেহরক্ষী দিতে চান। আপনিও আপনার নিরাপত্তার জন্য একজন দেহরক্ষী চান। দেহরক্ষী তো আর সেনাবাহিনীর কিংবা এসএসএফ এর কেউ হবে না, হবে একজন পুলিশ সদস্যই। এখন আপনি কি ধরনের অস্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণসহ একজন পুলিশ সদস্য চাইবেন? যদি পুলিশ কর্তৃপক্ষ আপনাকে বলে, আপনাকে দেয়ার মতো আমাদের কাছে যে পুলিশ সদস্যটি আছে তিনি ঠিক মতো অস্ত্রপ্রশিক্ষণ পাননি, তিনি চালাতে পারেন শুধু সর্টগান। তিনি কখনও পিস্তল চালাননি। তার আই কিউ নিম্ন পর্যায়ের। তার স্বাস্থ্য মোটামুটি ভাঙ্গা- প্রতি সপ্তাহে দুবার জ্বরে ভোগেন, তার কিছুটা ডায়াবেটিকও রয়েছে। মাঝে মাঝে বুকের ব্যথা অনুভব করেন। টিবি হয়েছে কিনা এখনও পরীক্ষা করা হয়নি। আর হ্যাঁ, ঐ দেহরক্ষীর সাথে যে পিস্তলটি দিব তাও কিন্তু ১৯২০ সালের মডেলের যার গোলাবারুদ আর কিনতে পাওয়া যায় না। আমাদের স্টকে মাত্র দুটি বুলেটই আছে।

তাহলে আপনি কি এমন ধরনের কোন পুলিশ সদস্য কিংবা এমনতরো কোন পুলিশ সংগঠনের কাছ থেকে সহায়তা নেয়ার কথা ভাববেন? মান্ধাতার আমলের আইন-বিধি, সাজসরঞ্জাম, প্রশিক্ষণহীন, দুর্বল রুগ্ন এই পুলিশ সংগঠনের উপর কি আপনার ব্যক্তিগত আস্থা থাকবে?

ঠিক একইভাবে সামষ্টিক দিকটি বিবেচনা করুন। একটি দুর্বল পুলিশ সংগঠন মানে তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কিছুই দুর্বল হওয়া। তার তদন্ত দুর্বল, অভিযান দুর্বল, টহল দুর্বল, সাড়াদান দুর্বল এমনকি ব্যবহারখানাও দুর্বল। আর এ দুর্বলরাই যখন আইনী ক্ষমতা পেয়ে যান তখন কি হয়? তারা নানা প্রকার অপকর্ম করে, চাতুরির আশ্রয় নিয়ে তাদের দুর্বলতা ঢাকতে চেষ্টা করে। তাদের মনোবল বলতে কিছু থাকে না। তাই কোন বুদ্ধিমান, সচেতন, দেশপ্রেমিক মানুষ তার দেশের জন্য দুর্বল কোন পুলিশ বাহিনী কামনা করতে পারেন না।

এবার আসুন পুলিশের স্বাধীনতার বিষয়ে। 'স্বাধীনতা' শব্দটি পুলিশের সাথে কোন কালেই মানায়নি, কোন কালেই যায়নি; এখনও মানায় না এখনও যায় না। ব্যক্তি কিংবা সংগঠন হিসেবে কোন স্বাধীন পুলিশের অস্তিত্ব নেই। পুলিশ যে কাজটি বা কাজগুলো করে সেগুলো রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ পরিচালনা করেন নির্বাচিত ব্যক্তিগণ। আর পুলিশ অবশ্যই নির্বাহী বিভাগ তথা নির্বাচিতদের অধীনেই থাকবে। এ বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা করা যায়। কিন্তু আমাদের আলোচনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৃথক পুলিশ বিভাগ কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণায়ে কয়েকটি বিভাগে তার অধীন অধিদফতরগুলোকে সাজানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব।

প্রস্তাবিত কিংবা দাবিকৃত পুলিশ বিভাগে যদি আলাদা সচিব থাকেন, তার জন্য আলাদা লোকবল থাকে যারা কেবল পুলিশ বা পুলিশসহ অন্য দুএকটি অধিদফতরের কাজকর্মগুলো দেখবেন, তাহলে কোন বিবেচনায় দাবি করা হয়, ধূঁয়া তোলা হয় বা গুজব ছড়ান হয় যে পুলিশ স্বাধীন হবে?

আবার পুলিশ যদি একটি পৃথক মন্ত্রণালয়ও হয়, সেখানে একজন মন্ত্রী থাকতে পারেন, তার জন্য একজন সচিব থাকবেন, একাধীক অতিরিক্ত সচিবসহ অন্যান্য অফিসার বা কর্মচারীগণ থাকবেন। এ ব্যবস্থায় পুলিশের আইজিপি যেমন নিজে সচিব হয়ে যাচ্ছেন না, তেমনি তিনি মন্ত্রীর পদটিও দখল করছেন না। তাহলে কিভাবে বিরোধীতাকারীগণ দাবি করেন যে এতে পুলিশ স্বাধীন হবে? পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যেখানে পুলিশ নামে পৃথক মন্ত্রণালয় আছে, এবং এর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীও রয়েছে। সেই সব উদাহরণ দেখেও কি নিন্দুকরা তাদের নিন্দার রোল বন্ধ করবেন না?

তাই বিরোধীতার জন্য বিরোধী তানয়, কিংবা নিজস্ব সংকীণ ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী স্বার্থ বিবেচনা করে কোন মহতী উদ্যোগের বিরধীতা করা কোন ক্রমেই কাম্য হতে পারে না। কেউ যদি মনে করেন, বিষয়টিতে দেশ ও জাতির মঙ্গল হবে না, তাহলে সেটা যুক্তির মাধ্যমে, উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে। যারা কোন দিনই পুলিশের কর্মপদ্ধতি কিংবা বিচার ব্যবস্থার কোন অংশের সাথে কোনভাবেই জাড়িত ছিলেন না তারাই যদি দেশে বড় নিরাপত্তা বিশ্লেষক হয়ে পড়েন, কিংবা সর্বজ্বরহর দাওয়ার মতো পুলিশ প্রাক্টিশনার কিংবা পুলিশ গবেষকদের উপদেশের দাওয়া প্রয়োগ করতে চান তবে রোগ সারবে না, রোগ বাড়বে এবং তা এক সময় অরোগ্যের বাইরে চলে যাবে।

(২৯ জানুয়ারি, ২০১৬; ইউএন হাউজ, জুবা, দক্ষিণ সুদান।)

সূত্রাবলী/ইন্টারন্টে লিঙ্ক:
http://bangla.bdnews24.com/politics/article1096691.bdnews
http://www.shampratikdeshkal.com/national/2016/01/27/14411
http://bhorer-dak.com/2016/01/21/37163.php
http://todaysangbad.com/archives/18916
http://www.currentnews.com.bd/news/27091