ঘুরে এলাম তানজানিয়া (৪র্থ কিস্তি- স্টোন টাউন)

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 18 June 2016, 07:17 PM
Updated : 18 June 2016, 07:17 PM

খাবারের খোঁজে
হোটেলে ব্যাগপত্র রেখে হাতমুখ ধুয়ে কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিলাম। তারপর বের হলাম শহর দেখতে। সকালের নাস্তা ভাল হয়নি। দুপুরে শুধু কযেকটা বিস্কুট দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ চালিয়ে দিয়েছি। তাই বেশ ক্ষুধাও লেগেছে। কিন্তু খাবার হলেইে যে সুস্বাদু হবে এমন নিশ্চয়তা নেই। আফ্রিকান খাবার এশিয়ানদের জন্য কোনভাবেই রুচিকর নয়। সকালে রঙ্গুয়ে হোটেলে নাস্তা করতে তার প্রমাণ পেয়েছিলাম। তাই কাছাকাছি কোন ইন্ডিয়ান হোটেল খুঁজলাম যাতে অন্তত কিছু ঝাল তরকারি পেতে পারি। হোটেলের রিসিপশনিস্ট একটি হোটেলের লোকেশন দিল। কিন্তু তার কথায় লোকেশন ক্লিয়ার হল না।তবে ভাবলাম, হাঁটতে শুরু করি, তারপর দেখা যাক। সামনে তো একটা কিছু পড়বে। তাছাড়া পথে পথে মানুষকে জিজ্ঞাস করা যাবে। এখানে বিশেষ করে পর্যটন এলাকার সুবিধা হল, এখানে অনেক মানুষ ইংরেজি জানে।

মাছের বাজার
হোটেল থেকে বের হয়েই সামনে পড়ল একটি মাছের বাজার। মাছের বাজার কোন দর্শনীয় স্থান নয়। তবে এখানে দর্শনীয় বস্তু যে থাকে না তা নয়। মনে হল, দেখি এখানে কি কি মাছ পাওয়া যায়। দেখলাম এখানে টুনা ফিসের দারুণ সমাগম। সাথে রয়েছে প্রচুর অক্টোপাস, স্কুইড, সাপলাপাতা, সার্ডিন ইত্যাদি জাতের মাছ। মাছের দাম বাংলাদেশের মাছের দামের মতোই।

ফিরতি ফেরির খোঁজ
কিছু দূরে গিয়ে খোঁজ নিলাম ফিরতি ফেরির। আর লোকজনের কাছে জানতে চাইলাম ইন্ডিয়ান হোটেল মহারাজা কোন দিকে। নানা জনে না কথা বলে। কথা শুনে মনে হল, এ হোটেল সম্পর্কে এদের তেমন কোন ধারণা নেই। তাই মধ্যবর্তী একটা পথ নিয়ে হাঁটতে থাকলাম। এক স্থানীয় পাবলিকের দেখা হল। সে আমাকে ঐ হোটেল দেখাবে বলে তার সাথে হাঁটতে বলল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। পূর্বেই জেনেছিলাম, জানজিবারের আইন-শৃঙ্খলা ভাল। তারপরও ফেরিতে পরিচয় হওয়া ইদ্রিস আমাকে মূল সড়ক ধরে হাঁটার পরামর্শ দিয়েছিল।

স্বপ্রণোদিত গাইড হারুন
লোকটার নাম মোহাম্মদ হারুন। সে বলল, সে নাকি দুবাইতে এক সময় কাজ করত। সেখানে বাংলাদেশের অনেক লোক ছিল। চৌধুরি নামের একজনকে সে এখনও মনে রেখেছে। হারুনের সাথে হাঁটলাম আর আশেপাশের বাড়িঘর দোকানপাট দেখতে থাকলাম। সব কিছুই পুরাতন। স্থানীয় মানুষগুলোর গায়ের রঙ আমাদের দেশের মানুষের মতোই কিছুটা। তবে মাথায় কেবল চুলের আকাল।

