ঘুরে এলাম তানজানিয়া (৩য় কিস্তি-কারিবু জানজিবার)

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 12 June 2016, 03:47 AM
Updated : 12 June 2016, 03:47 AM

কারিবু জানজিবার
উত্তাল সমুদ্র অবশ্য সারাক্ষণ সহিংস থাকেনি। জানজিবার উপকুলের কাছাকাছি আসার সাথে সাথেই সাগর অনেকটাই নদীর মতো শান্ত হয়ে এল। জানজিবারের মালিন্দি বন্দরে এলাম দুপুর দুটার দিলাকা। এখানে এখনও পুরাতন আমলের বাড়িঘর দৃশ্যমান। পুরাকালে পাথর দিয়েই তৈরি হত এসব বাড়িঘর যেখানে কে। বেশ সিমসাম বন্দর। এ বন্দরের যাত্রা সেই ১৪৯৮ সালে যখন ভাস্কো ডা গামা পর্তুগাল থেকে এ উপকুলে আসেন তখন। তারপর এখানে আরবগণ এসেছে, এসেছে জার্মানগণ ও সর্বশেষ ইংরেজগণ। এ অঞ্চলটাই জান্জিবারের পুরাতন এসিমেন্টের ব্যবহার ছিল না। তাই এ এলাকার নাম হয়েছে স্টোন টাউন বা পাথরের শহর।

ফেরি থেকে বন্দরের সেডের কার্নিসে লেখা 'কারিবু জানজিবার'। এটা হল একটি সোয়াহিলি ভাষার শব্দমালা। এর অর্থ হল জানজিবারে স্বাগত। জানজিবার উপকুলকে বলা হয় সোয়াহিলি উপকুল। পূর্ব আফ্রিকার প্রায় সব কটি দেশেই সোয়াহিলি ভাষার চাল আছে। এটা এ এলাকার লেঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা বা সাধারণ ভাষা। তানজানিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা ও কমোরসের এটা প্রথম স্থানীয় সরকারি ভাষা। অধিকন্তু আফ্রিকান ইউনিয়নের দাফতরিক ভাষাও বটে। সোয়াহিলি হল প্রায় এক কোটি লোকের মাতৃভাষা। তবে বারকোটি লোক এভাষায় কথা বলতে পারে। মজার বিষয় হল, এই জানজিবারের লোকরাই সবচেয়ে প্রমিত সোয়াহিলি বলেন। তাই জানজিবারকেই সোয়াহিলি ভাষার মানদণ্ড ধরা হয়। তবে এ ভাষার নিজস্ব কোন লিপি নেই। লেটিন বর্ণমালাতেই এটার লেখার কাজ চলে।

ইমিগ্রেশনে ইয়েলো কার্ডের ঝামেলা
শুরু হল ইমিগ্রেশনে চেক ইন। তানজানিয়ার একটি প্রদেশমাত্র। কিন্তু এদের ইমিগ্রেশনের কাজ কারবার দেখে মনে হবে এটা একটি সার্ভভৌম দেশ। রীতিমত পাসপোর্টে সিল-ছাপ্পড় মারা হয়। পরীক্ষা করা হয় অন্যান্য কাগজপত্রও।

ইমিগ্রেশনে পৌঁছিতেই আমার ইয়েলো ফিভারের টিকার কাগজটা চেয়ে নিল। আফ্রিকার দেশগুলোতে ভ্রমণের ক্ষেত্রে হলুদ জ্বরের টিকা দেয়ার প্রমাণ থাকতে হবে। এরা প্রায় সব দেশের নাগরিকদের আসামাত্রই ভিসা দেয়। কিন্তু টিকার কাগজটা না থাকলে দেশে ঢুকতেই দিবে না। আমার কাগজটা ছিল ঢাকার ইউএনডিপি ক্লিনিকের দেয়া সেই ২০০৮ সালের যার মেয়াদ থাকবে ২০১৮ সাল পর্যন্ত। কিন্তু লেমিনিটিং করার ফলে এটাকে ওরা ফটোকপি মনে করল। আমি প্রবলভাবে মূলকপি বলে দাবি করলাম। পরে অবশ্য এ হাত ও হাত হয়ে ওরা সেটা গ্রহণ করল। অবশ্য ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে তেমন ঝামেলা নেই। এখানে পাসপোর্ট দেখাতে হয়। ওরা একটা সিল মেরে দিল।