আসলে এ জান্জিবার দ্বীপে নানা জাতের, নানা দেশের মানুষের আগমনে তাদের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে এ স্থানের কালো মানুষগুলো আমাদের বাঙালিদের মতোই একটি সংকর রূপ ধারণ করেছে। এখানে পর্তুগিজ, জার্মান, ইংরেজ, আরব, ভারতীয় ও স্থানীয়দের সংমিশ্রণে এমন একটি জাতের সৃষ্টি হয়েছে। তবে আরব প্রভাবটাই বেশি বলে তাদের ধর্মটা রয়ে গেছে আরবদের ধর্ম, মানে ইসলাম ধর্ম। তাদের ভাষাটা বিকৃত হয়ে স্থানীয় ভাষার সাথে আরবির মিশ্রণে একটি সংকর ভাষাও তৈরি হয়েছে যার নাম হল কিসোয়াহেলি যেটাকে এখন সোয়াহিলি নামে অবিহিত করা হয়।

জেইন টেলের সিম কার্ড
সাথে মোবাইল থাকলেও এটা দিয়ে কল আদান প্রদান করা যায় না, যায় না ইন্টারনেট ব্যবহার করাও। তাই এদেশের একটা সিম কার্ড কেনা দরকার। একটা ফুটপাতের দোকানে নিয় গেল হারুন। একটি জেইন টেলের কার্ড নিল এক হাজার সিলিং। তার সাথে এক জিবির একটি ইন্টারনেট প্যাকেজ। দাম নিল তিন হাজার সিলিং। সাথে এক হাজার সিশিং এর টক টাইমও নিলাম। খুব দ্রুত একটা ভিডিও ক্লিপ তৈরি করে ইমো-তে সোমাকে পাঠিয়ে দিলাম। সিম কেনার এক ফাকেঁ দোকানে সাজান সিগারেটের প্যাকেট থেকে হারুন একটা সিগারেট তুলে নিল। চোখ লজ্জার খাতিরে তার দামটিও দিলাম। একটি সিগারেটের দাম পাঁচশ শিলিং, মানে ২০ টাকার মতো।

ফুটপাতে ফলের দোকান
আরো কিছু দূরে রাস্তার ধারের কাঁচা বাজার দেখে দেখে হাঁটছিলাম। প্রায় সকল প্রকার ফল মূল ও শাকসবজই পাওয়া যায়। কিছু দূরে গিয়ে দেখলাম আমড়া, পেঁপে ও শসা। এক ভাগা আমড়া, প্রায় এক কেজির বেশি হবে । তার দাম চাইল এক হাজার শিলিং যা আমাদের দেশের ৪০ টাকারও কম। আমি চারটা চাইলাম। দোকানদার বলল, সবগুলোই নিতে হবে। সস্তা দাম বিবেচনা করে আমি সবগুলো কিনে অর্ধেক আমার সাথের হারুনকে দিলাম।

ডাউয়া নয়, রুটিফল
কিছু দূরে দেখি ডাউয়া ফলের মতো সবুজ রঙের কিছু ফল। এগুলোর দামও সস্তা। প্রায় দুই কেজি ওজনের চারটা ফলের দাম এক হাজার শিলিং। আমি জানতে চাইলাম, এগুলো ডাউয়া কি না। ওদের বর্ণনা শুনে মনে হল, এগুলোর ভিতরে কাঁঠালের মতোই কোষ আছে। আমি ধরেই নিলাম এগুলো ডাউয়া। কিন্তু ডাউয়া ফল, তা আবার কাঁচা ডাউয়ার এত কদরের কারণ খুঁজে পেলাম না। কিন্তু পরে জেনেছি এগুলো ডাউয়া নয়।

এই ডাউয়া ধরনের ফলগুলো হল ব্রেডফ্রুটস বা রুটিফল। কিশোর বয়সে কিছু ভ্রমণকাহিনী/কল্পকাহিনী পড়েছিলাম। সেখানে এক নাবিক দূর সমুদ্রে সঙ্গিহীন জীবন যাপনে বাধ্য হয়। এক সময় সে রুটিফল আবিষ্কার করে। গাছে নাকি রুটির মতো ফল ঝুলছিল। তার আর কষ্ট করে গমের আটা থেকে রুটি তৈরি করতে হয়নি। রুটি পাওয়া গেল গাছের ডালে।