পাইপের সাহায্য কাজে লাগল
কিন্তু ঝামেলায় পড়লাম বাইরে এসে । কোথায় যাব, কিভাবে যাব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একটি ইন্ডিয়ান পরিবারকে দেখলাম। মোট ছয়জন ছিল তারা। তবে এরা গুজরাটি ইন্ডিয়ান হলেও বসবাস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তাদের কাছে গিয়ে একই টেক্সিতে কোথাও যাবার প্রস্তাব দিলাম। কিন্তু সেটা হল না। কারণ একটি টেক্সিতে ওদেরই স্থান সংকুলান মুসকিল।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে দেখি আমার নাম লেখা প্লাকার্ড নিয়ে একজন হাজির। বুঝতে পারলাম দারুস সালামের সেই টেক্সির দালাল পাইপের লোক হবে সে। হ্যাঁ, তাই হল। তার নাম হল সোলাইমান। আমি বললাম, পাইপ তো বলেছিল তোমার নাম মোহাম্মদ। সে বলল, মোহাম্মদও আছে। তবে সে নিবন্ধিত ড্রাইভার নয়। আমি সোলায়মানকে বললাম, আমি এখন টেক্সি নিব না। আমি কাছাকাছি কোন একটা হোটেলে থাকতে চাই। সে অবশ্য আমাকে বলল, ঠিক আছে, তোমাকে টেক্সির ভাড়া দিতে হবে না। আমি কাছের একটা হোটেলে তোমাকে নিয়ে যাব বিনা মূল্যে। আমার না করার কিছু ছিল না। কারণ, এখানে আমার কিছুই জানা নেই। কয়েক মিনিট পরেই সে আমাকে ফুংগুনি নামে একটা হোটেলে নিয়ে এল। ফেরিঘাট থেকে সম্পূর্ণ হাঁটা পথের দূরত্ব। তবে সম্পূর্ণ অপরিচিত এ শহরে বোকচা প্যাটরা নিয়ে সম্পূর্ণ একা একা পায়ে হেঁটে হোটেল আবিষ্কার করা কঠিনই বটে।

ফুংগুনি হোটেল
হোটেলটি খুব আহামরি মানের নয়। আশেপাশের পরিবেশও পুরাণ ঢাকার মতো। তবে এটা হল পুরাতন শহর। তাই ইচ্ছা করলেও এরা এর চেহারাটা যেমন রাতারাতি পরিবর্তন করতে পারেন না, তেমনি তারা সেটা চায়ও না। কারণ, পুরাতন হওয়ায় এ শহর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। তাই কর্তৃপক্ষ এটাকে পরিবর্তন তথা ভেঙ্গেচুরে আধুনিক করার অনুমতি দেয় না। হোটেলের ভাড়ার চার্টে লেখা আছে প্রতিরাত ৩৫ ডলার। কিন্তু একটু বারগেইনিং করার ফলে ২৫ ডলারে রাজি হল। আমাকে ২০৬ নম্বর রুম দেয়া হল।

রুমে গিয়ে দেখি একটি ফ্যামিলি সাইজের বেড। খাটটার মাঝেও আভিজাত্য আছে। বেশ কারুকাজ করা একটি খাট। তবে পুরাতন পুরাতন একটা গন্ধ পাওয়া যায়। জানজিবারে প্রায় আড়াইশ হোটেল রয়েছে যার মধ্যে ২০টির মতো ফাইভ স্টার মানের । আর প্রতি বছর এখানে প্রায় পৌনে দুলাখ বিদেশি পর্যটক বেড়াতে আসেন। তাই তারা সবাই যেমন ফাইভ স্টার হোটেলে থাকার জন্য যানও না, আবার গেলেও থাকার স্থান পানও না। আমি জানজিবারে এসে একটি কম দামের হোটেল খুঁজছি। খদ্দের তেমন নেই বলে আমাকে ৩৫ ডলারের হোটেল এরা মাত্র ২৫ ডলারে ভাড়া দিলেন। তবে পর্যটনের ভরা মওসুমে এলে হয়তো আমাকে ৩৫ ডলারেরও বেশি ভাড়া দিতে হত আর পূর্বে বুকিং না দিলে তা পাওয়াও যেত না।