কিন্তু রুটি ফল যে ডাউয়া জাতীয় ফল তখন সেটা বুঝিনি। বুঝলাম আজ। পর দিন মসলা সফরে গিয়ে বাগানে রুটি ফলের গাছ দেখলাম। ডাউয়া গাছের মতোই বড় বড় গাছ হয়। কিন্তু পাতাগুলো মশৃণ ও চিরল চিরল। তবে বড় বড় পাতা।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় এ ব্রেডফ্রুট বা রুটিফল একটি প্রধান খাবার। এ ফলের ভিতরটা ডাউয়ার মতোই। মাঝখান দিয়ে কাঁঠালের ভোতার মতো একটা রিসিপটাকল রয়েছে যাকে ঘিরে থাকে বিচিসহ ফল। স্বভাবতই এটা একটা যৌগিক ফল। আর কাঁঠালের আঠার মতো আঠাও আছে।

সাধারণত এগুলো রান্না করেই খাওয়া হয়। আধাপাকা রুটিফলের তরকারি ঠিক নাকি আলুর মতো লাগে। নেটে গিয়ে ঘেঁটে দেখলাম এ ফল শর্করা সম্মৃদ্ধ। প্রটিন, ভিটামিনসহ অন্যান্য উপাদানও রয়েছে। তাই ভাত, রুটি, কাসাভা, ভুট্টা জাতীয় শর্করা সম্মৃদ্ধ ফসলের বিকল্প হিসেবেই এটা ব্যবহার করা যায়। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অনেক দ্বীপাঞ্চলে এই রুটিফলই নাকি প্রধান খাদ্য।

হারুন পারিশ্রমিক চায়
বেশ কিছু পরে হারুনকে বিদায় দিলাম। সে যে আমাকে এমন উদারভাবে সময় দিচ্ছে এবং তার বিনিময়ে সে আমার কাছে থেকে কিছু টিপস দাবি করতে পারে সেটা আগেই অনুমান করেছিলাম। তাই পূর্বেই তার জন্য সিগারেট, আমার কেনা আমড়ার অর্ধেক তাকে দিয়েছিলাম। কিন্তু বিদায়কালে হারুন বলল, আমাকে ধন্যবাদ বলবা না। আমি বললাম, অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু সে শেষ পর্যন্ত টিপস চেয়ে বসল। আমি তার সিগারেটের দাম, আমড়ার অর্ধেক এসব উপহারের কথা বললাম। সে আমতা আমতা করে চলে গেল। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল। আমাদের পাশেই এক পুলিশ অফিসার ডিউটি করছিল। তাই আমিও তাকে ধন্যবাদ, ধন্যবাদ বলে অতিরিক্ত কনসালটিং ফি ছাড়াই বিদায় করার সাহস পেয়েছিলাম।

ফলাহারেই রাত পার
বের হয়েছিলাম একটু ঝাল খাবারের খোঁজে। খুঁজে পেতে চেয়েছিলাম মহারাজা হোটেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভিন্ন নামের একটি হোটেল পেলাম।দেখলাম খাবারের দাম নেহায়েত সস্তা নয়। নিরামিস খেলেও খরচ পড়বে প্রায় ১২ ডলারের মতো। দামটা আমার কাছে অস্বাভাবিকই মনে হল। অধিকন্তু এ খাবার আসলেই সুস্বাদু হবে কি না আমার সন্দেহ হল। সন্দেহের আরো কারণ ছিল যে হোটেলে কোন খদ্দেরই পেলাম না। তাই দাম শুনেই কাম শেষ করে হোটেলে ফিরে এলাম।

রাতের খাবারের জন্য আজও ভাত পেলাম না। তবে ফলাহারে আমার আপত্তি নেই। দুটো পেঁপে, কিছু আমড়া ও কয়েকটা শশা কিনেছিলাম। এগুলোর কিছু খেয়েই শুয়ে পড়লাম। ক্লান্ত শরীর ঘুম আসতে সময় লাগল না। (০৯, জুন, ২০১৬, ইউএন হাউজ, জুবা, দক্ষিণ সুদান)